ঈশিতা ভাদুড়ী - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

ঈশিতা ভাদুড়ী

 বিবাহবাসর




রটা ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে। অর্ঘ্য গান ধরেছে  ফুলে ফুলে বধূ / দুলে দুলে ওলি / বাজায় সানাই / বলো না নীরব কেন / তুমি শুধু একাই... 

আরও অনেকের মতোই অর্ঘ্যও ভেবে নিয়েছে বোধহয়, বাসরঘরের এটাই একমাত্র উপযুক্ত গান। অর্ঘ্য-র গলাটা অনেকটা সুমনের মতো। বিজিতের বন্ধু। সেই সন্ধে থেকেই পাশে পাশে ঘুরঘুর করছে, দেখতে অভিষেক বচ্চন মার্কা। এরকমই কেউ কেউ এমন পেছনে পড়ে যায়, অন্য লোকেরা মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝে না, ভাবে – দোলা বুঝি মাথা খাচ্ছে ছেলেগুলোর। থার্ড ইয়ারের অজিত গুপ্ত সেই একবার এমন জ্বালাতে আরম্ভ করেছিল, বাইক নিয়ে পিছু পিছু, কতবার টিয়াদের বাড়ির সামনেও গিয়ে দাঁড়িয়ে থকতো, ঝুনুকাকিমাও সেই থেকে ছাইপাঁশ ভেবে বসেছিলেন। অর্ঘ্যও সন্ধে থেকে এমন করছে, কাজলিমাসি সন্ধেবেলা বলেই ফেললেন, চাকরি বাকরি তো ভালই করে, দোলা, লেগে যাবি নাকি?” হাসলাম। মনে মনে বললাম, না গো রুনুমাসি, আমি যে অন্য কাউকে ভাবি, সে ভাবুক না ভাবুক আমি তো ভাবি। 

গান শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো অর্ঘ্য —"কেমন গাইলাম বল্লেন না তো?"

কী মুস্কিল! এত ভিড়ের মধ্যে আমাকেই কি বোদ্ধা মনে করলো নাকি? টিয়া মুচকি হাসি ছুঁড়ে দিল। রীনা বউদিও। আমি কিন্তু যথেষ্ট বিরক্ত, মুখে অবশ্য হাসিটা রাখলাম, টিয়ার জন্যই, ওর এখন নতুন সম্পর্ক।

টিয়া আমার সেই কতদিনের বন্ধু। সেই লরেটো থেকে। আমাদের লরেটোর গ্রুপটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার। বন্দনার মা ধানবাদে বদলি হয়ে গেলেন, কল্পনা জলপাইগুড়িতে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল, রিয়া প্রেসিডেন্সিতে। বাকি রইলাম হারাধনের দুই – টিয়া আর আমি, টিয়া প্রেসিডেন্সিতে চান্স না পেয়ে সেন্ট জেভিয়ার্সে, ও খুব ভেঙে পড়েছিল তখন, আর আমার মনে হয়েছিল আমার উচিত ওর সঙ্গে থাকা। অতএব আমিও সেন্ট জেভিয়ার্সেই। কলেজে প্রথম দিন টিয়া দু-বিনুনী করে গিয়েছিল বলে কী হাসির খোরাকটাই না হয়েছিল বেচারা! প্রথম একটা মাস সর্বদাই কোনো না কোনো উপদ্রব। ওর নামগত কারণেই আমাদের পাশেপাশে প্রায় সময়ই পাখির ডাক চলতো। বিভিন্ন উপদ্রবের সঙ্গে এও আরেক। আমার ভীষণ রাগ হতো, যত্তো সব ট্র্যাশ। টিয়া বুদ্ধিমতী, বলতো "রাগিস না, দেখবি, না রাগলে থেমে যাবে।" ঠিকই বলেছিল, সত্যি সত্যিই থেমে গেল মস্করা। যে রিত্র সবচেয়ে বিরক্তির কারণ ছিল সেই রিত্র আর টিয়া মাস ঘুরতে না ঘুরতেই জুটি হয়ে গেল। আমাদের চেয়ে এক ক্লাস সিনিয়র ছিল অরিত্র। কতদিন ক্লাস না করে দুজনে ক্যান্টিনে মাঠে এদিক সেদিক। কত কতদিন ওদেরকে একে অন্যের থেকে আলাদা করে ভাবা যায় নি। আমি দোলন সান্যাল এই সব কিছুরই সাক্ষী, আজ বিজিত-টিয়ার বিবাহ-বাসরে মস্করা করছি। রুনুমাসিরা যখন তত্ত্ব সাজাচ্ছিলেন, সাহায্যও করেছি।

রুনুমাসি আর দুলালমেসো না হলে কিন্তু বিয়েবাড়িটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। টিয়ার ঠাম্মা দীপেশকাকুকে বলে যে ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে রুনুমাসিদের এই উৎসবে সামিল করেছেন, ঠিকই করেছেন। রুনুমাসি ঝুনুকাকিমাদের মধ্যে কিসের বিরোধ ছিল সেটা অবশ্য টিয়াও জানে না।

দুলালমেসো সম্প্রদানের সময় ছবি তুলছিলেন যখন, বললেন "দোলা, তোর অনেক ভাল ভাল ছবি তুলেছি, তোর বিয়ের সম্বন্ধ করা যাবে।" মনে মনে ভাবলাম, হা ঈশ্বর! আমার যে মনের মানুষ সে তো তোমার পাশেই ঘুরছে গো, সে তো কতই দেখছে আমায়, তোমার ছবি কী কাজে লাগবে তবে!

"নাসরিন এদিকে আয়, একটা গান কর্" টিয়া বলে উঠল। নাসরিন বসে আছে দূরে, সসঙ্কোচে। "আয় না", রীনা বউদি ডাকলো। নাসরিনকে বেশি বলতে হলো না, খোলা গলায় গেয়ে উঠল চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো। / ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো...

গান থামলে বিজিত বললো"আপনি এত ভালো গান করেন, ছাড়বেন না যেন"। নাসরিন আরও সঙ্কুচিত। আমি জানি ওর সঙ্কোচের কারণ টিয়ার ঠাম্মাই। তাঁর চিন্তা-ভাবনা একদম অন্যরকম, আমাদের সঙ্গে প্রচন্ডই অমিল। তাঁর ভয়ে সবাই কাঁটা এ-বাড়িতে। নাসরিনও। সে জানে, ঠাম্মা যদি কোনোরকম স্নেহ দেখানও তার প্রতি, তবুও সে কিন্তু আসলে মুসলমানই তাঁর কাছে। 

টিয়া বিজিতকে বললো, "অপূর্ব খুব ভালো আবৃত্তি করে", এরপর অপুকে বললো, "এই কর্‌ না একটা আবৃত্তি।" অপু কবিতা সিংহের কবিতা আরম্ভ করলো --

বার বার বৃক্ষই কেবল

বৃক্ষই আমার    কাছে ফিরে আসে

                           প্রত্যয়ের মতো

এমন প্রত্যয় আর বৃক্ষশাখা ভিন্ন কোথা রাখি

বৃক্ষই আমার সব

আমার সাবেকী!...

কবিতা এমন আশ্চর্য বিষয় যে খুব একটা বেশি মানুষ পড়ে না, কিন্তু ভালভাবে কেউ পাঠ করলে বা আবৃত্তি করলে অত্যন্ত সাধারণ গোছের মানুষও মন দিয়ে শোনে। অপু বেশ ভাল আবৃত্তি করে, যে কোনো মানুষকেই মুগ্ধ করতে পারে। আমাদের কলেজ ফাংশনে প্রতিবারই ও আবৃত্তি করতো। লুকিয়ে লুকিয়ে লেখেও, খুব একটা বেশী লোক জানে না সে'সব। আমরা যখন কলেজ থেকে টিয়ার সঙ্গে প্রায়ই রুনুমাসিদের বাড়ি যেতাম তখন সেইরকমই একদিন ফাঁস হয়ে গিয়েছিল অপুর এই ছদ্মনামে কবিতা লেখার বিষয়টি। এই কবিতা লেখার সুবাদে রুনুমাসির সঙ্গে খুব ভাবও ওর। অবশ্য রুনুমাসি দুলালমেসো এমনই দুজন মানুষ যে, তাদের সঙ্গে ভাবের জন্য কবিতা লেখার প্রয়োজন নেই, ওঁরা খুব সহজেই কাছে টেনে নিতে পারেন সবাইকে, আর রুনুমাসিদের পুত্র আবিরটাও এত মিষ্টি গাবলু হয়েছে, ডাকনাম কেটা। নেপালীরা বাচ্চা ছেলেদের কেটা' ডাকে বলে রুনুমাসি নাম রেখেছেন। বিয়ের আগে একসময় দুলালমেসো্র কাঠমান্ডুতে পোস্টিং ছিল, তখন থেকেই ভেবে রেখেছিলেন ছেলে হলে নাম রাখবেন কেটা, আর মেয়ে হলে কেটি

অপুর আবৃত্তি মন দিয়ে শুনছে ডেইজি, ও অবশ্য সারাক্ষণ ধরেই খুব চুপচাপ, কথা-বার্তা বিশেষ বলেনি কারুর সঙ্গেই। রীনা বউদি ফিসফিস করে কানের কাছে বললো"হ্যাঁরে, অপুর প্রেমে পড়েছে নাকি বিজিতের বোনটা?" 

অপু এমন একটা মানুষ যে প্রেমে পড়ারই মতো, কিন্তু অন্য কোন মেয়ে অপুকে ভালবাসবে এটা ঠিক আমার সহ্য হওয়ার মতো নয়। আবৃত্তি শেষ হলে হৈ হৈ করে রীনা বউদি বলে উঠল বিজিতকে -- "দেখো, এই যে আমরা এত গান টান করে কবিতা পড়ে তোমাদের আনন্দ দিচ্ছি, কাল কিন্তু শয্যাতুলুনীর পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে তবেই ঘর থেকে বার হতে পারবে, সঙ্গে না থাকলে বাড়িতে ফোন করে আনিয়ে নাও।" 

বিজিত হাসলো। অর্ঘ্য বলে উঠলো"কি বলছেন বৌদি? এত সামান্য অঙ্ক? আর সেটা বিজিতের মানি ব্যাগে থাকবে না? এর জন্য বাড়িতে ফোন করে আনতে হবে?" মনে মনে ভাবলাম, চালের গল্প দ্যাখো, কাল সকালে তো সেই দরাদরি করে পাঁচ হাজার টাকা ঠেকাবি বাপু!

আজ এত আলো এত হৈ-চৈ এই বাড়িতে, আমি কিন্তু ভাবছি সেই পুরোনো গল্পটাই। অরিত্র আর টিয়ার গল্প। এই টিয়া বিজিতের সঙ্গে বসে বসে কড়ি খেললো কিছুক্ষণ আগে, এখনও কেমন বসে আছে পাশে চুপটি করে। এই টিয়াই প্রবল জ্বরে ভুল বকেছিল অরিত্র যখন চলে গেল আমেরিকা। ঝুনুকাকিমা দীপেশকাকু কিন্তু রাজি ছিলেন, অরিত্র চলে গেল তবু। চলেই যদি যাবে, আসার কি দরকার ছিল? আমরা সুরতীর্থে যখন গানের স্কুলে যেতাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অরিত্র দাঁড়িয়ে থাকতো সুরতীর্থের সামনে টিয়ার জন্যে। এইসব যদি কোনোদিন না হত ক্ষতি কি ছিল?

দধিমঙ্গলের সময় ভোররাতে রুনুমাসি যখন টিয়াকে টেনে তুললেন ঘুম থেকে, যদিও ঠাট্টা করে বলে উঠলাম "যাও মা, চেটেপুটে খেয়ে এসো", আমার কিন্তু তখন থেকেই মনটা খুব খারাপ, তার মধ্যে আবার সানাই বাজছে ভোর থেকে। সানাই শুনলেই মনটা এমন হু-হু হয়। পিসিমণি দুপুরবেলায় বললেন "হ্যাঁরে তোদের জুটিটা এবার ভাঙলো তবে?"

টিয়ার জ্যেঠিমা বড়মা ঘরের বাইরে থেকে ডাকছেন, "দোলা শুনে যা"। বড়মাকে দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে, ঠাম্মা তাঁকে বড্ড হেনস্থা করেন, অথচ তিনি এত ভাল, কোনো প্রতিবাদ নেই। এত ভালো হওয়ার দরকারটাই বা কি? এত বছর ধরে তাঁর তিরস্কার কেনই বা শুনে গেলেন? বিয়ের দশদিন পরে তাঁর স্বামীর মৃত্যুতে বড়মার দোষ কোথায়!

ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, 'কি বলছো বড়মা?'

তোরা একটু ওর মধ্যেই শুয়ে ঘুমিয়ে নে রে, নয়তো শরীর খারাপ হবে।

ধ্যাৎ, তুমিও যেমন, বাসররাতে কেউ ঘুমোয় নাকি? তুমি যাও তো শুতে।

ঘরে ঢুকে মনে হলো, বেচারা টিয়াটা সেই রাত থাকতে ঘুম থেকে উঠেছে, ওর একটু শোওয়া দরকার। জিজ্ঞেস করলাম"টিয়া একটু শুয়ে নিবি?"

না, ঠিক আছে।

টিয়া কাল চলে যাবে, বেশি দূর নয় যদিও, তবুও যাবে তো। এতদিন যত অনায়াস সব হয়েছে, কাল থেকে সবই অন্যরকম। এই বরাহনগরের বাড়িতে কত সময় হুটহাট চলে এসেছি টিয়ার সঙ্গে, গঙ্গার ধারে বেশ বড় সড় বাড়ি, ঝাউ দেবদারু ছাড়াও কত ফুল গাছ। গাছগুলোও খুব রুচিসম্মত, এর জন্য অবশ্য নাসরিনের বাবার কৃতিত্বই বেশি। মুসলমান বলে যতই ঠাম্মা বাড়িতে না ঢুকতে দিন, গাছগুলো কিন্তু খুব ভালবাসে বসির চাচাকে।

এই বাড়িতে টিয়া কতই আর আসবে! হয়তো কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে। এরপর থেকে গোলপার্কের বাড়িতে মা-বাবার কাছে আসতে গেলেও হয়তো শ্বশুরবাড়ি থেকে অনুমতির প্রয়োজন হবে। আর কি ফুচকা খেতেই শুধু ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে ছুটবো আমরা দুজনে? বিজিতের মা কেমন হবেন তাই বা কে জানে! কত আহলাদে মানুষ টিয়া। রিয়ার সর্বক্ষণ প্রতিযোগীতার ফলেই হয়তো টিয়ার আদরটা অনেক বেশি। ঝুনুকাকিমাও এমন বন্ধুর মতো, যদিও দীপেশকাকু খুবই গম্ভীর, বেশি কথা বলেন না। আমার সঙ্গে এতদিন দেখা, গুনলে দেখা যাবে সর্বসাকুল্যে পাঁচটার বেশি কথা বলেন নি। টিয়া বলে, বাবা ওরকমই, মা-র সঙ্গেও বা কটা কথা বলেন!

সিঁদুর লাগিয়ে মেজেন্টা রঙের বেনারসী পরে টিয়াকে কিন্তু আজ খুব সুন্দর লাগছে। একে তো সুন্দরীই, তায় আবার সিঁদুর পরে মুখটাই বদলে গেছে, কিরকম অলোক-সুন্দর ভাব। এরকম একটা মেয়েকে রেখে অরিত্র কেন যে চলে গেল রিয়ার সঙ্গে! মনে মনে বললাম বিজিত, টিয়া কিন্তু খুব ভালো মেয়ে, ওকে ভালো রাখবেন বিজিত।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র