মোনালি - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

মোনালি

 দ্রৌপদীর রক্ত-মাংস









হাপ্রস্থান সময়ে,  ব্যসদেব যখন আমায় মৃত ঘোষণা করিলেন, তখন দোহাই দিলেন, আমি ( আমার অন্তঃকরণে, অবচেতনে)  নাকি অর্জুন, তোমায় সারাজীবন বেশি ভালোবাসিয়া আসিয়াছি, সেই পাপে মরিয়াছি!  


হ্যাঁ,  ত্রিকালজ্ঞ অরণ্যচারী  ঋষির চোখে ভালোবাসা অপরাধ হইতে পারে বই কি। 


কিন্তু, ব্যসদেব তাঁহার প্রখর দৃষ্টিশক্তি সত্ত্বেও কিছুতেই আমাদিগকে ( রমণীকুল'কে)  ঠিকমতো বুঝিয়া  উঠিতে পারেন নাই।  


অথচ অস্বীকার করিতে পারি না,  অন্যান্যক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টিতে - সমাধানে - নীতিশিক্ষায় তিনি মহাভারতের একছত্র নায়ক। তোমাকে তো বটেই কৃষ্ণকেও তিনি কাহিনীর প্রয়োজনে  যথেচ্ছ ব্যবহার করিয়াছেন ।


আমি নারী-পক্ষ লইয়া কথা কহিতে চাহিতেছি না কিন্তু মহাভারতের রচয়িতা....  পুরুষ চরিত্রগুলির উত্থান পতন যতখানি উজ্জ্বল বাস্তবসম্মতভাবে লিখিতে পারিয়াছেন  নারীচরিত্রগুলিকে তেমন... পারেন নাই।  

মহাভারতে অষ্টাদশী অথবা অশীতিপর সকল নারী  আদ্যোপান্ত  ছায়াপ্রায় অশরীরী হইয়া থাকিয়া  গিয়াছে। 


জন্ম হইতে মৃত্যু অবধি তাহাদের আকার প্রকার  একরকম.... 


মাদ্রী স্বার্থান্বেষী  সুন্দরী, কুন্তী পরার্থে নিয়োজিত সংসারপ্রাণা, গান্ধারী আদর্শবতী অথচ পতিপ্রেমে অন্ধ.... এমত এক এক নির্দিষ্ট 

গন্ডীর বাহিরে চরিত্রেরা নড়িতে  চড়িতে পারেন  না। 


একই ব্রতে, একই  লক্ষ্যে স্থির থাকেন....


আমিও তেমন এক নারী । প্রথম দিন হইতে শেষ অবধি অর্জুন অনুরক্তা! 


....


অথচ, যত অভিজ্ঞতা পরিস্থিতি পদতলে রাখিয়া  এই আগুনহৃদয় আগাইয়া গিয়াছে...  স্বাভাবিক নিয়মে আমার তত বদল ঘটিয়াছে  .... ব্যসদেব নজর করিলেন নাহ!


যে আবেগ বিহ্বলিত পাঞ্চাল রাজকুমারী বীর ব্রাহ্মণের স্ত্রী রূপে শ্বশুরঘর করিতে গিয়াছিল....  দরজায় দাঁড়াইয়া তাহার পরমপ্রাপ্তি হইল - এক নহে, পাঁচ পাঁচটি স্বামী। 


পাঞ্চালীর অতীত চিন্তাধারা, অতীত আবেগ সেস্থলে, সেই মূহুর্তে... খুন হইয়াছিল 


ইহাররপর, তোমার ১২ বৎসরের অজ্ঞাত বনবাস। বহুদূর বিদেশে একা তুমি। নিকটের সংসারে অন্য চার পুরুষের মাঝে, রানী।  আমি।


তবু ওই ১২ বৎসর, কাঙ্খিত হৃদয় অনুচ্চার অপেক্ষায় নিশ্চুপ  ছিল.....


উলুপী, চিত্রাঙ্গদা'র কথা শুনিলেও তাহাদিগকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় নাই। 


হৃদয় জানিত,  তুমি নিকটে আসিলে সকল  যন্ত্রণার অবসান  হইবে। 


অপেক্ষার শেষে তুমি নিকটে ফিরিলে , নমনীয়া সুভদ্রাকে সঙ্গে লইয়া... 


নূতন গ্রন্থির বাঁধনে পুরানো গ্রন্থিসকল শিথিল হইল....

দ্রৌপদী সেই দিন নিজহস্তে নিজ-হৃদয়কে খুন করিল।


ইহার পর, আমি কখনো ওই মৃত যন্ত্রের প্রতি দৃকপাত করি নাই। 


( ব্যসদেব ইহা জানিতে পারিলে অবশ্য, এই পাপেই  আমার সুদীর্ঘ  নরকবাস সুনিশ্চিত করিতেন...) 


অভিজ্ঞতায় দ্রৌপদী বুঝিয়াছিল, শরীর ধারণ করিতে হইলে , সংসারের কল্যাণে  শরীরটিকেই  আনন্দিত ও সুরক্ষিত রাখা জরুরি.... জরুরি সন্তানাদির সুনিশ্চিত  ভবিষ্যতে  যত্নবান হওয়া , জরুরি রাজ্যলাভ....


বাকি, যাহা গিয়াছে। একেবারে গিয়াছে.... ক্ষতি নাই


কুরুক্ষেত্রের পূর্বে বিরাট রাজ্যে অজ্ঞাতবাস'কালে  সুদেষ্ণাভ্রাতা অবিবেচক কীচককে মারিতে তোমায় অনুরোধ করিতে , আমার মন উঠে  নাই।  

প্রয়োজনে  আমার সর্বস্ব দান করিয়া  ভীমকে জাগাইয়াছিলাম..... 


সে সময়ে, বিরাট - অন্তঃপুরে বৃহন্নলা এমত ব্যস্তসমস্ত থাকিত যে,  আমি প্রস্তুত হইয়াই ছিলাম, আশু এক নূতন অর্জুনপত্নী হয়তবা বরণ করিতে হইতে পারে.... 


তুমি কি তখনও হৃৎচাঞ্চল্যে ভুগিতেছিলে? না হইলে বিলাপ করিয়াছিলেই বা কেন  " কেহ কারো মন বোঝে না পাঞ্চালী " 

.... মন বুঝিবার চেষ্টা চিরকাল বিফলে গিয়াছে।   যাক

...


কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তোমার বিপদ সর্বাপেক্ষা বেশি জানিয়াছিলাম তবু এই  যুদ্ধের জন্য কৃষ্ণসহ তোমাদিগের সকলকে তেমন ক্ষেপাইয়া  তুলিতেই পারিতাম না....চঞ্চল হৃদয় জীবিত থাকিলে , কর্ণের হুঙ্কারে দমিয়া যাইত। না বাধিত যুদ্ধ, না প্রতিষ্ঠা পাইত ধর্মরাজ্য 


... একবার হৃদয় নামের বেজন্মা কীটকে মারিয়া ফেলিতে পারিলে, হারাইবার আর কিছু থাকে না --- ইহা তোমাপেক্ষা অধিক কে বা জানিবে!


....


তবে স্বীকার করিতে বাধা নাই , স্বর্গের পথে চলিতে চলিতেও  আমার দুঃখ সন্তাপ আক্রোশ মাত্রাতিরিক্তই  ছিল....বিন্দুমাত্র প্রশমিত হয় নাই


রাত্রি'র নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ঘুমিয়ে থাকা আমার  পাঁচপাঁচটি সন্তানের জীবন নিশাচর অশ্বত্থামা এমন অনায়াসে কাড়িয়া লইয়াছে !  সে  যন্ত্রণা, সে আক্রোশ ভুলিতে পারা  কি এত সহজ!!

....


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র