জয়তী রায় - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

জয়তী রায়

 তুলসী -কাহিনী




গৃহের অঙ্গনে শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত থাকে তুলসী। তাঁকে ছাড়া পুজোর কাজ অসম্ভব। প্রদীপ জ্বালিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে নিত্য প্রার্থনা থাকে। জীবন থেকে মৃত্যু ...তুলসীপাতা সসম্মানে বিরাজ করে সবখানে।
আজ সেই তুলসীর গল্প!
অবাক হচ্ছেন? তুলসীর গল্প?
কি এমন হল তুলসীর সঙ্গে? যদি বলি , শারীরিক শোষণ করা হয়েছিল, বিশ্বাস করবেন? চমকে যাবেন না? গল্প ভাববেন না? নির্মম সত্যকে দেখে চোখ বুজে ফেলবেন না? যদি পারেন, তবে শুনবেন এই গল্প না হলে...!
*****
দুটো পরাক্রমী জাত ছিল। দেবতা আর অসুর। পুজ্য দেবতাদের মস্তিষ্ক ছিল উন্নত। বুদ্ধিমান জাতির সঙ্গে পেরে উঠত না অসুর। বলবান মস্তিষ্কের সঙ্গে পরাজিত হত বলবান শরীরের অসুর। সেইসময় অসুর জাতির মধ্যে আবির্ভাব হল এক নতুন নেতা, জলন্ধর। যেমন তার দাপট, তেমন তার বীর্য। দেবতারা পিছু হটতে লাগল। একটার পর একটা যুদ্ধ পরাজিত হতে হতে কোনঠাসা হয়ে গেল দেবতা। তারপর? শুরু হল এক হীন চক্রান্ত।
********
আমি তুলসী।
আজ আমার গল্প। তার মধ্যে কেন আসে দেব- দানবের দ্বন্দ্ব? আপনারা আধুনিক যুগে বসে আছেন। দুই ভিন্ন জাতের মধ্যের শত্রুতায় ধর্ষিতা হয় নারী? দেখেন নি? কে বলেছে বদলেছে যুগ? নারী জ্বালিয়ে সতী বলে পুজো করা হয়! নারী উলঙ্গ ভূমি মাত্র। কর্ষণ করবে পুরুষ! থাক এসব কথা। গল্প শুরু হোক বরং।
**********
কার্তিক মাস। শুক্লপক্ষ । পূর্ণিমার রাত। শুক্রবার। আমার জন্ম।
চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল চরাচর। পিতা ধর্মান্ধ রাজ মাতা মাধবী...দুজনেই ছিলেন , লক্ষ্মী নারায়ণ ভক্ত। আসন্ন প্রসবা মাধবী অনুভব করলেন চতুর্দিক আমোদিত স্বর্ণচাঁপার সুগন্ধে। চাঁদের ঢেউ তোলা আলোর মধ্যে ছোট্ট মেয়ে নূপুর পায়ে ঘুরে বেড়ায়। কে গো? তুমি কে গো মেয়ে! আধো আলো আধো আঁধারে কোথা হতে ভেসে আসে সুর...ভূমিষ্ঠ হয় চন্দনগন্ধী কন্যা তুলসী।
শতঋষির বন্দনা গানে মুখর রাজসভা। এ যেন মা লক্ষী স্বয়ং এসেছেন ধরাধামে। দুইহাত তুলে আশীর্বাদ করে ঋষিবৃন্দ ঘোষণা করলেন---মহারাজ! এ কন্যা দৈবী ভাব সম্পন্না! দেখুন, জন্ম হতেই চরণতলে পদ্মচিহ্ন। শরীরে আপনা হতে ছড়িয়ে পড়বে চন্দনগন্ধ। মহারাজ, শ্রী বিষ্ণুর মহাভক্ত হবে কন্যা। পরম কল্যানময়ী এই কন্যা যতক্ষণ প্রার্থনা করবে, কোনো অপশক্তির ক্ষমতা নেই সেই বলয়ে প্রবেশ করার। আমরা মহাযোগী ঋষিকুল, কন্যার নাম করণ করলাম-- তুলসী!
**********
মা লক্ষীর মানবী রূপ আমি!
এমনতর কত কথা শুনে শুনে যৌবনে পদার্পণ করলাম। শুনেছি, আমার মুখে নাকি খেলা করে শরত জোছনার আভা, আধো উন্মুক্ত পদ্মের পাঁপড়ি হেন দুটি চোখ, অভিমানী ঠোঁট রাঙা থাকে সর্বক্ষণ, গভীর নাভি দেশ, গোলাপের মত গাত্র বর্ণ।
তবে, বাইরের রূপ- বর্ণনায় মুখরিত পৃথিবী দেখতে পায়নি অন্তরের সাধিকা রূপ। ভ্রমরকৃষ্ণ চোখদুটিতে খেলা করে বুদ্ধি মায়া আর সুদূরের প্রতি এক তৃষ্ণা। রাজার কন্যা আমি, অতুল বৈভব আমায় আকর্ষণ করে না! জীবনের গভীর থেকে গভীরতম খোঁজ ব্যাকুল করে তুলত আমায়। কোন সে সুদূর হতে ভেসে আসে অতীন্দ্রিয় লোকের অচেনা সুর। সে সুর ঘর সংসার হতে ছিন্ন করে নিয়ে যায় কোন অরূপলোকে। সারাদিন ধ্যান আর পূজায় সময় চলে যেত আমার। অনুসন্ধানের আকুল কামনা থেকে তলিয়ে যেতাম ধ্যানের গভীরে। আত্মোপলব্ধি উন্মোচনের আকুলতা রামধনুর মত ফুটে উঠত মনের আকাশে। আলো আলো কত আলো...সমস্ত আলো কেন্দ্রীভূত হয়ে উদ্ভাসিত হতেন আমার উপাস্য দেব--শ্রীবিষ্ণু। নারায়ণ। আমার নারায়ণ। নাম গানে বিভোর আমি জেনেছি সত্যের আভা ক্ষণজীবী নয়। বরং, স্থায়িত্ব তার চিরঅমলিন। আমি তুলসী। ভিতর হতে ফুটে ওঠে সত্যের আশ্চর্য আভা যেন মিথ্যার কোনো কিছু গ্রহণীয় নয়।
******
বর্ষণসিক্ত ভোর। মেঘ - ভিজে আকাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে অলস সূর্য। স্নান সেরে চলেছি নিত্য কর্মে। ভেজা চুলের রাশি কপালে চন্দন ফোঁটা তদ্গত আমি, আনমনে একটি একটি করে তুলে নিচ্ছি ফুল। এমন এক পবিত্র মধুর সময়... কে যেন চরণ প্রান্তে রেখে দিল যুথী - মালিকা। কেউ কোথাও নেই। দূর দূর অবধি পাহাড়ের শ্রেণী। রাজার নিজস্ব উদ্যান। প্রহরী সতত সতর্ক।
এমত অবস্থায় এত সাহস কার?
মুহুর্তে যেন বুকের নিবিড় ছুঁয়ে স্বর শোনা গেল-- অসুররাজ জলন্ধর। দেবদিদেব মহাদেবের মানসপুত্র। তিন ভুবনের শ্রেষ্ঠ বীর। আপনার প্রণয়প্রার্থী।
********
আমি তুলসী। আমি সাধিকা। আমি যে এমন প্রেমিকা...প্রথম দর্শনে সে বোধ ছিন্ন ভিন্ন করে দিল আমায়। জলন্ধর বিনা বৃথা জীবন। পিতা রাজি হলেন, অগাধ ভরসা, তুলসী কোনো ভুল করতেই পারে না কখনো। উৎসবে মেতে ওঠে রাজপুরি। সন্তুষ্ট কেবল নন নারায়ণ। জলন্ধর চরম শত্রু দেবতাদের! তাকে কেন বরণ করবে তুলসী! শত্রুপক্ষের শিবিরে চলে যাবে লক্ষীমন্ত কন্যা? এ কেমন বিষন্ন বিপন্নতা। এ কেমন চূড়ান্ত অবসাদ? এ কেমন অবোধ ভালোবাসা? নারায়ণ উপাসনা করে যেই হাত, সে হাতে আজ রাক্ষসরাজের প্রতি বরমাল্য দুলে ওঠে? এ কি প্রহসন? এ কেমন দুরন্ত অপমান?
*********
দেবতা- দানবের বিরোধের ধুলো বাইরে ফেলে রেখে প্রাসাদে প্রবেশ করতেন আমার রাজা। রক্তবর্ণ অশ্ব সজ্জিত স্বর্ণরথ, তার উপর দণ্ডায়মান শালপ্রাংশু মহাভূজ সুদর্শন সুপুরুষ দৈত্যরাজ জলন্ধর।
তুলসী তুলসী তুলসী...ডাক নয় যেন আর্তস্বর। মুহূর্তের অদর্শন বহন করে তীব্র বেদনা। ছদ্মকোপে হেসে উঠে বলি--এ কেমন মহাবীর তুমি? সামান্য নারীর জন্য এত ব্যাকুলতা?
দুইহাতের অঞ্জলিতে মুখখানি তুলে রাজা বলে--একমুঠো বিশ্বাস আছে এইখানে। তৃষিত চাতকের মত ছুটে চলে আসি। বলো রানী, আছে কোথাও এমন অমৃতপূর্ণ বিশ্বাসী হৃদয়?
কোথা হতে ভেসে আসে দামামা ধ্বনি। ও ই বুঝি শুরু হয় মহাসমর! বাহু বন্ধন শিথিল করে বলে রাজা--বিদায় দাও রানী। যেতে হবে।
আকুল আমি বলে উঠি--কেন রাজা? সমস্ত তুচ্ছ করে সরিয়ে দাও দূরে। মুঠো ভর্তি যতটুকু পাই ততোটুকু নিয়ে সুখে থাকি।
রাজা বলে--এ আমার অঙ্গীকার রানী। দেশের প্রতি। প্রজাদের প্রতি। দেবতা প্রতিদিন তুচ্ছ করে, অবজ্ঞা করে আমাদের। প্রতিদিন রটনায় মিথ্যা রঙ ছড়িয়ে দেয় ভুবনময়। আমি রাজা জলন্ধর। বশ্যতা কখনো নয়।
আকুল আবেগে বলে উঠি --- রাজা, আজ চৈত্র পূর্ণিমা। কথা ছিল দুজনে জোছনা স্রোতে গড়ে নেব নতুন বসত ? প্রতিশ্রুতি ভুলে গেলে রাজা?
আনমনা রাজা বলেন--জানো রানী, বার বার পরাজিত দেবতা আজ দেবদিদেব মহাদেবের আশ্রয় নিয়েছে। তিনি আজ দেব সেনাপতি।
---হায়! তিনি যে তোমার ইষ্টদেবতা?
--ইষ্ট বলেই তো অনিষ্টের আশঙ্কা নেই। আর তুমি আছো। তোমার দৈবীশক্তি আছে। যতক্ষণ পুজোর আসনে থাকবে তুমি, আমি থাকব অজেয়। অমর। বিশ্বাস আছে আমার!
--স্বামী!
--ভয় নেই প্রিয়ে।আজ প্রাসাদ ভেসে যাক চাঁদের আলোয়। নিভিয়ে রেখো প্রদীপের আলো। আঁধার সরিয়ে আলিঙ্গন করে নিয়ে যাব পূর্ণতায়। অপেক্ষায় থেকো রানী। দেখো, চিনতে পারবে তো আমায়? ভুল হবে না তো?
*********
আমি তুলসী।
আমার গাছের পাতায় ওষুধের গুণ। হাওয়াতে মৃত সঞ্জীবনী স্পর্শ। মিথ্যা! মিথ্যা! সব মিথ্যা!
বাঁচাতে পারলাম না স্বামীকে। মৃত্যুর করাল থাবা বুকে নিয়ে দ্রুতগামী রথে চড়ে ফিরে এসেছেন প্রাসাদে। তুলসী তুলসী...পূজার আসনে বসে আছো? তুমি প্রার্থনায় আছো, তবে স্পর্শ করতে পারবে না মৃত্যু। তুলসী... স্বামী আর্তনাদ করে ডাকছেন। আমি বিভ্রান্ত।
তাই তো! এটাই তো হবার কথা। তবে কেন দেখো এত অবিশ্বাসের চোখে? আমার অর্ধনগ্ন শরীর, শরীর জুড়ে পুরুষ আদর...রমণ প্রখর চিহ্ন...এ স্বামীর দেওয়া নয়? তুমি ছিলে না তখন? তবে কে আমায় তুলে নিল পূজার আসন থেকে? সে যে হুবহু আমার স্বামী। সেই সুগন্ধি, সেই চাহনি, সেই ভঙ্গিমা, সেই মধুর আদর...সে কে?
নাহ। উত্তর দিতে পারেনি রাজা জলন্ধর। ত্রিশূলের বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে শরীরে। অবিশ্বাসী অসহায় চক্ষু দুটি তুলে নীরবে দেখল প্রিয়মুখ। তারপর মিশে গেল অযুত আলোকবর্ষে।
********
তুলসী অপবিত্র। তুলসী অসতী। তুলসী ব্যভিচারিণী।
স্বামীর মৃতদেহ কোলে নিয়ে স্তম্ভিত আমি। নির্বাক। এমন অসম্ভব সম্ভব হল কি করে? সর্বশক্তি নিয়োগ করলাম চেতনার বন্ধ দুয়ারে। দরদর অশ্রুধারা মুছে ফেলে কঠিন সাধনায় নিয়োজিত করলাম নিজেকে। কে সেই প্রতারক? কে হরণ করল আমার সতীত্ব?
আলোময় চেতনায় স্পষ্ট হতে থাকল একটি মুখ। অধীর আগ্রহে স্থির হয়ে আছি। ক্রোধ- আগুনে দগ্ধ হতে হতে প্রতীক্ষায় আছি সম্পূর্ণ অবয়বের। কার এত দুঃসাহস? সতীনারীর তেজ জানে না? খল খল বিদ্রূপে হেসে উঠল কে? সতী নই আমি? কে বলেছে নই ? নারীর সম্মতি বিনা সঙ্গম... ধর্ষণের নামান্তর।
সরে গেল আলো। মুছে গেল আঁধার। সামনে এলো অবয়ব। কে ও? কে ও?
সেই কোন শিশুকাল হতে পূজা করি যাঁর। যাঁর নাম গানে ভরিয়ে রাখি সংসার। আমার ভরসা, আশ্রয়...শেষ পর্যন্ত তিনি?
নত মস্তকে দাঁড়ালেন ভগবন--ক্ষমা করো দেবী। তুমি জলন্ধরের শক্তি ছিলে। তাই বাধ্য হয়েই বেছে নিতে হল এই পথ।
--তাই আপনি এলেন নষ্ট করতে আমার সতীত্ব? আপনি?
অশ্রুর পরিবর্তে চোখে জলে উঠল ক্রোধের আগুন। নত মুখে দাঁড়িয়ে রইল নারায়ণ। সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে অভিশাপ দিলাম আমি--
নারায়ণ। তোমার ঐ রূপ দাঁড়াবে এক খন্ড পাথরের মতন। লোক তোমার মূর্তির পরিবর্তে ঐ টুকরো পাথরকে গুরুত্ব দেবে বেশি। রূপ বদলের এত ইচ্ছে যখন, তবে যাও, পাথর রূপে বদলে যাও। শালগ্রাম শিলারূপে পূজিত হও।
********
আমি তুলসী।
মাথা নত করিনি অন্যায়ের কাছে। মাত্র উনিশ বছর বয়েসে স্বামী ছেড়ে সংসার ছেড়ে ইচ্ছা মৃত্যু বরণ করার আগে শুনলাম নারায়ণের আশীর্বাদ বাণী--
পৃথিবীতে যতদিন শালগ্রাম শিলার পুজো হবে, তুলসী ছাড়া নারায়ণ শিলার পুজো সম্পন্ন হবে না!
_____

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র