তুষ্টি ভট্টাচার্য্য - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

তুষ্টি ভট্টাচার্য্য

ওরা 


মোড়ের মাথায় আসতেই ওদের গলা শোনা গেল। একেক সময়ে খুব অদ্ভুত লাগে ভাবলে। এরা কী ভাষায় কথা বলছে! ওদের প্রায় প্রত্যেকের দেখনদারীতে একটা প্রচ্ছন্ন মিল আছে। পোশাকে, অঙ্গভঙ্গিতে, ওরা একটা ক্লাস। বরং ডিক্লাসড্‌ বলা চলে। আমরা যারা ক্লাসে পড়ি, ওদের পাশ কাটিয়ে যাই দ্রুত পায়ে। আড়চোখে তাকাতেও ভয় পাই আসলে। যদি কোন অপমানসূচক কিছু বলে বসে! আমাদের ক্লাস পড়ে যাবে যে ধপাস্‌ করে! আমাদের মুখোশধারী মুখগুলো চুপসে যাবে যে তখন! তার চেয়ে, মানে মানে সরে পড়াই ভালো। একটা দূরত্ব থাক ওদের সাথে আমাদের। ওরা রকবাজ। সেই যে হারিয়ে গেছে গলিগুলো, যে গলির পুরনো বাড়ির সামনে খোলা রক থাকা ছিল অপরিহার্য, সেই গলির রকবাজ ওরা।

এদের কথা বলতে গেলে এদের ভাষাতেই কথা বলতে হবে। যে রকের কথা বলছিলাম, সেখানে ছ’জন নিয়মিত আসে। রানা, পিন্টু, টুকাই, মন্টা, চাকু আর ক্যাবলা। রানার বাড়ি মোটামুটি সচ্ছল, বাবার পেনশানে সংসার চলে। একটাই ছেলে ও, ওর বাবা-মায়ের। পড়াশুনো করেছিল, কমার্স গ্র্যাজুয়েট। চাকরী জোটে নি। একটা প্রেমও করেছিল, চাকরি পায় নি বলে প্রেমিকা বিয়ে করে ফেলেছে সম্বন্ধ করে। এখনও রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে রানা কাঁদে তার জন্য, বিরহের কবিতাও লিখে ফেলে দুএকটা। পিন্টুর বাপ নেই, মা রান্না করে লোকের বাড়িতে, একটা বোন আছে, কালোঝুলো, বিয়ে হয় নি। টুকাইয়ের বাপ-মা কেউ নেই, মামাবাড়িতে থাকে, দুবেলা ভাতের জন্য গঞ্জনা খায়, তবু কোথাও পালাতে পারে না। মন্টা একটা কারখানায় কাজ করে, বৌ আর পাঁচ ছেলেমেয়ে, বৌ আবার বিয়োবে, ফ্যামিলি প্ল্যানিং ওর দ্বারা আর হল না। চাকুর জামার ভেতরে সত্য সত্যি একটা চাকু থাকে, খুব রেগে গেলে ওটা বের করে সকলকে উদোম খিস্তি করে। যদিও ওই চাকু কোনদিন রক্তের মুখ দেখে নি। ক্যাবলার ছোটবেলায় মেনিঞ্জাইটিস হয়েছিল, সেই থেকে ওর বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম। মাঝেমাঝেই বেতালা বকবক করে।

একদিন বেলার দিকে ওদের জমায়েত শুরু হচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ একটা বাইক গাঁকগাঁক করে ছুটে এলো, আর সেই মুহূর্তে একটা বাচ্চা ছেলেকেও দৌড়ে রাস্তা পেরোতে হল! নিমেষের মধ্যে বাচ্চাটা ছিটকে পড়ল, মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে তখন। দুপুরবেলা, কেউ কোথাও নেই, ওরাও হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে চেঁচিয়ে উঠে যেদিকে বাইক চলে গেছে, সেই দিকে চাকু ছুঁড়ে মারল তার নিত্য সঙ্গী চাকুটাকে। ঠনঠন করে আওয়াজ তুলে গলিটা আরও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। রানা বরাবরই কম্যান্ড করে ওদের টিমকে। আজও ছুটে গেল বাচ্চাটার কাছে। হুঁশ ফিরে এলো যেন সবার। ওরা ধরাধরি করে বাচ্চাটাকে একটা রিক্সায় তুলে হসপিটালের দিকে চলল। ততক্ষণে দুপুরের ঘুম ভেঙে বাড়িতে বাড়িতে চায়ের আসর বসেছে। অনেকেই দেখেছে বা জেনেছে ব্যাপারটা, কিন্তু সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসে নি। ক্যাবলা শুধু এখনও ওখানে একা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বকে যাচ্ছে! ওকে হসপিটালে নিয়ে যায় নি ওরা।

বাচ্চাটার বাবা-মা খবর পেয়ে যতক্ষণে সেখানে গেছে, ততক্ষণে পুলিশ কেস থেকে হসপিটালে অ্যাডমিট করার সব হাঙ্গামা ওরা সামলেছে। বাচ্চার বাপ-মাকে দেখে টুকাই আর সামলাতে পারে না। মুখ বিকৃত করে বলে ওঠে, এই যে এয়েচেন মারানির দল। বাচ্চা বিইয়ে ছেড়ে দিয়েছে পতে, যা এবার লাটে ওঠ! শালা কুত্তার বাচ্চারা, এটা মরলে মারা গিয়ে আবার! রানা কোনরকমে ওকে শান্ত করে ওখান থেকে সবাইকে নিয়ে চলে আসে। যাওয়ার আগে অবশ্য রাতের আসরের জন্য বাচ্চাটার বাবার থেকে কিছু টাকা নিতে ভোলে না। টুকাই বলে, আজ শ্লা খুব মাল খাবো, মুডের দফা গয়া হয়ে গেছে। মন্টা মুখ ভ্যাংচায় তাই শুনে। ওর আজ নাইট ডিউটি, অশ্রাব্য একটা খিস্তি দিয়ে বলে, তোদের বাঁ* আজই মোচ্ছব করতে হবে? আমার জন্য একটু ভাববি না! পিন্টু বলে, ভাগ শালা, ভাবের বাচ্চা! এ পিতিবিতে কে কার জন্যে ভাবচে সুনি!

রাতে যখন পাড়ার সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে, এই রকবাজের দল একটা চোলাইয়ের ঠেকে আসর জমিয়েছে। আজ ক্যাবলার খুব ভাব এসেছে। সে দুলে দুলে চিৎকার করে বলতে শুরু করেছে, কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি/ বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি...... এবং তারপরের লাইনগুলো হয় ও ভুলে গেছে, নয়ত মনে পড়ছে না ওর। ওই দুটো লাইনই বারবার ফাটা রেকর্ডের মত বলে চলেছে। রানার আজ কিছু একটা হয়েছে। গুম মেরে আছে সেই থেকে। চুপচাপ গিলে যাচ্ছে শুধু। চাকু আর পিন্টু ক্যাবলার কান্ড দেখে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ রানা ধড়াম করে উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাবলার গালে ঠাটিয়ে একটা চড় কষালো। চাকু, পিন্টু যেন শক খেয়েছে, এমনভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর ক্যাবলা হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলতে থাকল, তুমি আমাকে মারলে গুরু! মারলে! ওরা সবাই ঠেক থেকে বেড়িয়ে এলো একসাথে। সকলেরই নেশা কেটে গেছে। কেউ কোন কথা বলতে পারছে না এই নিয়ে। কিছুক্ষণ চুপচাপ চলার পর হঠাৎ টুকাই গর্জে উঠল – কেন মারলি তুই ক্যাবলাকে? নিজেকে কি ভেবেছিস, দাদা? নেহাত একটু বিদ্যে আছে বলে তোকে মান্যি করি, তা বলে শুধুমুদু ওকে চড় ক্যালাবি? ক্যাবলা ততক্ষণে সামলে নিয়েছে নিজেকে। ও বলতে লাগল, আমার একটুও লাগে নি কিন্তু, মাইরি বলছি! চাকু এক ধমক লাগালো ওকে, চুপ বে!! আবার নিস্তব্ধতা চারিয়ে গেল রাস্তায়। ওরা চার মূর্তি রাস্তা দিয়ে চুপ করে চলেছে, রাস্তাও যেন খাচ্ছে না ব্যাপারটা।

ওদের রকের মুখে এসে রানা বলল, তোরা বাড়ি যা, আমি এইখানে একটু বসব। অন্যদিন হলে ওরা কেউ চলে যেত না, কিন্তু আজ সবাই সুড়সুড় করে যে যার ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হল। মন্টা নাইট সেরে ভোরে বাড়ি ফেরার সময়ে দেখে রানা একলা বসে আছে। তখনও আলো ফোটে নি ভালো করে, রাস্তার কলে জল আসে নি বলে, কলের মুখে বালতির ভিড় নেই। এই অসময়ে রানাকে রকে একা বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হল মন্টা। বুঝলো, নিশ্চয়ই কোন গণ্ডগোল হয়েছে। মন্টাকে দেখে রানা হাত নেড়ে ওকে পাশে বসতে বলল। তারপর কোন ভূমিকা না করেই কেঁদে ফেলল হুহু করে। বলতে লাগল, জানিস – ছোটবেলায় স্কুলে ওই কবিতাটা ঠিক মত বলতে পারিনি বলে, স্যার আমাকে ঠাস করে এক চড় মেরেছিল। সেই চড়ের জ্বালাটা আজ এতদিনে গেল। মন্টা কিছুই না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নাক থেকে মশা তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলল, কী যে বিলা করিস মাইরি! কিসুই মালুম হল না। চল্ চল্, বাড়ি চল্। রাতে মাগীটার নাকি পেটে ব্যথা উঠেছিল। আজ না আবার বিইয়ে বসে! রানা প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে উঠে বলল – চ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র