উত্তম বিশ্বাস - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

উত্তম বিশ্বাস

 সাদা লাভার সিঁড়ি   

                           

   
      
প্রথমে আমি এলিয়ে পড়ি। এরপর লাভা গড়িয়ে গড়িয়ে, জুড়িয়ে জুড়িয়ে যখন আমাদের ইহকাল পরকাল পিচ্ছিল করে দেয়, সংজ্ঞাহীন করে দেয়, ঠিক তখন আমার পৌরি, আমার প্রিয় পরশ আমার থেকে চলে যায় অনেক দূরে! এভাবে আমরা প্রায়শই একটি রোমহর্ষক গল্প খুঁজবার জন্যে একত্রে আত্মহত্যা করি! আজ আমি নেমে গেছি একটা গহীন খাঁদে। আর পৌরি উঠেছে ভূমার এক্কেবারে শীর্ষে। এখন আমার বয়েস বিয়াল্লিশ। পৌরি পঁয়ত্রিশ। বুকের ওপর তুহিনকুচি। সাদাপাকা কয়েকটা কেশ বিদে-খাওয়া চোরকাঁটার মতো তিরিতির করে কাঁপছে। যাহোক করে এখান থেকে একখানা গল্প আমাদের নামিয়ে আনতেই হবে। যে গল্প হবে অপার্থিব, অনিন্দ্য, অসংলগ্ন অথচ অস্পষ্ট, এক কথায় একালের ইডি মিডিয়া মড়ক ও মনোবিকলন শূন্য!
শুরু হচ্ছে সাদা লাভার সিঁড়ি। প্রচণ্ড বুদবুদ, পিচ্ছিল আর আঁশটে গন্ধ! আর একটুখানি ওপরে উঠলেই সেই আদি এবং অকৃত্রিম গল্পের ঘর! এখন আমিও উঠছি। পাথরের আলগুলো যেন একেকটা সাদা বরফের আরুণী! এমনভাবে জমাট বেঁধে আছে গাইতি মারলেও ওদের গা থেকে আগুন ফুঁসিয়ে উঠবে। এমন আট থেকে ন’টা শুকনো ঠনঠনে সন্ন্যাসী ঝোরা অতিক্রম করার পর হঠাৎ নূপুর নিক্কনের মতো মুক্ত জলের লহরা ভেসে এল। দেখলাম ভিজে পাথরের ওপরে বেণী বিছিয়ে পা দোলাচ্ছে পৌরি। পাশে উপুড় করা একটা কলস। কলসটা মিনে করা। সম্ভবত পেতলের। আর ওটা এতটাই পুরনো যে, পোড়ানো পাথরের চেয়েও কালো কুচকুচে দেখাচ্ছে। আমি কলসটার কানায় দুটো টোকা দিয়ে বললাম, “বাড়ি চলো পরশ!”
আমার প্রিয় পরশ ডাকেও পৌরি কথা বলছে না দেখে সামনের আরেকটা উঁচু পাথরের ওপরে শুয়ে পড়বার ভান করলাম। এবার পৌরি কলস কাঁচিয়ে আমার চোখে সামান্য জলের ছিটে দিয়ে বলল, “এখানে শিলার ওপরে শুতে মানা সুরথ!”
পৌরির ওই চিরচেনা সম্বোধনে আমি কনুইয়ে ঠ্যাকনা করে মাথা তুলবার চেষ্টা করলাম, “কেন মানা?”
-“এতেকরে পাথরের ওজন বেড়ে যায়!”
আমি অবাক হবার আগেই সে তার হাতের তালু দুখানা আমার দিকে মেলে ধরল, “বিশ্বাস হচ্ছে না তো? এই দেখো। সূর্য উঠুক অথবা না উঠুক, রোজ আমাকে এই তালের উপরে উঠতে হয়। একটা একটা করে পাথর সরাতে হয়। যারা জল নিতে আসে ওঁদের কলস মেপে জল দিতে হয়। তারপর দিন শেষে আবার তালের মুখ বন্ধ করবার জন্যে পাথরগুলোকে ঠেলে ঠেলে যায়গামতো সাজিয়ে গেঁথে দিতে হয়!”
গুররাস ফুলের পাপড়ির মতো ওর করতল। দেখলাম সত্যি সত্যি কেমন রক্তাভ হয়ে উঠেছে!”
-“তুমি শেষমেশ আমাকে ছেড়ে এসে এসব সরাচ্ছ?”
-“কী করব সুরথ! তোমার সংস্রবে যেসব আছে, ওগুলো তো আর সরাতে সাহস পেলাম না! এ জীবনে হয়ত সে সুযোগ আর হবেও না! অতএব অগত্যা...!”
-“সবকিছু নিজের নিয়মে সরে গেছে পৌরি! বিশ্বাস করো!”
-“আর তোমার অস্থিরতা?”
আমি বুক-পকেট থেকে একখানি কাগজ বের করে ওর সামনে ধরতেই পৌরি খলখল করে হেসে উঠল, “কী ওটা সুরথ? আমাদের বিচ্ছেদপত্র?”
-“না। আমাদের সংসারের নতুন সনদ!”
পৌরি আমার বুকের ওপরে ঝুঁকে পড়ল, “কোই পড়ে শোনাও দেখি, সংসারে কী কী নতুন প্রকল্প আনতে পেরেছ!”
এমনসময় ঝোরার মুখে এসে দাঁড়াল একটি মেয়ে। পায়ে মোটা মল। বেণীতে পারিজাত। চোখ দুটোর স্বচ্ছতা ঠিক যেন শৈল ছাওয়া সরোবরের মতো। সূর্য এখন অস্তগামী। সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে উঠল, “এখনো তালের মুখ বন্ধ করনি? আজ ভানুভাই কিন্তু এর কারণ জানতে চাইবেন!”
পৌরি ওকে হাত নেড়ে কী যেন একটা সংকেত পাঠাল। সাথে সাথে মেয়েটি ঝোরার মুখ থেকে সরে দাঁড়াল।
পলকে মেঘের আড়ালে মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “মেয়েটি কে?”
-“ওর নাম সাম্বা। আমাদের ফার্মেই থাকে। খুব ভালো ফুল ফোটে ওই হাতে!”
-“কী ফুল?”
-“শীতল সূর্যের সাথে আপন অভিমান মিশিয়ে দিতে দিতে পৌরি বলল, “কী আবার! স্বর্গের ফুল। দেখলে না ওর বেণীতে কী অপূর্ব এক পারিজাত দুলছিল!”
আমি কথা ঘুরিয়ে দিলাম, “আচ্ছা, পাথরগুলো তুমি সরাও কেন? অন্য কেউ...?”
-“এটা দেবী সরোবর! এই পাহাড়ের একমাত্র পবিত্র তাল। দেবতারা রোজ রাতে জল নিতে আসেন এই সরোবরে।”
-“আমার সারা শরীর শিরশির করে উঠল, “সত্যি? দেবতার দল স্বয়ং স্বর্গ থেকে এখানে...? তুমি নিজে কোনোদিন দেখেছ?”
-“না। ভানুভাই বলেন। তিনিও নাকি তাঁর পূর্বপুরুষের মুখ থেকে শুনে আসছেন। আগে ভানুভাইএর মা সরাতেন। উনি দেহ রেখেছেন। এরপর আমিই...!”
আমি ওর হাত দুখানি বুকের মধ্যে টেনে নিলাম, “তুমি আমাকে ক্ষমা করো!”
-“এমা কেন?”
-“শুদ্ধ-আত্মা সন্তরা যে আসন পান না, তুমি তাই পেয়েছ! অথচ আমি তোমাকে সেইভাবে চিনতে পারিনি!”
-“এ আর এমন কী! ছাড়ো ওসব কথা। কোই পড়ো দেখি, পাল্টে যাওয়া পৃথিবীকে কীভাবে সাজাতে চাইছ।”
সহসা তুহিন কুচির সাথে কুয়াশা মিশে দিনের আলো অল্প হয়ে এল। লেখার অক্ষরগুলো সব কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠল। পড়তে পারলাম না। অতএব নিজের মতো করে আমাদের আখ্যান শোনাতে শুরু করলাম, “সমতলে এখন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। কী যেন এক অলিখিত অর্ডার এল। আর চোখের পলকে মানুষগুলো কেমন যেন পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ হয়ে উড়ে গেল! কেউ কাঁদল না। শোক-বিহ্বল হল না। পথ আগলে দাঁড়াল না। কারোর জন্যে কেউ অপেক্ষা করল না। শুধুমাত্র দুয়েকবার কাশল, আহা উঁহু করল, আর চলে গেল! এখন যারা আছেন, প্রত্যেকেই প্রায় দেবতার আসনে আসীন। সকলেরই কমবেশি সাজানো ঘরদোর, পরিপাটি রাস্তাঘাট আর অফুরন্ত অবসর!”
-“কেমন যেন ওয়েব সিরিজের মতো শুনতে লাগছে তাইনা?”
-“কিন্তু এটাই সত্য!”
-“আর অসুয়ারা? ওরাও কি উঠে গেল?”
-“কোন অসুয়াদের কথা বলছ?”
-“তোমাদের কলতলায় যারা রোজ আঁশটে ফেলে অশান্তি করত! এছাড়াও পান্তাদের পানের বরজের পাশ দিয়ে সদর যাবার যে কাঁকর বিছানো পথটা ছিল, ওটার খবর কী?”
-“নেই নেই। কেউ নেই। কিচ্ছু নেই!”
-“তাহলে বলছ কেবলমাত্র মূর্খরাই মরে গেল? চাপাতির দোকান, শান-ঘর, পার্টি অফিস, বারুদ-ফ্যাকটরি এসব সব উঠে গেছে?”
-“বললাম তো কিচ্ছু নেই। এমনকি পাপীদের হাতগুলোও কেউ কেউ নাকি সার্জারির সাহায্যে পেলব করে নিচ্ছে!”
নতুন আখ্যানের আবেশে পৌরির চোখদুটো মুদে আসছিল। আমি ওকে জাগিয়ে দিয়ে বললাম, “এদ্দুর এলে কীকরে?”
-“আর কয়েক ক্রোশ উপরে গেলেই গঙ্গোত্রী। জাহ্নবীর কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারবে তিনি এত উঁচুতে কীকরে পৌঁছলেন?”
মাঝে মাঝে উল্কাপাত আর তারাদের জ্বলে ওঠা দেখতে দেখতে আমিও কেমন জুড়িয়ে আসছিলাম। একবার মনে হল যাই সাম্বা কোথায় থাকে দেখে আসি। বেচারা শীতে নিশ্চয়ই একা কষ্ট পাচ্ছে! পরক্ষণেই আবার মনে হল, তালের মুখের পাথরগুলো সরিয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু না। পা তুলতেই পারলাম না। দেখলাম জমে যাচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে পৌরির চোখে চোখ রাখলাম, “এখন কী হবে?”
-“কিচ্ছু হবেনা। অপেক্ষা করো, সূর্য উঠলে সব গলে যাবে।”
পৌরি বাঁ হাতখানি আমার হাতের মধ্যে গুঁজে দিল। আমি ঘষে ঘষে নিজেকে উত্তপ্ত করতে লাগলাম, “এই তো তুমি আমাকে ভালোবাসো! তাহলে আমাকে ছেড়ে এলে কেন পরশ?”
-“তোমার চারপাশটা বড্ড কদর্য! মৃত্যু আর মহামারীতে ভরা! এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যেখানে গা খুলে স্নান করা যায়! একফালি উঠোন পর্যন্ত নেই যেখানে পিঠে রোদ মাখিয়ে নিশ্চিন্তে এলিয়ে পড়া যায়! যেদিকে তাকাই শুধু দ্রোহ আর সন্তাপ। ঈর্ষা আর অহেতুক উল্লাস!”
“এগুলোই তো আবাহমান কাল ধরে বয়ে আসা ব্যবস্থাপত্র। না মেনে উপায় কী বলো!”
-“আমি মানি না! আমি যদি তোমার সংসারের কল্যাণী হই, তাহলে পুরুষ হিসেবে তোমাদেরও কিছু কর্তব্য থাকা উচিত!”
-“তাহলে বলো এখন আমাকে কী করতে হবে?”
-“এসব বালাই সরিয়ে দেবে!”
-“তা কী করে সম্ভব?”
-“সবই সম্ভব। গুদামের পোকায়-কাটা চাল যদি রাতের অন্ধকারে সাগরে ফেলে দেওয়া যায়, মাঠে জমে থাকা অবাঞ্ছিত খড়ের গুদামে যদি আগুন লাগিয়ে দেওয়া যায়, ইটের দেওয়ালে আটকে রাখা টাকা ইডি যদি উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে এগুলো কেন সরানো যাবেনা?”
-“আমি যদি তোমাকে অন্য কিছু দিই?”
-“কী দেবে? সাগর? সেখানেও তো মুঠো মুঠো নুন থাকবে। উদ্যান দিলে, সেখানেও কুসুমের বদলে কেয়ারি করা কাঁটাকুঞ্জের প্রতি তোমার আগ্রহ থাকবে! সাহিত্য শোনাবে? সেখানেও তো ক্ষিদে আর ক্ষিদে! আর সঙ্গীতের দোহাই দিয়ে কর্ণকুহরে পুরে দেবে বিষাদের স্বর! আমার জন্যে কী বা এমন অভিনব উপাচার থাকবে তোমার আলয়ে?”
-“তুমি কি মনে কর এখানে অসুন্দর নেই?”
এবার পৌরি উঁচু উঁচু টিলার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে উঠল, “আছে, এই উলম্ব পাথরগুলো। কিন্তু এসবও যখন অসহ্য হয়ে ওঠে, প্রকৃতি নিজেই বরফের চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়!”   
-“আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসছে! পারলে একটু আগুন জ্বালো!”
এবার পৌরি ওর ঠোঁটদুটো আমার ঠোঁটে রাখল! মুহূর্তে তুষার ঝড় শুরু হল। এলোমেলো মেঘের সাথে উড়ে আসতে লাগল গোলাপী এজেলিয়ার পাপড়ি!
মাঝে মাঝে সরোবরে ঘাইমারা শব্দ উত্থিত হয়। আমি চমকে উঠি, “কে কে এল? সাম্বা নিশ্চই?”
-“চুপ সুরথ! কথা বলো না!”
-“ওই দেখো নীল চোখ। লেবুর কোয়ার মতো কোমর। বেণীতে সেই পারিজাত! ও নিশ্চয়ই সাম্বা!”
-“মরণ! সাম্বা কেন হতে যাবে! হয়ত স্বর্গের দেবতা!”
আমি ওর হাতখানি আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম, “বলো না সাম্বা কে? কী ওর পরিচয়?”
-“ভানুভাই বলেন, কৈলাশ থেকে কে যেন ওকে এই দেবী সরোবরে ফেলে রেখে গিয়েছিল। ওর কুষ্টিতে লেখা ছিল স্বর্গের শেষ স্বয়ম্বরা! কিন্তু সেটা সমতলের পুরুষের সাথেই হতে হবে। সেই ভাবেই ভানুভাই ওকে কোলেপিঠে করে বড় করে তুলেছেন! তবে ওর জন্যে ওপরে আলাদা ঘরও করে দিয়েছেন ভানুভাই।”
-“তাহলে সাম্বাই তো পাথর সরানোর কাজটা করতে পারে!”
-“কী যে বল না! ও কেন সরাতে যাবে? স্বর্গের দেবীকে কি কেউ দাসী করে নাকি?”
পৌরির কথা শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলাম। কখন যে চোখের পাতাজোড়া এক হয়ে এল বুঝতে পারলাম না।

যখন জেগে উঠলাম, দেখি দুটো নীল গাইয়ের পিঠে কিছু মালপত্র চাপিয়ে ভানুভাই নিজেই নিচে নেমে এসেছেন। আমি করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, “আপনিই কি তাহলে ভানুভাই? কাল রাতেই শুনেছি আপনার কথা। ইচ্ছা ছিল সকাল হলেই আপনার সাথে সাক্ষাৎ করব। যাইহোক আপনি নিজেই এলেন যখন, নমস্কার নেবেন।”
-“হ্যাঁ তুমিও আমার আশীর্বাদ নিও। কাল সাম্বার মুখে শুনলাম, তুমি তোমার পৌরিকে ফিরিয়ে নিতে এসেছ। এখানে কিছু গুঁড়ো দুধ আছে। কয়েক কিলো বাদাম, ন্যাশপাতি, আর সামান্য কিছু কেশর আছে। পথের পথ্য আছে। আশাকরি কোনো অসুবিধে হবে না।”
পৌরি ভানুভাইকে প্রণাম করতে গিয়ে কোকিয়ে কেঁদে উঠল। সাম্বা ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে সেও বাকি বেদনাটুকু নিংড়ে দিল! দুজনেই কিছুক্ষণের জন্যে উষ্ণ প্রস্রবণে ভাসল! এরপর সাম্বা পৌরির কাছ থেকে কালো কলসটি নিয়ে নিল।

এখন পৌরিকে নিয়ে আমি নিচে নামছি। হঠাৎ পৌরি ওয়াক থুঃ করে ঠেলে উঠল, “কী ওগুলো?”
-“দেখছ না শুকর!”
-“গায়ে মুখে গু মেখে রাস্তার ওপর দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে মা গো! কেউ কিছু বলছে না কেন?”
পৌরি একটুখানি হাঁটে তো অনেকখানি বসে। বসলে আর উঠতে চায় না।
-“কী হল ওঠো!”
পৌরি পায়ের পাতা চেপে চুপ করে থাকে। দেখি ওর পায়ের পাতাজুড়ে চাকাচাকা ক্ষত!
-“ইস! এইটুকু হেঁটেই পায়ে এতটা ফোসকা পড়ে গেল?”
আমি শীতল জলে ন্যাকড়া ডুবিয়ে চেপে ধরি। পৌরি আমার হাতখাদুটো চেপে ধরে। এবার ওকে ঊরুর ওপর রেখে একটা পান্থশালায় গিয়ে বসলাম। আর তখনই পান্থশালার পাশে এসে সার দিয়ে দাঁড়াল শহরের মুর্দো বোঝাই ট্রাক। পৌরি হাহাকার করে ওঠে, “মা গো! এই যে বললে মরণ থেমে গেছে? এঁদের তবে এমন হল কেন?”
তখনো আমি ওর চোখ চেপে ধরি। এর মধ্যেই একদিন একটা গাই দড়ি ছিঁড়ে দৌড় দিল। মানুষের ঘর-গেরস্থালি, হাট-বাজার, মাছির মতো মানুষের ভনভনানি, এসব তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। পেলাম না। অবশেষ পৌরিকে যেদিন বাড়ি এনে তুললাম, ওর গায়ে তখন ধুম জ্বর!

এখন ঘর অন্ধকার করে দিয়ে পৌরি কাতরায়, “এহ! এই অল্প ক’দিনেই আমি এত কুৎসিত হয়ে গেলাম কীকরে? মোটা কালো কাপড় দিয়ে আমাকে মুড়ে রেখেছ কেন?”
-“কোথায় মোটা? সামান্য আব্রু! এটুকুও রাখবে না?”
-“আমাকে কোথায় এনে তুললে সুরথ? এটা কি আফগানিস্থান?”
-“আফগানিস্থান হতে যাবে কেন? এই দেখো সেই কালিপড়া কুলুঙ্গি, দেওয়ালের ওপরে স্বস্তিক চিহ্ন! কিছুই কি মনে করতে পারছ না পরশ?”
-“সারা গা জ্বলে যাচ্ছে সুরথ! আরেকটু আলগা করে দাও। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!”
-“এসব মোটা মোটা চাদর তো তুমিই দিয়ে রেখেছ!”
-“কী করব! বাইরের দিকে তাকাতে পারছি না! এত আবর্জনার মধ্যে বাঁচ কীকরে?”
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই, “কোই আমি তো কিছুই দেখছি না! কে আবর্জনা? কাদের আবর্জনা বলছ পরশ?”
সকালে পান্তার মা আসে। পৌরিকে দেখে যায়। বিছানার তলায় নিমপাতা রেখে যায়। পৌরি ছটফট করে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নীল গাইটা ঘনঘন কান ঝাড়া দেয়। ওর গায়ের পশমগুলোও কেমন যেন ঝলসানো শনের মতো হয়ে এসেছে। চোখের কোন দুটো ভিজে থাকে সারাক্ষণ। আমি দুধের সাথে কেশর গুলে পৌরির পাশে এসে বসি। পৌরি মুখ সরিয়ে নেয়। এর পরিবর্তে সে সারাক্ষণ কল ছেড়ে গা ভিজোয়। চৈত্র দিনের ঘূর্ণির মতো ছুটে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। মরা পচা দেহ দেখে ওয়াক থুঃ করে উঠে আসে।
পৌরি কিছুই খাচ্ছে না দেখে ভাবি, ইস! এত দামী জাফরানটুকু শুধুশুধু নষ্ট করে কী লাভ? অতএব আমিই খাই! এখন সময় না কাটলে, শুয়ে শুয়ে বাদাম চেবাই। কমলা লেবুর কোয়া চুষি। আর ঠিক এই সময় সাম্বার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ওর ওই পাহাড়ি লতার মতো বেণীর কথা, বেণীতে জড়িয়ে রাখা অপূর্ব পারিজাতের কথা! কখনো বা চুপি চুপি উঠে গোয়ালে যাই। গাইটার তলপেটে হাত বুলাই। বাটে হাত দিই। বাটগুলো কেমন যেন শুকনো খেজুরের মতো হয়ে আছে! তবে কেন দিল এমন গাই?  ভানুভাইএর কথা ভেবে মাথাটা গরম হয়ে ওঠে!

ইদানিং গা খুলে ঘাটের জলে নামতে পারিনা। পাড়ার মেয়েরা জল ছিটিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে! সেলুনে গেলে নাপিত সেও নাক টিপে মশকরা করে, “বয়েস তো একেবারে একুশে নামিয়ে এনেছেন দাদা। এত রঙ আসছে কোত্থেকে শুনি?”
পান্তার মা সেও সকালে বাসি ফ্যানের গামলা হাতে করে আমার দিকে এক নিরিখে চেয়ে থাকে। কোনোদিন বা গাইটাকে গুঁতো মেরে কথা চেলে দেয়, “দুধ কি একাই খাওয়াস তোর মনিবকে? ডালিমের মতো ফেটে পড়ছে!”
আমি লজ্জা ঢেকে বলি, “কী যে বল না কাকিমা!”
-“মিথ্যে কি বলেছি? পৌরির শ্বাস উঠেছে শুনেছ?”
আমি হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকি, “পরশ, কী হল তোমার?”
পৌরি শুকনো ঠোঁটদুটো ফাঁক করে দেয়। জল এনে ধরি। ওর চোখের কোণা ভিজে!
-“কী হল খাও!”
ততক্ষণে পৌরির কলসের কথা পাঁচকান হয়ে গেছে। পান্তার মা জিজ্ঞাসা করে, “কলসটা নুকিয়ে রেখেছ কেন বাপু? বার করো। পুড়ার কন্ঠিতে পড়ুক একফোঁটা!”
প্রতিবেশীরা সমস্বরে জিজ্ঞাসা করে, “কী কলস গো খুড়ি?”
-“সে এক আশ্চর্যি কলস গো!”
পৌরি অস্থির হয়ে গড়াগড়ি খায়, “কোথায় আমার কলস? ওই তো গড়িয়ে যাচ্ছে ধরো। বরফে ঢেকে গেলে আর খুঁজে পাবেনা। ধরো সুরথ ধরো!”
সেদিন শিথানে অনেক লোক। পৌরি তখনো সমানে প্রলাপ বকে চলেছে।
আমি পান্তার মা’কে অনুরোধ করলাম, “কাকিমা ওকে চোখে চোখে রেখো। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব!”

খানিকটা দৌড়ে, খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা বাদুড়ের মতো উড়ে অবশেষ পৌঁছলাম সাম্বাদের দেশে। কিন্তু কোথায় সেই সেই সরোবর? কোথায় সেই সিঁড়ি? যেখানে বসে সবাইকে জল ভাগ করে দিত পৌরি! হঠাৎ নজরে এল অনেকগুলো মেয়ে। মন্থকুপের মতো ছোট্ট একটা গর্তের চারপাশে ওরা হাতে হাত বেঁধে বর্তুলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন সম্ভবত ফাগুন পূর্ণিমা। প্রত্যেকের খোঁপায় লাল টুকটুকে রডোডেনড্রন গুচ্ছ! আমি এগিয়ে যেতেই ওরা আমার গা ভিজিয়ে দিল। দুজন কোমর জড়িয়ে ধরল। একজন এসে প্রসাধন করাল। ওদের লজ্জা কম। পুরুষের প্রতি আড়ষ্টতা কম। বুঝলাম ওরা আমার জন্যেই এখানে অপেক্ষা করছিল। আমিও লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেললাম, “এসব সাম্বার ষড়যন্ত্র নিশ্চয়ই?”
-“না। নিচ থেকে এসেছেন তো! তাই ধুয়ে তুলবার আদেশ এসেছে!”
-“কে আদেশ করলে শুনি?”

-“ভানুভাই। আমাদের দেবী তালের ভূষণ!”
ওরা আমাকে পথ দেখিয়ে আগে আগে চলল। পর্বতের চূড়ায় চূড়ায় তখন সূর্যের কিরণ। তাতে কাঁচা সোনার রঙ! আর সে রঙ খানিক খানিক আমার স্নানসিক্ত নগ্ন শরীরে এসেও খেলে যেতে লাগল।
গ্রামে ছোট ছোট ঘর। ঠিক যেন ঝুলিয়ে রাখা লতার ঝুড়ির মতো। আমাকে দেখেই সাম্বা বেরিয়ে এল। গায়ে মাথায় নেত্র পল্লবে ধুলো। লংকার গুঁড়োর মতো রঙ। আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, “ধুয়ে এসো। গায়ে জ্বালা দেবে তো!”
-“আপনি যেটা ভাবছেন তা নয়। এগুলো এমন এক পুরুষের পরাগ, যা পাবার জন্যে আমরা পাহাড়ের মানুষেরা জনম জনম ধরে তপস্যা করে থাকি!”
জিজ্ঞাসা করলাম, “ভানুভাই নেই না?”
-“ক্ষেতে আছে। আসবে এখুনি।”
-“কলসটা কোথায়?”
-“কোন কলস?”
-“যেটাতে করে পৌরি জল ভরে দিত!”
সাম্বা শুষ্ক সাদা হাসি উড়িয়ে দিল, “সে তো আছেই। ওই ঝোরার মুখেই হয়ত চাপা পড়ে আছে!”
আমি চমকে উঠলাম, “কেন চাপা পড়ে আছে কেন?”
-“বেঁচে আছি এই ভাগ্যের! যেদিন পৌরি নেমে গেল, ঠিক তার দুদিন বাদে গোটা দেবভূমি জুড়ে ভয়ঙ্কর ধস নামল! অনেক মানুষ মারা গেল! বহু মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেল! এখনো অব্দি ভানুভাই তাঁর কিছু আত্মীয়কে...!” বলতে বলতে সাম্বার গলা বুজে এল
আমি বললাম, “তাহলে তোমরা জল পাও কীভাবে?”
-“আরও উঁচুতে যাই! একসাথে অনেকে যাই। কমপক্ষে দুজন। সাথে পাতলা তাঁবু রাখি। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে নিই। অন্যজন তখন হাঁটা শুরু করে। কেননা কখন বরফ গলবে কেউ তো বলতে পারেনা!”
আমাদের কথার মাঝে ভানুভাই ফিরে এলেন। সাম্বা আগুনের কাংড়ি এগিয়ে দিল। এবার কোলের মধ্যে কাংড়িটা এঁটেসেটে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার সুরথ, কী মনে করে?”
আমি কলসের কথা লুকিয়ে বলে ফেললাম, “সমতলের অবস্থা খুবই শোচনীয়! সংসার চালানোই দুষ্কর! তাই ভাবলাম আপনার ক্ষেত খামারে যদি কিছু কাজ জুটে যাই...!”
-“জাফরান চাষের জন্যে ভালো জমি চাই। এখানে আজকাল আর কিছুই হচ্ছে না গো। তাছাড়া স্বর্গের দুয়ার সবদিক দিয়ে যদি এমন আটকানো থাকে, তাহলে কি আর হয় গো?”
আমাদের গল্পের মাঝে একসময় অন্ধকার নেমে এল।

আজকাল পৌরির মুখখানা আর মনেই পড়েনা! পান্তার মা’কে যে ওর শিয়রে বসিয়ে রেখে এসেছিলাম,  শুধুমাত্র সেটুকুই মনে আছে। সকাল হলে সাম্বার সাথে ক্ষেতে যাই। ক্ষেত বলতে কুচো পাথর মেশানো ছোট ছোট ম্যাল। কেউ গান গায়। কেউ গাইতি মারে। আমি শুধু সাম্বাকে সামনে রেখে চুপড়ি ভরে ফুল তুলি। চিরতা আসে। আলম আসে। আর সরোবরের ওপার থেকে আসে সান্তাকুয়া। সকলেই সাম্বার সম বয়েসী। এখানে রৌদ্র পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সাম্বা ছোট্ট একটা চালার নিচে বসে মেঘেদের আনাগোনা মাপে। আর চুপড়ি ভর্তি বেগুনী ফুল থেকে একটা একটা করে পুরুষ শীর্ষ বেছে আলাদা করে শুকোতে দেয়। এখানে কাজ বলতে শুধু সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি ফুল তোলা। আর সপ্তাহান্তে ঝারিতে করে জল ছেটানো। একটানা কুঁজো হয়ে ফুল তুলতে তুলতে আমার পিঠে খিঁচ ধরে। হাঁটুর মালাইচাকি মচমচ করে ওঠে! সাময়িক আরোগ্য চেয়ে ছুটে সাম্বার কাছে যাই। তখনো দেখি সাম্বা বেগুনী পাপড়ির মধ্যে থেকে একটা একটা করে শুক্র-সুতো বার করছে। আমি অস্থির হয়ে উঠি, “এত ধৈর্য কোথায় পাও সাম্বা? দিনরাত এক করে এই যে সরু সুতোর মধ্যে ডুবে আছ! অস্বস্তি হয় না?”
সাম্বার গোলাপি গালদুটো আরও রাঙা হয়ে ওঠে, “কোই না!”
-“আমার কিন্তু এত সরু কাজে মন সায় দিচ্ছে না!”
-“তাহলে কাল থেকে পাথর সরাতে যাবেন। ভানুভাইকে বলে দেব। চাইলে আপনি চিরতার সাথেও যেতে পারেন।”
-“চিরতা তো মেয়ে। ও পাথর সরাতেও পারে?”
-“এখানে সবাইকে সবকিছু করতে হয়। নারী ও পুরুষের জন্যে আলাদা কোনো কাজ নেই। আমি নিজেও তো যাই। কেননা জল না পেলে চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে। তাছাড়া দেবতার দ্বার, একদিন না একদিন ওকে মুক্ত করতেই হবে।  

ভানুভাইএর অনুমতি নিয়ে চিরতার দলে ভিড়ে গেলাম। এখন রোজ পালা করে পাথর সরাই। আমার সামর্থ আর উদ্দীপনা দেখে চিরতা অবাক হয়। পাহাড়ে কত কত ফুল, কতশত পাখি! কতশত বাহারি লতা! চিরতা রোজ একটা করে আমাকে উপহার দেয়। ওদের আদি অবস্থানের গল্প শোনায়। ভুলে গেলে ভর্ৎসনাও করে।
আমি জিজ্ঞেস করি, “আচ্ছা চিরতা, “পারিজাত কোন পাহাড়ে ফোটে গো?”
-“সে তো আমি জানিনা। হয়ত সাম্বা জানে!”
-“সাম্বা জানে। আর তুমি বলছ জান না? কেন?”
-“ও তো দেবতার মেয়ে! আমি পারিজাতের নাগাল পাব কেন?”
-“সত্যিই সাম্বা দেবতার মেয়ে?”
-“সবাই তো তাই বলে! বিশ্বাস না হলে ভানুভাইকে জিজ্ঞেস করো!”

আজ সন্ধ্যেবেলা যখন পাথর সরিয়ে ফিরেছিলাম, সাম্বা একগ্লাস গোলাপী জুস দিয়েছিল। এখন দিল অল্প একটু মদ। সাথে মোমোর মতো দলা পাকানো ভাত। গ্লাসটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘোলাচ্ছিলাম। সাম্বা একটুখানি হাসল। সে হাসিতে কেমন যেন একটুখানি আতর মাখানো ছিল!
-“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?” ভানুভাই আমার গ্লাসের সাথে ওঁর পাত্রটি ঠোকা দিয়ে জানতে চাইলেন।
-“এতদিনে পৌরির পুরোটাই পচে গলে ভূত হয়ে গেছে নিশ্চয়ই?”
আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম, “মানে?”
-“বলছি তো সাম্বাকে পেলে তোমার সমতলেও ফুল ফুটবে! আগামি কাল সন্ধ্যায় সাম্বার স্বয়ম্বর। তোমার কি কিছু বলার আছে?”
আমি আবিষ্ট হয়ে পড়লাম, “আপনি বলছেন?”
-“বললাম তো! চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারো!”
সে রাতে আর দুই চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। সাম্বার স্বয়ম্বর! মেঘ পাহাড়ের ওপার থেকে কত না জানি পাত্র আসবে। সাম্বা অনেক বুঝেশুনে শেষমেশ আমার গলায় মালা দেবে! সাম্বা আমার সাথে সমতলে যাবে। পথের দুপাশ দিয়ে বীজ ছড়াতে ছড়াতে যাব! আমার কাঙ্ক্ষিত কুঞ্জে কুঞ্জে ফুল ফুটবে। পথের বাঁকেই একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। ঝিল্লিরা জয়ধ্বনি দেবে! রাত্রি গভীর হলে ডাহুক ডাকবে! বনের পাখপাখালি একসাথে জেগে উঠে দেখবে, গাছেদের শাখায় শাখায় পারিজাত আর পারিজাত!

সকাল হতে না হতে ভানুভাই তাঁর খামারে সব্বাইকে ডেকে পাঠালেন। আমরা যারা পাথর শ্রমিক, সময়ের আগে প্রায় সবাই এলাম। অন্যদিনের চাইতে আজ মেঘ বেশি। সাম্বা যেখানে বসে কেশর শুকোয়, ওই ছোট্ট চালাটার চটায় একটা মালা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। দূর থেকে মনে হবে ওটা ডাফোডিল দিয়ে গাঁথা। ওটাই কি তাহলে বরমালা? আমি দূর পাহাড়ের তুহিন-শুভ্র মুকুটের দিকে চেয়ে থেকে মুহুর্মুহু রোমাঞ্চ অনুভব করতে লাগলাম! বাকি যারা বরবেশে উপস্থিত হয়েছে, প্রত্যেকেরই হাতে একখান করে ঝারি আর পাথর ঠেলবার গাইতি। শুধু আমার কাঁধে ছিল একটা সাদা সুতোর উত্তরীয়। যেটা আমি সমতলের সাক্ষ্য স্বরূপ সবসময় সাথে রাখি। কিন্তু সাম্বা কোথায়? ও আসছে না দেখে আমার কেমন যেন অস্থিরতা বেড়ে গেল। কেউ বলল, “ও তো দেবীতালে গেছে!”
কেউ বলল, “গোমুখের কাছে সেদিন ওকে গোমড়া মুখে বসে থাকতে দেখলাম।”
এবার আগত অনেকের মধ্যেই একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, “সাম্বার জন্ম পরিচয়ে সাম্বা নিজেও হয়ত সন্তুষ্ট নয়! আর যাইহোক, সেও একজন নারী তো! এতদিনে দেবতা দানব যে কেউ একজন ওর  সামনে এসে যদি বলত, আমি তোর জন্মদাতা পিতা! নিজেকে নিয়ে হয়ত সাম্বা এতটা সময় অপচয় করত না!”
এবার মেঘমুলুকে মুহুর্মুহু গর্জন উত্থিত হতে লাগল, “এতবড় দুঃসাহস! সাম্বাকে কোথায় রেখেছ বলো? আমার হাত থেকে তোমরা কেউ নিস্তার পাবেনা!”  
আমি নতমস্তকে ভানুভাইএর সামনে দাঁড়ালাম, “বিশ্বাস করুন, আমি সাম্বাকে হত্যা করিনি!”
-“বিশ্বাস করলাম! আর কিছু?”
-“পারিজাত কোথায় কোন পাহাড়ে ফোটে বলবেন?”
আমার কথা শুনে উপস্থিত সকলেই মেঘগর্জনের মতো হোহো করে হেসে উঠল!
-“যাও। আমরা এইখানেই অপেক্ষা করব। সাম্বাকে সশরীরে এনে হাজির করো!”
আমি ওল্টানো ঘটির মতো গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নামতে লাগলাম।

কুয়াশার মধ্যে কোথায় যে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিলাম, মনে নেই! তখন মাঝরাত। হঠাৎ জলের শব্দে থমকে দাঁড়ালাম! পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। হ্যাঁ আমার অনুমান ব্যর্থ নয়, তালের দিক থেকেই আসছে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই নজরে এল দুটো গাই! ওরা একত্রে মিলে একটা বাছুরের গা থেকে চেটে চেটে বরফ সরাচ্ছে। জলের সাথে এমন সব মিশ্র মুখরা ভেসে আসতে লাগল মনে হল মানুষ আছে। আমি চিৎকার করে উঠলাম, “কে? কে ওখানে?”
উত্তর এল না। ততক্ষণে জলের গতি আরও বেড়ে গেছে।

এবার আমি সাদা সিংহের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে তালের মুখে এগিয়ে গেলাম।
দেখলাম সাম্বা! একটা কুৎসিত কদাকার মহিলাকে ঝর্নার নিচে বসিয়ে, কলসির পরে কলসি জল ঢেলে স্নান করাচ্ছে!
-“কে উনি?”
-“চিনতে পারছেন না? উনি তো দেবতার দাসী!”
আমি ওর হাত থেকে হ্যাঁচকাটানে কলসটা ছিনিয়ে নিলাম, “কী যা তা বলছ!”
-“এই কলসটা আপনি নিতে এসেছিলেন তাই না?”
-“আমি এমন কলস নিয়ে কী করব?”
-“আরেকটু অপেক্ষা করুন।”
আমার হাত থেকে কলসটা নিয়ে সাম্বা এবার ঝোপের আড়ালে গেল।
আমি ক্রমশ অথর্ব হয়ে উঠতে লাগলাম, সাম্বা ওই যে কঙ্কালসার মহিলাটিকে বসিয়ে রেখে গেল, সে মোটেও আমাকে দেখে বিচলিত বোধ করছে না কেন? তাহলে এরা কারা? অশরীরী কেউ?
এবার আমি ওর অতিপ্রাকৃত আচরণগুলোকে এক দড়িতে বাঁধব বলে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
প্রথমে সে তার পায়ের পাতা দুটোয় অনেকক্ষণ ধরে জলের ধারানি দিল। এরপর পাথরের গা থেকে নরম লতা ছিঁড়ে নিয়ে, ঘাড় পিঠ জঙ্ঘা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করল। বেণীর জট ছাড়িয়ে তাতে জল দিল। তারপর পরনের মোটা পুরু ভিজে কাপড়টা মুঠো পাকিয়ে আমার মুখের ওপর যখন ছুঁড়ে মারল, আমিও চটাচট চাবুক চালিয়ে দিলাম, “তুমি পৌরি না? কী হল কথা বলছ না কেন?”
কিছুতেই সে কথা বলল না। আপন খেয়ালে সিঁড়ির ধাপ গুনতে লাগল।
সাম্বা যখন ফিরে এল, তখন পূর্ব দিকে পাহাড়ের গায়ে সবে কুসুম কুসুম আভা ফুটতে শুরু করেছে।
-“কলস নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে সাম্বা?”
সাম্বা কলসটা সামান্য কাৎ করল। দেখলাম কলসের কানায় কানায় দুধ ছলকাচ্ছে!
এবার একটা মোড়ক খুলে সাম্বা ওই দুধের মধ্যে কী যেন মিশিয়ে দিল। জাফরানি ধারায় ওর ওই নগ্ন শীর্ণ শরীরটাকে আরও একবার আচ্ছাকরে ধুয়ে নিল। চোখের কোটরে কাজল পরালো। কুমকুম দিল। সব শেষে সাম্বা তার বেণী থেকে পারিজাতটা খসিয়ে ওর খোঁপায় গুঁজে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করল,“এবার চিনতে পারেছেন নিশ্চয়ই?”
-“ও এখানে কীকরে এল?”
-“সে আমি কী জানি! আজ ওঁর স্বয়ম্বর! নিয়ে যান।”
আমি সড়াৎ করে সরে দাঁড়ালাম, “আমি একে কেন নেব?”
-“সবাই ওর জন্যে অপেক্ষা করছেন! তা নইলে সূর্য উঠে গেলে ভানুভাই কিন্তু আপনাকে হত্যা করবেন!”
আমি বরফের বার্খান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম!




1 টি মন্তব্য:

  1. সাদা লাভার সিঁড়িঃ স্বর্গের একটি পারিজাতের গল্প
    ********************************************

    অনুরোধ এসেছিল বেশ কয়েকটি দিন আগে কিন্তু পরীক্ষার খাতা দেখা,প্রশ্নপত্র নির্মাণ করা ইত্যাদি ব্যস্ততার কারণে সে অনুরোধ রক্ষা করতে পারিনি।তাছাড়া সাহিত্য সরোবরের কোন বড় মাপের রাজহংসও আমি নই।তবু কোন্ বিশ্বাসে গল্পকার উত্তম বিশ্বাস তাঁর লেখা একটি বিশেষ গল্পের উপর আমার অভিমত জানতে চেয়ে আমাকে কৃতার্থ করলেন,সত্যিই আমি তা জানিনা!

    গল্পের নাম 'সাদা লাভার সিঁড়ি'— নামকরণের প্রথম দর্শনে পাঠক আদিরসাত্মক আঁশটে গন্ধের ঝাঁঝালো স্পর্শ অনুভব করতে পারেন।তাতে দোষের কিছু দেখি না।মাটির নিচ থেকে যে খনিজ উত্তোলিত হয়,তাকে বিভিন্ন মাত্রায় পরিশ্রুত করে তবে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়।এ গল্পের বিষয়বস্তুর আপেক্ষিকতা অনেকটা সেরকম।পাঠক যদি হৃদয় নামক ফিল্টার যন্ত্রের দ্বারা সে বিষয়বস্তুর ভাবসত্যকে বিশেষভাবে নিষ্কাশন করে নিতে না পারেন তবে এ গল্পের মূল তত্ত্বকথা তাঁর কাছে অব্যবহার্যই থেকে যাবে।

    'সাদা লাভার সিঁড়ি'— গল্পটি পড়তে গেলে পাঠকে বেশ কয়েকটি ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে।কেননা এ গল্পের কাহিনীতে আপাত তরলতা বলে কিছু নেই।গল্পের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ বক্তব্য ও ভাব প্রধান।অথচ চরিত্ররা কেউ কলের পুতুলও নয়।আসলে লেখক এমন সুগভীর আন্তরিকতায় প্রতিটি চরিত্রের মুখে আপনার হৃদয়ের ভাষাকে প্রতিস্থাপিত করে দিয়েছেন যে,কাউকে অসংলগ্ন মনে হয় না।বর্তমান কালের বেশিরভাগ গল্পের বিষয়বস্তুর প্রকাশভঙ্গীমাগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ গল্প সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

    এ গল্পের বিষয়বস্তু সত্যিই যেন অপার্থিব, অনিন্দ্য,অসংলগ্ন অথচ স্পষ্ট,এককথায় ইডি মিডিয়া মড়ক ও মনোবিকলনশূন্য।গল্পের প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়েছে নানা কলুষ-কলঙ্কে জর্জরিত সমতলের ত্রিসীমানা ছাড়িয়ে তুহিন শুভ্র পর্বতের সুউচ্চ শিলা তটে,যেখানে স্বয়ং ঈশ্বর আপনার হাতে নির্মাণ করে রেখেছেন আদি এবং অকৃত্রিম গল্পের আঁতুড়ঘর।পাহাড়ে বসবাসকারী দেবতার মেয়ে সাম্বা কিম্বা 'দেবীতালের ভূষণ' ভানুভাই সে ঘরকে নিরন্তর পবিত্রতার কর্মাঞ্জলি দিয়ে শুচিশুভ্র করে রাখে।তাইভএখানকার প্রত্যেকটি পাথরের আল পর্যন্ত যেন এক একটা 'সাদা বরফের আরুণী'।

    সুরথ আর তার মানসী পৌরীর পারস্পরিক জীবন-জিজ্ঞাসা'ই এ গল্পের মূল ভাববস্তু।সুরথ আর পৌরী একই পৃথিবীতে থেকেও যেন দুই ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা।সমতল আজ বড্ড কলুষিত,নানা পাপ-পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন।পৌরী তাই সমতলের স্পর্শ এড়িয়ে দেবতার মেয়ে সাম্বার মতো হতে চেয়েছিল কিম্বা তার উত্তরসূরী।পাহাড় তাকে আপন করে নিতে চাইলেও সমতলের দুর্নিরোধ্য আকর্ষণে তাকে নেমে আসতে হয়।যেখানে পাপীরা এখন তাদের পাপ-কদর্য হাতগুলোকে সার্জারীর মাধ্যমে নিরন্তর পেলব করে নিচ্ছে।সমতলের এই কদাকার রূপ দেখে আৎকে উঠে পৌরী তার মানস-পুরুষ সুরথকে বলে ওঠে,"তোমার চারপাশটা বড্ড কদর্য!মৃত্যু আর মহামারীতে ভরা!...যেদিকে তাকাই শুধু দ্রোহ আর সন্তাপ।ঈর্ষা আর অহেতুক উল্লাস!”

    হ্যাঁ সমতল আজ সত্যি আঁশটে একটা কলতলায় পরিনত হয়ে উঠেছে,অসূয়ারা এসে সে কলতলাকে আরও বিষিয়ে তোলে।এখানকার মূর্খেরা প্রতিদিন অকারণ অশান্তিতে পরিবেশকে আচ্ছন করে দেয়।চাপাতির দোকান,শান-ঘর,পার্টি অফিস,বারুদ ফ্যাকটরি সব মূর্খদের আঁতুড়ঘরে পরিনত হয়।শুধু সুরথ নয়,সমগ্র সমতলভূমি আজ তাই নেমে গেছে একটা গহীন খাঁদে,যে খাঁদে—"এখন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই হাতে-গোনা।কী যেন এক অলিখিত অর্ডার এলো।আর চোখের পলকে মানুষগুলো কেমন যেন পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ হয়ে গেল!কেউ কাঁদল না।শোক-বিহ্বল হলো না।পথ আগলে দাঁড়ালো না।কারো জন্য কেউ অপেক্ষা করলো না।শুধুমাত্র দুএকবার কাশল,আহা উঁহু করল,আর চলে গেল!এখন যারা আছেন,তারা প্রত্যেকেই প্রায় দেবতার আসনে আসীন।সকলেরই কম-বেশি সাজানো ঘরদোর,পরিপাটি রাস্তাঘাট আর অফুরন্ত অবসর।"
    (ক্রমশ)

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র