সুকান্ত দে - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

সুকান্ত দে


রক উপকথা




মেল ছাড়তে দেরি হল একজন মানুষের জন্য। তিনি শচিদানন্দন সিংহ ওরফে শচীদা। দা মানে দাদাও বটে দাদুও বটে এবং কাটারির বড়ভাইও বটে।সালটা ১৯৫০ এর আশেপাশে। আমাদের পুরানো পাড়াটাতে কয়েকটা মাত্র দালানবাড়ি। অভিজাত পরিবার। সব কটিতেই বৈঠকখানা। গড়গড়ার রেওয়াজী ব্যাপারের সাথে ছোট ছোট একতলা বাড়ির সামনে হুঁকোর মতো রোয়াক। বেশিরভাগই খালি। এরপর জমিদারি ঠাট কমবে বৈঠকখানা খালি হবে আর ভরে উঠবে রোয়াক। চারমিনার, পানামা ইত্যাদি এসে হুঁকো বাজার ছাড়া করবে, গড়গড়া গড়াগড়ি খাবে। সে কথা পরে বলছি। 

শচীদার ডান হাত নেই। স্বদেশী করার সময় বোমা বাঁধতে গিয়ে উড়ে গিয়েছিল । লম্বা, চ্যাটালো বুক, চওড়া কাঁধ। অকৃতদার ।কয়লার আড়ত। ঘুঁটে গুল এসবও থাকে। হিসেবী গিন্নিরা ঘুঁটেউলির কাছে পণ-গণ্ডায় কেনেন। বড় বাড়িগুলোতে এখান থেকে যায়। মাসকাবারি হিসেব। এই পাড়ার রকবাজ তিনিই। যেখানে থাকেন সেটাই রক। মা-মাসিমারাও “মা” বৌমায়েরাও “মা”। মাঝে একফালি অবসরের মতো বৌঠান।ব্রহ্মচর্য কি একবারও টসকায়নি? যার নেতৃত্বে ফুটবল, কুস্তি, ডন-বৈঠক, লাঠিখেলা, নাটক যাত্রাদল আনা সব হয় তাকেই একবার ভর সন্ধ্যাবেলায় এক সুবেশা তরুণী জড়িয়ে ধরে ফেললে তিনি বাংলা অক্ষর “থ” এর মতো হয়ে গেলেন। কাছে টানা বা ঠেলা কোনটাই তাঁর রপ্ত নেই, তাতে হাত একটা। খানিকক্ষণ থমথমে। চারপাশে তাকাচ্ছেন শচীদা। শেষে কিনা একজন নারীর কাছে...। হঠাৎ সেই মেয়েটি অবিকল হাজরা বাড়ির নন্টুর কণ্ঠে হেসে উঠলো। আশপাশ থেকে আরও যারা লুকিয়ে ছিলো তারাও বেরিয়ে এলো। এই একবারই তিনি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়েছিলেন। এরপর তো ৫০ এ প্রজাতন্ত্র, ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ, ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তুর ঢল।৭২ এ নকশাল আন্দোলন হতে হতে তিনি বাহাত্তুরে বুড়ো। নরম হয়ে গেছেন অনেক। রোয়াক ভরে উঠছে রোজ। তার আসা-যাওয়ার সময়ের সাথে টাইম কলের জলের মতো রোয়াকের জনসংখ্যা কমে বাড়ে।কেউ লাভ করেছে জানা গেলে গোটা শহর চাউর হতে সময় লাগে না। শুধু রকের নয়, গিন্নিদের দ্বিপ্রাহরিক আড্ডায় সেই নিয়ে ঢলাঢলিও হতো বলে শোনা । 
রকবাজ ১: একদিকে উদ্বাস্তুর ঢল, সেই সাথে সমাজের অর্থনৈতিক এবং নৈতিক জীবনের পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত। কারো কাছে আছে কারো বা নেই। কেন নেই?।স্বাধীনতার ভিন্নতর মতলব। যারা নৈমিষ্যারন্যে বা আন্দামানে চলে গেলেন তাঁরা আর ফ্রেমের ভেতর এলেন না। যারা থাকলেন তাঁরা? বেঁচে থাকা বড় দায়। ঘটিরা বলে – “তোদের তো সবারই ১০০ বিঘা জমি, আমবাগান, জামবাগান, আর গঙ্গার সিকিভাগ। তা হ্যাঁরে তোরা মোহনবাগান চিনিস?” সুকুমার রায় লিখছেন --- “বাঙ্গাল মনুষ্য নয় উড়ে এক জন্তু/ লাফ দেয় গাছে ওঠে লেজ নেই কিন্তু । '' মেধা আছে সুযোগ নেই। মানুষে মানুষে ছয়লাপ। উত্তমকুমার গান ধরেছেন – ''শোন বন্ধু শোন প্রাণহীন এই শহরের উপকথা...। '' মরিয়া অবস্থা। হ্যাঁ রোয়াক রক হয়ে যাচ্ছে। ঘরের ছেলে পর হয়ে যাবে এরপর।বৌঠান বৌদি হয়ে গেছেন। মেয়েরা অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য সংসারের হাল ধরতে আসছে। স্ত্রীশিক্ষা বেড়েছে। মুখ তুলে তাকাচ্ছেও কেউ। না সম্ভ্রম যায়নি। নার্সিং হোস্টেলের মেয়েদের আজকের মতো পাহারা দিয়ে নিয়ে আসতে হতো না রাত্রে। নারী বিধবা হয়ে বলি গেছেন কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে সংসারের জন্য জীবন দিচ্ছেন, নারীস্বত্বার থেকে উঠলে আসছে মাতৃস্বত্বা সে এক অনন্য উদাহরণ। তনুজা রকবাজ সৌমিত্রকে ঘরোয়া করে রাখতে চাইছেন। কিন্তু তখনও তো নীললোহিত চলে যাচ্ছেন এক কাপড়ে বন্ধুর চাকুরিস্থলে। কাটিয়ে আসছেন বন্ধুর জামা-কাপড়ে খাবারে অর্থে। না একেবারে পর হয়ে যায়নি রকবাজেরা। বিপদে আপদে ওরাই তো ভরসা।বাউণ্ডুলেরাই আপান ভালো দেরীতে বোঝে। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে, সমাজের জন্য খেটে মরেছে, ঘরের থেকে বোনের মোষেই টান বেশি। বাবাবাছা করো, কিন্তু একফালি দূরত্বও যেন থাকে। 
রকবাজ ২- 

গঙ্গা দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। ময়লা বাড়ছে। শুধু জল নয় সংস্কারের গাঙ্গেয় পলি ক্রমশ ঢাকা পড়বে কারখানার বর্জ্যে। একান্নবর্তী পরিবার ভাঙ্গবে। অন্তর্হিত হবেন। বাবা খেদাবে, মা বকবে,বাবার মতো দাদা বৌদিকে নিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যাবে। ওরা কোথায় যাবে? –“তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান...............” এসে মেঘ করে “ভায়ের মায়ের এতো স্নেহ” চাপা দেবে। রাজনীতি বদলাবে। শচীদা ভোটে দাঁড়াননি কখনও।কাউন্সিলার তারই বিচক্ষণতায় নির্বাচিত হয়েছেন , ব্যক্তিত্বের রাশভারী কাঠামোয় পাড়া দাঁড়িয়েছে পরিবারের মতো। এই ভাবনাটাই চলে যাবে এবারে। ওরা বুঝে যাবে ওদেরকে সবার দরকার। সরকারেরও। ওরাই খাটতে পারে। দিনে রাতে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে। তাহলে অমৃতের ভাগ ওরাই বা পাবে না কেন? শচীদারা চলে গেলেন, সেই জায়গায় এলো হাত-কাটা দিলীপ।না না রক ছেড়ে যাইনি। জয় গোস্বামীকে মনে পড়ায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলাম ।

তারা ঢাকা মেঘ 
মেঘে ঢাকা তারা
একজন বাঁধে লম্বা বিনুনি
অন্যটি তার চুল খুলে সারা।
..............................
সকালে যখন কলেজে বেড়োয়
চনমন করে রক-রাস্তারা।
..............................
একতলা বাড়ি কলোনির পাড়া......
দেখে একে একে ফিরেছে সবাই
কতো এডভান্স? বাড়াচ্ছে ভাড়া?
আসলে এভাবে রকেরা বদলে যাবে ভাবা যায়নি। মা ষষ্ঠীর কৃপা তো কম নয়। রকবাজ রা যাবে না, রংবাজ হয়ে যেতে পারে কিন্তু থাকবে। একদিকে চেকনাই বাড়ছে। শপিং মল, পিৎজা, ডিস্কো, ট্যাব ফেবু, হোয়াটস এপ, আর একাকীত্ব। মানুষ এর সাথে মানুষের দূরত্ব যতো বাড়ছে কোমল সংস্কারগুলো ততোই যেন কমে আসছে। প্রতিযোগিতা আর দৌড়। কোথায়? কতদূর? স্টেটস, ইউ কে, আরও দূর। হৃদয় তো বুকেই আছে। মনের মানুষ?সে কই? কোথায় জীবন খুঁজতে গেছে?

বড্ড ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি মাইরি। হচ্ছিলো রকবাজ নিয়ে কথা, মধ্যিখানে কবিতা আউড়ে ঘেঁটে গেলাম। কেন জানিনা মনে হচ্ছিলো কিছু মানুষের উত্থানের সাথে যারা পিছনে থেকে গেলো তারা আজও রকবাজি করছে। যারা স্টেবেল হয়ে যায় তারা আপনি-কপনি নিয়ে সুখে থাকতে চায়। যারা হয় না তারা এভাবেই পর হয়ে যায়। ঘেরাটোপের ভেতরে তারা আসতে পারে না, চায় আবার চায়ও না। পাড়ার সাবেকী আটচালার পূজো থিম পূজোতে পরিবর্তিত হয়ে গেলে নামডাক হয় বটে কিন্তু সেই আন্তরিকতা থাকে না। চাঁদার জুলুম যেমন নেই তেমন বিপণন এ ঢেকে গেছে প্রতিমার মুখ।

তুমি তো সবার সামনে নীলুদাই বলতে আড়ালে নীলু। বিয়ে করে চলে গেলে। আমি তো চাওয়াটাকেই বুঝতে পারিনি। দাদুর দেওয়া নামটা কিন্তু নীলকণ্ঠ। তুলসিতলায় প্রদীপ আর শাঁখের আওয়াজ এলে আমার ভেতর কেমন একটা হয় জানও। সমস্ত পৃথিবী বিষে নীল হয়ে গেলে তোমার পরিবার আর সন্তানের মঙ্গল কামনায় আমি বিষ গিলে নেব, একবারও ভাববো না।ভেতরে একটা যখ আছে সে পাহাড়া দিচ্ছে। মরতে দিচ্ছে না বাঁচতেও না। তুমি ভালো থেকো। আমি আছি। আছি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র