চয়ন ভৌমিক - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

চয়ন ভৌমিক

অন্য রক



গরমের ছুটির দুপুরগুলো বেশ একা ছিল রজতের। নতুন পাড়ায় কাউকেই চেনেনা সে। তাই গল্পের বই আর পরীক্ষার পড়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়াটাই বোধহয় সবথেকে সহজ সমাধান ছিল তার ওই ঝিম ধরা একঘেয়ে দুপুরগুলোতে। কিন্তু ঘুমাতে পারতো না রজত, খুব হিংসাও হত ওদের দেখে। ওরা এপাড়ারই ছেলে, বয়সে তারই মত। সবারই বয়েস বেশ ঘাড়ে ঘাড়ে, তারই মত সবে গোঁফের রেখা ঠোঁটের উপরে। কিন্তু ওদের বাড়ির দরজায় যেন কোনো আগল নেই। সারাদিন টইটই দেখে মাঝে মাঝে ভাবতো ওদের কি বাড়িতে মা বাবা বকেনা? ওদের স্কুল খুললে কি পরীক্ষাও নেই? তার মত দিনভর বই মুখে করা ছেলে কিছুতেই ওদের এই পাখির মত উড়ে বেড়ানোটা আত্মস্থ করতে পারতোনা । সকাল থেকে রাত পাশের ক্লাবের বারান্দায় আড্ডা আর আড্ডা। দুপুর রোদ বাড়লে ওরা ক্লাবে ঢুকে ক্যারম পেটায়, বিকেল চারটে না বাজতেই ফুটবল পায়ে নেমে যায় পাশের মাঠে। সন্ধ্যা নেমে গেলেও ঘরে ঢোকার নাম করেনা। ও নিশ্চিত ছিল, একটাও স্কুলের গণ্ডী পেরোবেনা। ও দেখেছে সবাই কাছাকাছি স্কুলে পড়ে, কেউ সাইকেল কেউ বা হেঁটে স্কুলে যায়, বাংলা মিডিয়মই হবে। ওদের বাবারা কেউই তার বাবার মত বড় অফিসে চাকরি করেনা, বা তাদের মত এই বড় থ্রি বেডরুম ফ্ল্যাট এ থাকেনা। কিন্তু মারাত্মক ভাবে একটা জীবন আছে ওদের মধ্যে। ওদের কথাবার্তা যেটুকু কানে আসে, তাতে রজত এটুকু বোঝে ওদের সম্পর্কটা নিবিড় বন্ধুত্বের। একে ওপরের সঙ্গে বেশ হার্দ্য একটা সহাবস্থান। 

রজতের একমাত্র বন্ধু অর্ক তাদেরই ফ্ল্যাটে থাকে। অবশ্য রজত ওকে বন্ধু ভাবতে রাজি নয়, ওদের মধ্যে পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো কথাই হয় না, বেশ ঠাণ্ডা একটা সম্পর্ক। দুজনেই এক ক্লাসে পড়ে কিন্তু সবসময়েই যেন একটা প্রতিযোগিতা চলছে। এতে দুজনের বাড়ির লোকও বেশ জড়িত এবং ওরাও যেন মনে মনে চায়না, বন্ধুত্বটা পড়াশোনার বাইরে যায়। বেশ একটা মেকী আবহাওয়া, যেটা কিন্তু ওই ছেলেগুলোর মধ্যে আর তাদের পরিবারের মধ্যে নেই। রজত ভাবে এটাই কি ওকে ঈর্ষান্বিত করে তুলছে ওই ছেলে গুলোর প্রতি? রজতের খুব ইচ্ছা করে ছেলেগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে। মাকে একবার বলেওছিল সে কথা, তাতে মায়ের মুখের যে অবস্থা হয়েছিল, সে দেখে রজত আর কিছুই বলেনি কোনোদিন। কিন্তু রজতেরও ক্যারম খেলতে ইচ্ছে করে, ফুটবল খেলতে ইচ্ছে করে, পড়তে পড়তে ঘুম এসে গেলে ইচ্ছে করে টিভিতে কার্টুন না দেখে একটু বেরিয়ে ওদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসতে। মা ওদের বলে রকবাজ। বলে বড় হলে ওরা নাকি পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানি করে বেড়াবে। কিন্তু রজত ওদের বেশ নজর করে ছেলেগুলো কিন্তু ওদের স্কুলের অনেক ছেলেদের থেকেই বুদ্ধিমান। কিন্তু মাকে কে বোঝাবে, আর বাবাও তো মায়ের কথার একচুলও বিরোধ করবেনা। তাই বাবাকে বলেও লাভ নেই। সে মনে মনে ভাবে তাকে একদিন ওই রকবাজদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতেই হবে। কি ভাবে হবে রজত জানেনা, কিন্তু মন ছুটে যায় ওদের দিকে, আকুল টান অনুভব করে।

গরমের ছুটি শেষ। স্কুল শুরু হয়ে গেছে। সে একদিন স্কুল ফেরত মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওরা ভলিবল খেলছে আজ। ও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, ওরই বয়সী ছেলেগুলো এক একটা পয়েন্ট এর জন্য কি প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ী। প্রত্যেকটা পয়েন্ট জিতলে একসঙ্গে উচ্ছ্বাস, আর পয়েন্ট হারলে দ্বিগুণ উৎসাহে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার হাতে হাত ছুঁয়ে। রজত নড়তে পারছে না। এক অদৃশ্য শিকল দিয়ে যেন কেউ তার পা বেঁধে দিয়েছে। এমন সময় হঠাৎ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো একজন। রজত ভাবতেই পারছেনা তাকে ওরা খেলার জন্য ডাকছে। প্রচণ্ড দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো রজত। একে সে ভলিবল খেলেই নি কোনোদিন, তার উপরে মা জানতে পারলে আর রক্ষা নেই। সে চোয়াল শক্ত করলো, তারপর কাঁধ থেকে ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে এগিয়ে গেল ওদের কোর্টের দিকে। তার চোদ্দ বছরের কিশোর মন কবেই তো এদের বন্ধু বানিয়েছে, আর অর্ককে ইঁদুর দৌড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু সে তো খেলাটা জানে না। হোক গে। সে এগিয়ে যাওয়াতে সেই ছেলেটা ইশারায় তাকে উল্টো দিকের দলে দাঁড়াতে বলল। সে কোর্টে ঢুকতেই একজন তাকে নাম জিজ্ঞাসা করল। রজত নিজের নাম বলতেই ওরা ছজন নিজের নাম গুলো পরপর বলে দিল। সব নাম মনে রাখতে পারলোনা রজত ,তবে মনে মনে বেশ একটা ভালোলাগা ভরে গেল তার। খুব একটা ভালো খেলতে পারলোনা সে। একটু বিরক্তি প্রকাশ করলো ওরা, জিজ্ঞাসা করলো এই প্রথম কিনা। নতুন শুনে একটু বলে দিল নিয়ম কানুন, ওর কাছ যাতে বল বেশী না যায় তাও নজর রাখলো পুরো খেলাতে। খেলতে খেলতে ও সবার নাম জেনে নিলো। “কাল আবার আসিস” বলল নান্টু। শেষ বিকেলে বাড়ী ফেরার সময় মনে পড়লো কুন্তলা দি, একবার এসে বলে গেছে মা ডাকছে। খেলা শেষ। ওরা মাঠে বসে পড়েছে, এমন সময় সমীর বলে একজন এসে বলল কাউকে রক্ত দিতে হবে। ওরা হুড়মুড় করে উঠে পড়লো। সেই মুহূর্তে রজতের মনে হল, সে কোনো দূর গ্রহের মানুষ। যে গ্রহে মাটি নেই, শুধু আবেগহীন বেড়ে ওঠা। সে গ্রহের নাম পৃথিবী নয়, অন্য কিছু যেখানে স্বার্থছাড়া আর কিছুরই আবাদ হয় না।

মনে একটা আশঙ্কা নিয়ে কলিং বেলটা বাজালো রজত। মা গম্ভীর মুখে দরজা খুলে কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেল। রজত বুঝে গেছে আজ কপাল খারাপ। হাত পা ধুয়ে মনের মধ্যে কালো মেঘ জমিয়ে সে স্টাডিতে ঢুকে গেল। আর অপেক্ষায় রইল কখন ধেয়ে আসবে প্রবল ঝড়। খানিকক্ষণ বাদে বাবা ফিরে এল অফিস থেকে। রজতের ভিতরে একটা তোলপাড় চলছে। যতক্ষণ না ঝড়টা আছড়ে পড়ছে শান্তি নেই তার। মার বিরক্তি ভরা গলা শুনতে পাচ্ছে সে। বাবার কাছে বলছে “জানো তোমার গুণধর ছেলে কি করেছে আজ?” বাবা কথা বলছে না কিছু - টাই খুলছে জামা খুলছে, তোয়ালে নিয়ে স্নানে যাওয়ার আয়োজন করছে আর মা বলে চলেছে, গলায় আর্দ্র বাষ্প। “সে আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে ওই অসভ্য রকবাজ গুলোর সঙ্গে খেলতে নেমে গেছে। পইপই করে বারণ করেছিলাম ওদের সঙ্গে মিশতে । পড়াশোনার নাম গন্ধ নেই ওই বস্তির ছেলেগুলোর, স্কুলের মেয়েদের টিটকিরি করে, মদ গাঁজা সিগারেট কিছুই বাদ নেই, বাবু গেছেন ওনাদের সঙ্গে ভাব জমাতে। খুব পা বেড়ে গেছে, আর এর জন্য তুমি দায়ী।” “ছি ছি আমি অর্কর মার কাছে মুখ দেখাবো কি করে? এতো ভালো স্কুলে পড়াচ্ছি আর এই সব বন্ধু হবে তোর?” বাবা মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলো, “খালি তো খেলেইছে রাত পর্যন্ত তো আর আড্ডা মারেনি?” কিন্তু মা ঝাঁঝিয়ে উঠে পরিষ্কার করে দিল, “তবে খেলুক ও ওদের সঙ্গে আমি আর নেই তোমাদের কিছুতে।” হঠাৎ রজতের মনে হল মায়ের এই ভুলগুলো ভাঙ্গানো দরকার। সে পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে মাকে বলল, “মা ওরা গরীব হতে পারে, ওদের বাড়িগুলো ছোটো হতে পারে, কিন্তু ওরা তুমি যা বললে তা করেনা, ওরা অতোটা খারাপ তো নয়ই বরং মানুষের দরকারে ওরা সব ফেলে এগিয়ে আসে।” মা আরো রেগে গেল এতে। বলে উঠলো “বাঃ, কথাও তো ফুটেছে বেশ। তা যাও না ওদের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসে থাকো রাত বারোটা পর্যন্ত। বিড়ি আর খৈনি মুখে পুরে, মেয়েদের দিকে তাকিয়ে প্রেম নিবেদন কর। আমি বাধা দেবনা।” বাবা মাথা নাড়াতে নাড়াতে বাথরুমের দিকে স্নান করতে চলে গেল। মাথা নিচু করে থেকে খানিক বাদে রজত ফিরে এল স্টাডিতে। সোশ্যাল সাইন্স বইটা পড়ছিল সে, খোলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল আনমনে। অন্যদিন তার পড়তে বসলে ঘুম পায়না। আজ ও হঠাৎ বইয়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।

প্রচণ্ড কান্নার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল রজতের। অর্কর মা এসেছে। ঘুম-চোখে প্রথমটা বুঝতে পারলোনা কি হয়েছে। দেওয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ যেতেই দেখলো রাত দশটা পনেরো। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে বিশ্বাসই করতে পারলোনা। আরো অবাক হল ভেবে যে কেউ তাকে ডাকলো না। সচরাচর মার বা বাবার ডাকার কথা তাকে কারণ তারা ডিনার করে সাড়ে নটায়। সে কান পাতলো ড্রয়িংরুমে। অর্কর মা কাঁদছে। সে উঠে এল। অর্ককে দেখতে পেল, ভ্যাবলার মত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলো কিছু একটা ভয়ঙ্কর ঘটেছে। সে অর্কর কে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেই বুঝতে পারলো, অর্কর বাবা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছে, সাড় নেই শরীরে, কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় হচ্ছে না। রাত হয়েছে বলে বাকি ফ্ল্যাটের লোকেরাও সেরকম গরজ করছেনা। রজতের হঠাৎ, বুড়ো, মিন্টু, শম্ভু, কান্তি, পচা, গোপালের কথা মাথায় এল। একটা বিদ্যুৎ চমকের মত ছিটকে ও বেরিয়ে গেল, ক্লাবের দিকে। এখনো ওরা আছে। ক্যারামের খটখট আওয়াজ হচ্ছে। ও দৌড়ে গিয়ে ওদের কাছে সব বলল। পাঁচ-মিনিটে অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় হল। কাকুকে আইসিউ তে ভর্তি করতে লাগলো আধঘণ্টা। ভোররাতে বাবা হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানালো ভয় কেটে গেছে, অ্যাটাকটা সিভিয়র ছিল আর একঘণ্টা দেরি হলে সব শেষ হয়ে যেত। ডাক্তাররা লাগাতার চেষ্টা করে ব্লাড সার্কুলেশন নর্মাল করে দিয়েছেন। রজত মার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। তারপর নরম করে ছুঁয়ে দিল মাথাটা। বিড়ালের বাচ্চার মত মুখ লুকালো মায়ের বুকে। খুব নরম সুরে বলল মা – “ভুল হয়ে গেছে , আর হবে না”। দূরে আকাশের রঙ কমলা হচ্ছে। প্রথম কাকটা ডেকে উঠলো হঠাৎ। মা আস্তে করে নরম গলায় বলল “জানিস ওরা এখনো ওখানে আছে রে”। “তুই ওদের কাল বাড়িতে আসতে বলিস। আমার ছেলেটাকে বড় করে দেওয়ার জন্য ওদের প্রত্যেকের আমার হাতে মার খাওয়া দরকার”। রজত মাকে জোরে চেপে ধরলো। এই মাকেই সে খুব ভালোবাসে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র