চাঁপাফুলের গন্ধ
সকাল থেকে ভারি বৃষ্টি।
হেমন্তের আদুরে বাতাসি তুলো তুলো বৃষ্টি, বা মাঘের শেষে যেমনটা চামড়া কেটে বসে যাওয়া বরফের ছুরির মতো ঠাণ্ডা বিন্দু নেমে আসে, তেমনটা নয় - এই বৃষ্টি বর্ষার। একনাগাড়ে, ভারি, ঘন, ক্রমাগত বয়ে চলা শ্রাবনের জল।
কাল পর্যন্ত মৃতসন্তানের শেষ গন্ধ আগলিয়ে রাখার মত বাগানের মাটি গাছের গোড়াগুলো ধরে রেখেছিল। আজ আর সেটুকুও দেখা যাচ্ছে না। সব ডুবে গেছে।
চৌধুরী বাড়ির পিছনের দিকে হাজামজা পুকুরটার ধারে বাবলা গাছটা অর্ধেক ডুবে গিয়ে একটা কুঁজো বুড়োর মতো দুলছে। চৌধুরী বাড়ির খিড়কিদুয়ার থেকেই ঐ জলে ডোবা মাঠ, বাবলা গাছের স্যাঁতসেঁতে ছায়া, মজা পুকুর দেখা যায়। এমন কিছু যে একটা মায়ামাখা দৃশ্য তা নয়, নেহাতই চেনাজানা জলছবি।
তবু চৌধুরীদের কালোবৌ খিড়কি দরজায় দাঁড়িয়ে তাই দেখে।
এই পুকুর, পুকুর ধারের গাছ, জলে ডোবা মাঠ এসবের ছবি ওর কাছে খুব চেনা।
ওর কাছে অচেনা কেবল নিজের জীবন।
অচেনা ছবি, অচেনা জীবন নিয়ে আর সকলের মতই কালোবৌও ভয় পায়।
সেরকম অচেনা কোন ছোট ঘটনা শুনলেও কালোবৌয়ের ফোকলা দিদিমা বলত, “আশ্চজ্জি কতা বাবু, পেটের মধ্যি হাত পা সেঁদধে যাচ্ছে গো”।
কালোবৌদের কাছে ছোটখাটো বেশিরভাগ ঘটনাই আশ্চর্যের।
যেমনটা আর সকলের হয়, ঠিক যেমনটা সবাই বলে, তেমনটা না হলেই কালোবৌদের হাতপা ভয়ে পেটের মধ্যে ঢুকে যায়।
তা সেরকম আশ্চজ্জি কাণ্ড কালোবৌয়ের জীবনেও ঘটেছে বৈকি।
এমনিতে কালোবৌয়ের যে খুব একটা বুদ্ধি আচ্ছে, এমনটা কেউই কখনো দাবী করেনি। তবে তার মতো একটা দুপয়সার জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে না সেরকম জড়ভরতও সে নয়।
কিন্তু এমনতর আশ্চজ্জি জীবনের জন্য তো সে মোটেই তৈরি ছিলনা, তাই মধ্যে মধ্যে কেমন যেন ধাঁধা লেগে যায়।
ধাঁধায় যে সে কী দেখে, কী শোনে ভগবান জানে।
এই যে যেমন এইমাত্র ওর সামনে দিয়ে চাঁপাবৌ বিকেলের গা ধুয়ে ঘরে এলো, কালোবৌয়ের মনে হল চাঁপাবৌ এর গা থেকে বুঝি সত্যি চাঁপা ফুলের বাস আসছে।
কিন্তু সত্যি তো আর তা নয়।
চৌধুরীদের উঠোনের ওপাশে চাঁপাফুলের গাছ ঝেঁপে ফুল এসেছে। সুবাসও ওখান থেকেই আসছে।
চাঁপাবৌ ভেজা কাপড়ে ঢেউ তুলে ভাঁড়ার ঘরের দিকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। শাশুড়িমা দোতলা থেকে ডাক দিলেন, “বৌমা, সন্ধ্যেবাতিটা দেখাও।”
কালোবৌ চটকা ভেঙে কুলুঙ্গি থেকে সন্ধ্যেপ্রদীপ আনতে গেল।
দাওয়া থেকেই তুলসী দেবতার দিকে আলোর অর্ঘ্য দেখায়। ওর মনে হয়, চাঁপাবৌ বুঝি এতক্ষণে চুল বেঁধে, ধোয়া শাড়ি পরে সন্ধ্যেদেবতাকে ওর মতই প্রণাম করছে।
চাঁপাবৌ, কালোবৌ এর পায়ে পায়ে এমন জড়িয়ে থাকে যে কালোবৌ এর মনে হয় ওর ছায়ার সঙ্গে বুঝি চাঁপাবৌ মিশে আছে। ওর দিকে কেউ তাকালে মনে হয় সে বুঝি ওর ঠিক পাশ দিয়ে চাঁপাবৌ এর দিকে দেখছে।
এই যে কালোবৌ, চাঁপাবৌয়ের ছায়ার সঙ্গে মিশে একটা অন্য মানবী হয়ে উঠেছে, সারাজীবন কি ও এরকম ছিল?
মোটেই না।
বরং বছর কয়েক আগে, এই চৌধুরী বাড়ির তেল-সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে গা ঘষার আগে, এদের দুধ- ফল- মিষ্টি খাওয়ারও আগে কালোবৌ কবিতার একটা অন্য জীবন ছিল। সেই জীবনে সে আরও কালো, আরও কুশ্রী হলেও জীবনটা ছিল তার নিজের।
কারো ছায়ার সঙ্গে মেশামিশি করা কোন আশ্চর্য জীবন নয়।
ভাগচাষী মনোহরের মেয়ের একটা একঢালা সাধারণ জীবন।
একঘেয়ে রোজনামচার হলেও চেনাজানা, নিস্তরঙ্গ। সুখ বলে কিছু না থাকলেও, দুঃখগুলো চেনা ছিল।
গরিবের বাড়িতে রূপহীনতার আহাজারি থাকেনা তা নয়, তবে গতরের দাবির নিচে সেটা চাপা পড়ে যায়। বড়োলোকের বাড়িতে কুরূপের যতটা কষ্ট, গরিব বাড়িতে ততটা নয়।
তবে কিছুটা হলেও কবিতার গায়ের রং আর থ্যাবড়া মুখের জন্য ওর সুখ দুঃখগুলো অন্যদের থেকে একটু আলাদা।
সেই যখন থেকে ওর চারপাশে ফরসা সুজাতা, চাপাফরসা কাকলি, ঘষাফরসা সুমিতারা কোলেকাঁখে দুটো একটা বাচ্চা নিয়ে সেই বারো, তেরো চোদ্দ থেকেই ঘুরছে, তখনো কবিতাকে কেউ চিঠি দেয়নি, কেউ ওর ওড়না ধরে টানেনি, কেউ ইস্কুলের পেছনের রাস্তায় নিয়ে যেতেও চায়নি।
পাবন তাঁতির মাকুর মত ইস্কুল আর বাড়ির মধ্যেই ওর জীবনটা হাঁটাহাঁটি করত। কবিতা কখনো পাশ করতে পারত, কখনো আবার পারতনা। সংসারের চাপে অবশ্য একসময় সেই পরিক্রমাও বন্ধ হয়ে গেছিল।
আর গরিবের ঘরে দুটো কাজের হাতের খুব কদর। কবিতার জীবন থেকে ইস্কুলে যাওয়ার আড়ম্বরটুকু চলে গেলে সংসারের জোয়ালটা ওর ঘাড়েই চেপে বসল। কবিতা সংসারের ঊনকোটি সামলালে ওর মা আরও একটু বেশি মুড়ি ভাজতে পারে, ধান সেদ্ধ করতে পারে। মিত্তিরদের পুকুর ধার থেকে আরও কটা বেশি হিঞ্চে বা কলমি শাক তুলে আনতে পারে।
ভাগচাষীর একার রোজগারে কি আর সংসার চলে? কবিতার নীচে আরও দুটো ছোট ভাই।
সংসারটা সামলাচ্ছিল বলেই হয়ত উনিশেও কবিতার কোন খেঁকুরে দোজবরে বা হতদরিদ্রের ঘরে বিয়ে হয়ে যায়নি।
যদিও বিয়ের জন্য রূপ আর রূপো কোনটাই মনোহরের ঘরে ছিল না, তবে তাছাড়াও তো ছাড়াও যৌবনের দাবী মেটাতেও তো মনোহরদের ঘরে বিয়ে হয়ে যায়। তাও হয় নি কবিতার।
সে যাই হোক। একেবারে জলেও পড়েছিল না সে। চাষের ধানে, কলমিতে, গেঁড়িগুগলিতে মিলে খেয়ে পরে চলে যাচ্ছিল। তাই দু এক কথায় এই চৌধুরীদের ছেলের সঙ্গে কালো মেয়ে কবিতার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, তোবড়ানো গালে বুড়ো দিদমা বলেছিল, ‘আশ্চজ্জি কতা বাপু।’
তারপর খানিক থেমে কবিতার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘বিটাটা পাগল নাকি?’
মোটের ওপর গরিবের কালো, কুশ্রী মেয়ে কবিতার সঙ্গে চৌধুরীদের ছেলে সুশান্তর বিয়ে যেন এক পাগলের কাণ্ডই বটে।
না,তবে ছেলে পাগল নয়।
ছেলের মা দেখতে এসেছিলেন কবিতাকে। চৌধুরীদের জমিজমা, চালকল, বাজারে তিনচারটে চালু দোকান, সেসব নতুন করে কবিতাদের জানার কিছু নেই। চৌধুরীদের সম্পত্তি, প্রতিপত্তি সবই এই গ্রামের লোকের জানা। বড় চৌধুরী গত হয়েছেন সেটুকু কেবল জানত মনোহর। এছাড়া তাদের মত ঘরে চৌধুরীদের খবর রাখার কোন কারণ ঘটেনি।
গিন্নি এসে বললেন, ছেলের বিয়ে তাঁরা দিয়েছিলেন দূরে কোথাও। কিন্তু বিয়ের পরপরই ছেলের বাবা গত হন। আর সেই বৌও বাপেরবাড়িতে প্রসবকালীন সময়ে মারা গিয়েছে, বাচ্চাটিকেও বাঁচানো যায় নি।
সেও প্রায় বছর ঘুরতে চলল।
এখন কর্তা নেই। তাঁরও আর দূরে অচেনা জায়গায় ছেলের বিয়ে দিতে যাবার শক্তি নেই, ইচ্ছেও নেই।
কবিতাকে তাঁর পছন্দ হয়েছে।
কবিতার যদিও নিজের কোন মতামত ছিল না। সেও যে মতামত দিতে পারে এরকমটা তার জানাও ছিল না। তবু বিয়ের সময় সুপুরুষ সুশান্তকে দেখে কবিতার মন ঠাণ্ডা, নিশ্চিন্ত, নির্ভার এক ভালোবাসার অনুভূতিতে ভরে উঠেছিল।
শাশুড়ি তাকে কালোবৌ বলে ডাকেন এমনটা নয়।
চৌধুরীরা গায়ের রং দেখে কাউকে কালো বলে গঞ্জনা দেবে এরকম সহবত তাদের নয়। কেবলমাত্র অদ্ভুত দৃষ্টিতে কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া বিয়েতে আসা আত্মীয়রা কবিতার সঙ্গে আর কোন ধরণের খারাপ ব্যবহার করেনি।
তবে কারো দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটিকে কি খারাপ ব্যবহার বলা যেতে পারে?
ওদের তাকানো দেখে কবিতার মনে হচ্ছিল ওরা যেন কবিতাকে সর্বদা কিসের সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচার করে নিচ্ছে।
মেজকাকি বৌ দেখে বললেন, “কিসে আর কিসে, সোনা আর সিসে।”
সোনাইমুড়ির মাসশাশুড়ি বললেন, “তা দিদি তোর এই কালোবৌয়ের গায়ে গয়নাগুলো খুলেছে ভালো। তার তো সোনার অঙ্গে সোনার কাঁকন মোটে দেখা যেতনা কিনা। সে যেন ছিল ঠিক চাঁপা ফুলটি।”
তবে এসব কথা কবিতার কাছে সেরকম কিছু একটা বড় ব্যাপার নয়। প্রথম দিকে সে কিছুটা বুঝতেও পারেনি, বাকিটা সে গায়ে মাখে নি।
যাবার আগে আড়ালে আবডালে তারা কালোবৌ নামটা চালু করে দিয়ে গেল।
তবে কবিতারা আশেপাশে যা শোনে তার তুলনায় এসব কিছুই নয়। কাকলির শাশুড়ি যে কুটনো কোটার বটি দিয়ে ওর পায়ের নখগুলো থেঁতলে দিত বা ননদাই এর পাতে চুল পড়েছিল বলে সুমিতার শাশুড়ি ওকে বাটি করে পেচ্ছাপ খাইয়েছিল, সেরকমটা চৌধুরীদের বাড়িতে মোটেই হয় না।
বরং শাশুড়ি একটু আদরের চোখেই দেখেন তাকে।
এটাও কি কম আশ্চর্যের কথা?
এই যে কবিতাকে শাশুড়ি চোখে হারান এ কি ওদের চারপাশে, সাতগুষ্টিতে কেউ শুনেছে? নিজে পছন্দ করে নিয়ে এসেছেন বলেই কিনা কে জানে শাশুড়ি কবিতাকে ভালবাসেন।
শাশুড়ি বলছিলেন,“ছেলেপুলে হবে, ক্যাঁতাকানি ধোবে, তবে না সোয়ামি ইস্তিরির ভালোবাসা? কি গো বৌমা? তাই না?”
বলে তিনি ঘোলা চোখে কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বোধহয় ছেলেপুলে হবার ইঙ্গিত খোঁজেন।
কবিতা মাথা নিচু করে নেয়।
প্রতি রাত্রে সুশান্তর চোখের যে বিবমিষা মাখা দৃষ্টি, কালোবৌয়ের মুখের দিকে তার যে অসহায় দৃকপাত তারপর কি আর ছেলেপুলে হয়! আর সে কথা কবিতা কাউকেই কি বলতে পারে?
সে চোখ সরিয়ে নেয়।
শাশুড়ি ঘরসংসারে কবিতাকে বসত করান। হাতে ধরে চেনান চৌধুরীবাড়ির ভাঁড়ার, রসুই, ঠাকুরঘর। এর চারপাশেই তো মেয়েদের জীবন।
চেনাতে চেনাতে একটু একটু করে আগের কথা বলেন। বলেন সুশান্তর চাঁপাফুল বৌয়ের কথাও।
“জলহাঁস দেখেছো বৌমা? মেলায় কেনা জলহাঁস? তাদের পাতলা কাঁচের চামড়া দেখেছো? ভেতর দিয়ে কেমন টলটলে জল দেখা যায়? ওমনি ছিল তার গায়ের রং, ভিতরের রক্তমাংস যেন ফেটে বেরত। উনি এসে বললেন, চন্নন বর্ণ। তা রূপ ধুয়ে কি জল খাবো? তা উনি শুনলেন না।”
শাশুড়ি বলে যান, “তা রূপ ছিল বটে। যেমনি মুখের কাটুনি, তেমনি চুলের থাকুনি। হাঁটতে গেলে যেন পায়ের পাতায় রক্ত জমে যেত গো। ফরসা কি গাঁয়ে নেই? কিন্তু আমাদের দেখা আর পাঁচটা ফরসা মেয়েমানুষের সঙ্গে তাকে মেলালে চলবে না। আর সে হাত পাই বা কেমন? সেদ্ধ ডিমের মধ্যে থেকে হলদে কুসুমের আভা দেখা যায়, শরীরটাই ছিল সেরকম। আর নিজের মুখে কি আর বলব, ছেলে ঐ রূপের মোহেই…।”
কবিতা মনে মনে সেই চন্দন রঙের সেদ্ধডিমের মত মেয়ের ছবি আঁকে।
এতো আর চাপা ফরসা, ঘষা ফরসা নয়। এ একেবারে চন্দন রঙের মেয়ে।
শাশুড়ি কবিতাকে গল্প বলেন। কখনো উঠোনে জোনাকির দল উড়ে বেড়ায়। কখনো আষাঢ়ের মেঘ ঘন হয়ে ভারি হয়ে নেমে আসে। কখনো আবার তারা জমজমে আকাশ। কেবল সবসময়েই চাঁপাফুলের হালকা গন্ধ চৌধুরী বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়।
“কিন্তু সে যেন এ জগতের মানুষই নয়। একটা কতা বলে সুখ নেই, চোখে যেন একটা আলুভুলু চাউনি। সংসারের দুটো সুসার নেই। মুড়ির চাল চেনে না, আঁশ সগড়ি বোজে না। আটায় জল দিতে জানেনা। কিচু বললেই কেবল দু চোখ ভরে জল, টপ টপ টপ টপ। চার ভেয়ের এক আদুরে বোন। তবু ছিলুম। ঐ ভেবলি নিয়েই তো ছিলুম। আমার কপালে যা ছিল। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সইয়েই নিয়েছিলুম। তা তার নিজেরই কপালে সইল না, তা আমি আর কি করব? ও যেন এই সংসারে থাকার নয়, থাকতে আসেনে। কেবল আমার ছেলেটার মনটা একেবারে ঘেঁটে দিয়ে গেল। ঐ ফরসা রঙে, ঐ রূপের জেল্লায় আমার একেবারে জন্মের ঘেন্না ধরে গেছে।”
শাশুড়ি হাঁফ নেন, কালো বৌয়ের হাত দুটো ধরে বলেন, “এইবারে তুমি এসে গেছো মা। নিজের সংসারটা গুছিয়ে নাও তো। কোলে তোমার একটা খোকা আসুক। তোমার হাতে এই সংসারটা দিয়ে আমি শান্তি পাই।”
কালোবৌ বুঝতে পারে, এক রূপসীর রূপের ত্রাসে ভয় পেয়েই তাকে বিষহরী করে নিয়ে এসেছেন শাশুড়ি। তার কালো রং দিয়ে তাঁর সংসারের আগের সেই গৌরবর্ণের বিশৃঙ্খলাটুকু যেন তিনি কাটিয়ে উঠতে চাইছেন। কবিতার দেহের কালি বর্ণকে বাজি রেখে আরেকবার জীবনের পাশার দানটি বুঝে নিতে চাইছেন চৌধুরীগিন্নি।
একই সঙ্গে সেই সংসারের কাজ না জানা, আদুরে সুন্দরী মেয়েটার জন্যও তার বুকটা টনটন করে ওঠে। স্বামীর আদর পেয়েও সে হতভাগির কপালে সয় নি। সেই অচেনা মেয়েটার অসমাপ্ত জীবনের দুঃখে নাকি শাশুড়ির এই অপ্রত্যাশিত আদরে, আজন্ম কুরূপা কালোবৌয়ের চোখ দিয়ে অসহায় জল গড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু কার সঙ্গেই বা সে সংসারটা করবে?
চৌধুরী বাড়ির ছেলে যে কালোবৌকে মোটেই দেখতে পায় না সে তো আর একদিনের কথা নয়। বিয়ের পরও মাস গড়িয়ে বছর। বছর গড়িয়ে দু বছর। একসময় কালোবৌয়ের কেমন যেন নিজেকেই ছায়া ছায়া মনে হতে থাকে।
যেন জড়ির শাড়ি পড়া একটা ছায়া হাত যত্ন করে ভাত বেড়ে সাজিয়ে দিচ্ছে পাটশাক ভাজা, ঘি দেওয়া মটর ডাল, মোচার ঘণ্ট, পাকা কাতলার কালিয়া। সবই স্বাদে, গন্ধে, দৃশ্যে ঝকঝক, চকচক করছে, কেবল কালোবৌ যেন বেবাক ফাঁকা মানুষ। সুশান্ত তাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু বুঝি তার হাওয়ায় গড়া শরীরের ভেতর দিয়ে ওপাশে বসা চাঁপাবৌকে সঠিক দেখতে পাচ্ছে।
এক খাটে শুয়ে কবিতার দিকে চোখ পড়তেই সুশান্তর সমস্ত শরীরটা যেন ঘৃণার ধনুষ্টঙ্কারে বেঁকে যায়, অমনি সে দৃষ্টিটাকে শূন্য করে নেয়। যেন পাশে কোন মানুষই নেই।
মাঝেমাঝে কালোবৌয়ের মাথায় যখন কেবলি গুলিয়ে যাচ্ছিল কে যে রক্ত মাংসের আর কে যে ছায়া! তখনই একদিন বাপের বাড়িতে ঘষাফরসা সুমিতার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছিলো কবিতার।
এখন আর সুমিতা ঘষাফরসা নেই। সংসারের আগুনতাতে সুমিতা এখন বেশ কালোই। সেই সুমিতা এখন মোটা চাল, মোটা কাপড়, মোটা দাগের ঘরকন্নার গিন্নি। মাজাঘসা দুটো মোটাসোটা ছেলেমেয়ে ওর।
এখন আর ও, সেই আগের শাশুড়ির পেচ্ছাপ খাওয়া সুমিতা নেই।
“অনেকদিন এদিগে আসিনি। শাউড়ি ঠ্যাং ভেঙে শয্যা নেছিল বছরখানেক। তা তকন থেকেই সব এই আমার ঘাড়ে।’’
খানিক হেসে নেয় সুমিতা। খানিক এদিক অদিক দেখে বলে, “সেবা করিনি তা নয়। মেয়ে তো পথও মাড়াল না। গু, মুত সবই আমি। তবে মুতটা পুরো কোনদিনই ফেলতুম না বুজলি, খানিকটা মাগির খাবার জলেই মিশিয়ে দিতুম।” হি হি হি হি করে হাসতে থাকে সুমিতা।
কবিতার সোনার মটর দানা হারের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে সুমিতা। হাসি থামিয়ে খানিকটা দম নেয়, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “কিন্তু তুই কেন দু বছরে একটাও নামালি না বলতো? মাকাল ফল নাকি রে? বন্দুকে গুলি নেই?”
তারপর ওর স্বভাবমত হ্যা হ্যা করে খানিক হেসে বলে, “যাহ্, তা তো নয়। আগের বৌটা বিয়োতে গিয়েই তো মরল? তবে? তুই ওষুধ ফসুধ খাচ্ছিস? নাকি তোর মত কালটির পেটে বাচ্চা নেবে না?”
ওর ছেলেমেয়ে গুলো আঁচল ধরে টানাটানি করছিল। হাসতে হাসতে চলে যায় সুমিতা।
যাবার আগে চোখ মটকে সুমিতা বলেছিল, “দোর টোর ধর না, ঠিক বাচ্চা আসবে। সব রোগেরই চিকিচ্ছে আছে।”
সুমিতার ওষুধের কথায় শালকি বুড়ির কথা মনে পড়ে কালোবৌয়ের। দিদমা বলেছিল শালকি বুড়ির কাছে সব রোগের চিকিচ্ছে আছে।
দিদমার সঙ্গে যেত বটে শালকি বুড়ির বাড়ি।
তার কাছে সব রোগের ওষুধ পাওয়া যেত।
দিদমার বলেছিল কবিতা কে, “এ এক আশচজ্জি কথা বুজলি কবি, শালকি বুড়ির কাচে সব রোগের চিকিচ্চে হয়। সব।”
মেজমাসির পেটে একবার কি ব্যথা। মাকে দিদমা ডেকে পাঠিয়েছিল। মার সঙ্গে কবিতাও গিয়েছিল।
তা গিয়ে থেকে মার মুখ যেন হাঁড়ির মতো। দিদমারও তাই। পেট ব্যাথায় মেজমাসির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।
কবিতা কেবল মেজমাসির মাথায় হাত বুলিয়ে দিছিল। মা যেন কি! অসুখ শুনে গিয়ে মেজমাসিকে একটুও দেখেনি।
তারপর রাত নামলে ওকে নিয়ে শালকি বুড়ির বাড়ি থেকে ওষুধ আনতে গেছিল দিদমা। সেই রাতের বেলায় চাদ্দিকে তখন ব্যাঙের ডাক। ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকারে শালকি বুড়ির বাড়ির পাশের বাঁশবনের পাঁজরে হাওয়ার শোঁশোঁ হাঁফটান।
রাতের ওষুধ খেয়ে পরদিন সকালে মেজমাসির বিছানায় কি রক্ত, কি রক্ত। মা বললে, কাপড়ের ভিতরে মাসির দাবনা কেটে গেছে, ওষুধ খেয়ে সেরে যাবে।
কে জানে, তাই হবে। দাবনা কেটে কত রক্ত।
সেই দাবনাকাটা মেজমাসিকেই মনে আছে কালোবৌয়ের। তারপর তো আর দেখাই হয়নি কখনো মেজমাসির সঙ্গে। তাড়াহুড়োয় বরধ্মানের দিকে বিয়ে হয়ে গেছিলো মাসির।
ওদের সে বিয়েতে ডাকেনি দিদমা।
মেজমাসির সঙ্গে কতদিন আর দেখা হয় না কবিতার। কিন্তু শালকি বুড়ির সঙ্গে দেখা হয়েছিল বৈকি।
ওষুধও দিয়েছিল শালকি বুড়ি। এক্কেবারে মোক্ষম ওষুধ।
শাশুড়িকে বলেই শালকি বুড়ির কাছে ওষুধ আনতে গেছিল কালোবৌ।
শাশুড়ি বললে, “যাবে বৈকি। ছেলেপুলে হবার ওষুধ তো ভালো কথা। ছেলেপুলে হবে, ক্যাঁতাকানি ধোবে, তবে না সোয়ামি ইস্তির ভালোবাসা, তবে না সংসার…”
সেই একইরকম আরেক ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার রাতে শালকিবুড়ি ওর ঘরের বাইরে একটুকরো খোলা দাওয়ায় বসেছিল। ওর শনের মত সাদা চুল উড়ছিল রাতের বাতাসে।
শালকিবুড়ি কফ জমা ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, “দু বচরে একবারও চেয়ে দেকলনি? দুটো কতাও বললনি?”
“না”, এর থেকে বেশি সে আর বলতে পারে না। কেবল দূরে বাঁশ ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কালোবৌ । একবার সব শক্তি সঞ্চয় করে নিজের কথা, সুশান্তর কথা, এমনকি চাঁপাবৌয়ের কথাও বলেছে বুড়িকে। এমনটা বুক উজাড় করে সে আর কাউকে বলতে পারেনি।
এমনকি নিজের মাকেও নয়।
“ওষুধ আচে আমার কাছে।আশেপাশে যখন সব চকচকে তখুন চোক ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু চারিদিক যখন আঁধারে ছেয়ে যায় তখুন মানষে হারানিধি খুঁজে পায়। সব ওষুধ আচে আমার কাচে। কিন্তু সেই ওষুধ তুই দিবি কিনা ভেবে দেখ।” শনের মত চুল বাতাসে উড়িয়ে বলে শালকিবুড়ি।
ওষুধ নিয়ে আসে কালোবৌ।
গলার মটর মালাটা খুলে দিয়ে আসে বুড়িকে। বুড়ির চোখ চকচক করে, বলে, “ওষুধ তা একটু তিতকুটে, তেতো তরকারির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। বিটা হলে মিষ্টি খাইয়ে যাস নাতিন।”
তা সে আর যাওয়া হয় নি।
এরপর থেকেই তো, মাঝেমাঝেই সুশান্ত সিঁড়ির ধাপ গুলিয়ে ফেলতে লাগল।
চশমা হল সুশান্তর। ভারি চশমায় সুশান্তর লম্বাটে মুখটা আরও সুন্দর লাগে কবিতার কাছে।
ক্রমশ কেবল সিঁড়ি নয়, পায়ের তলার মাটি টালুমালু হতে থাকে, কাগজের লেখা হিজিবিজি হয়ে যায়। সুশান্ত হাওয়ায় হাত বাড়ায়। এবার সুশান্তর কাউকে একটা প্রয়োজন হয়।
কালোবৌ ধারে কাছেই থাকে, এগিয়ে এসে সুশান্তর হাতটা ধরে।
কালোবৌ কখনো নিমপাতা ভাজে বেগুন দিয়ে, পাঁচফোড়ন দিয়ে সবুজ করলা ঝিরিঝিরি করে তরকারি বানায়। কখনো আবার পলতাপাতা তুলে এনে বড়া ভাজে। তেতো কষাটে স্বাদ হয়।
চৌধুরী বাড়ির ছেলের চোখের জ্যোতি কমে আসে। সুশান্তর একটি হাত দরকার হয়।
কালো বৌ এগিয়ে আসে। স্বামীর হাত ধরে।
সুশান্ত কবিতার হাত ধরে। ওদের হাতে হাতে ভাব হয়।
চোখের আলো যত ক্ষীণ হয়ে আসে, হাত দিয়ে সুশান্ত ততই গভীরভাবে কবিতার হাত ধরে। বড় ঠাণ্ডা, নিশ্চিন্ত ভালোবাসার হাত কালোবৌয়ের।
ম্যানেজারবাবু মাঝে মাঝে এসে বাড়ি, দোকানের ভাড়া, ধান চালের হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে যান। সুশান্ত তদারকি করে বুঝে নেয়। কালোবৌ কবিতা হিসেব দেখে নেয়।
এমন কিছু পড়াশোনা জানেনা সে কিন্তু তার মত একটা সাধারণ জীবন যখন আশ্চর্য হয়ে যায়, তখন সেটা চালিয়ে নিতে পারবে না এতোটা জড়ভরতও সে নয়।
শাশুড়ির মন খারাপ হয়, সুশান্ত আজকাল চোখে কম দেখে। শাশুড়ি খুশি হয়, কালোবৌয়ের খোকা হয়েছে।
কালোবৌ ভাবে, দিদমা ঠিক বলত শালকি বুড়ির কাছে সব রোগের দাওয়াই আছে।
সে ওষুধ তুলে রেখেছে কালোবৌ।
চোখের চিকিৎসা যে সুশান্তর একেবারে হয় না, তা তো নয়। কখনো কখনো তাল ওঠে বৈকি।
প্রথম দিকটায় ঘন ঘন হতো, কখনো টাউনে, কখনো জেলা সদরে।
ডাক্তারের ওষুধ আসত। চোখে দেবার জলওষুধও। কালোবৌ নিয়ম করে ওষুধ দিয়ে দিত।
তখন কবিতা একটু ঘন ঘন পলতাপাতার বড়া ভাজত। শাশুড়ি খেতে ভালবাসে, সুশান্তও। তেঁতো, কষাটে পলতা পাতার বড়ায় শালকি বুড়ির ওষুধের স্বাদ মিশে যায় ভালো।
ডাক্তার ওষুধে কাজ সামান্য হয় কখনো, সুশান্ত কালোবৌয়ের জড়ির শাড়ির পাড় দেখতে পায়। আবার কখনো কিছুই দেখে না। আশা মিলিয়ে যায়।
কালোবৌ আর পলতার বড়া ভাজে না।
মাসখানেক আগেই তো সুশান্তর বন্ধু প্রবীর, নিয়ে গেল একটা ক্যাম্পে। কলকাতার বড় ডাক্তার। আবার ওষুধ এল। কালোবৌ বুঝেও নিল সব ঠিক ঠাক।
প্রবীর অবশ্য মানুষ খারাপ নয়। সে সব ঠিক করে দিতে চায়।
প্রবীর বলে, “কালোবৌ আবার কি ধরণের ডাক সুশান্ত? এভাবে কেউ ডাকে? বৌদি আপনিই বা এসব বলতে দেন কেন? আপনার তো একটা নাম আছে নাকি?”
কবিতা ম্লান হাসে। সুশান্তও কে জানে কেন হাসে, ম্লান।
কবিতা ব্যস্ত হয়ে ঘরে চলে যায়। ওকে প্রবীরের চা, জলখাবার দিতে হবে।
এখন আবার সেইসব হ্যাপা। পলতাপাতার যোগাড় চাই তার। বড়া ভাজতে হবে আবার অনেকদিন পর।
সুশান্ত এখন একেবারেই চোখে দেখে না। হাত দিয়ে স্পর্শ করে, বোঝে, ভালবাসে। কালোবৌ থাকেও সবসময় সুশান্তর আশেপাশেই।
তবে কালোবৌ এখন মাঝেসাঝেই ওকে দেখে। গন্ধ পায়। চাঁপাবৌয়ের মিষ্টি গন্ধ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন