সন্দীপ কুমার মন্ডল - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

সন্দীপ কুমার মন্ডল

ফ্যান্টাসী



এক রকবাজের কাছে আবদার এলো রকবাজি নিয়ে লেখার। একটা সময় প্রচুর রকবাজি করেছি কিন্তু রকবাজি নিয়ে লেখার কথা কখনো মাথায় আসেনি। কলেজ থেকে ফিরেই পৌঁছে যাওয়া চাই-ই চাই ঠেকে। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেছে সময়। 

বর্ধমান থেকে সকাল সাতটা আটত্রিশের আসানসোল লোকালে জার্নি করা আর যুদ্ধে যাওয়া দুটোই সমান কথা। রীতিমত লড়াই -লড়াই ব্যাপার। এই সময়ের এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোরও একই হাল। দাঁড়াবার পর্যন্ত জায়গা পাওয়া যায়না। একটা সময় মানে এই হয়তো আট দশ বছর আগেও এই রুটের ট্রেনগুলো ফাঁকাই যেত। একে একে কল-কারখানাগুলো সব বন্ধ হয়ে যেতে লাগালো আর যারা গ্রাম গ্রামান্তর থেকে এই কারখানায় কাজের ভরসায় দূর্গাপুরের বাসিন্দা হয়ে উঠেছিলেন সবাই একে একে যে যার স্বভূমিতে ফিরে এসেছিলেন। বর্তমানে বেশ কিছু কলকারখানা পুনর্জীবন লাভ করেছে। কিছু নতুনও হয়েছে। বড় বড় শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, বিপিও টিপিও হয়েছে আর তাদের সব ঝক্কি সামলাচ্ছে এই ট্রেনগুলো। 

আমাকে অবশ্য লোকাল ট্রেনেই যেতে হচ্ছে কারণ আমি যে স্টেশন থেকে উঠেছি সেখানে এক্সপ্রেস দাঁড়ায় না। ট্রেনে উঠে এখন টার্গেট যতটা সম্ভব ভিতরে ঢুকে যেতে হবে। এই রুটে মাঝে মধ্যে যাওয়া আসা করার সুবাদে জানি দূর্গাপুরে বেশ কিছু সিট খালি হবে। তাদের মধ্যে একটা দখল করতে পারলেই আসানসোল পর্যন্ত নিশ্চিন্ত।

ট্রেনের ভিতরে তখন ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে রীতিমতো আড্ডার মেজাজ। রকের আড্ডা এখন ট্রেনের কামরায় শিফট করেছে। তাদেরই বা কি দোষ। বাঙালী চিরকালই আড্ডাপ্রিয় জাতি। ফ্ল্যাট কালচার আর নিরাপত্তার খাতিরে বক্স সিস্টেম বাড়িতে গ্যারেজের জায়গা বের করতে গিয়ে রক ব্যাপারটাই তো অবলুপ্ত। সময় পরিবর্তনশীল। দেশকাল, সমাজ, সংস্কৃতির সাথে রকবাজিও পরিবর্তিত। 

“রকবাজি” শব্দটা চটুল অর্থেই বেশী ব্যবহৃত হয়। যেন এটা ওই লুচ্চা-লাফাঙ্গাদেরই কাজ। অথচ এটা “রকে বসে আড্ডা” বইতো আর কিছু নয়। কলেজ ফেরার পর মশার কামড় খেতে খেতে বিকেল গড়িয়ে রাত অবধি ফুটবল থেকে ফুলওয়ালি, দূর্গাপূজো থেকে দাউদ ইব্রাহিম। সানিয়া মির্জা থেকে সানি লিওন বাকযুদ্ধ।

রকবাজিতে আড্ডার বিষয় সাধারনতঃ আড্ডাবাজদের বয়স অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। যেমন কলেজে পড়া ছেলেদের বা সবে কলেজ ছাড়া ছেলেদের আড্ডার মূল বিষয় “মেয়ে”, “নেশা”, “নতুন নতুন গালিগালাজ”, ও “খেলা”। তুলনায় একটু বেশী বয়সের মানে ওই তিরিশোর্ধ রকবাজদের বিষয় হতে পারে “ওই উঠতি যুবকদের রকবাজি”, “পাড়ার বৌদি”, “রাজনীতি” থেকে “স্টারডম স্ক্যান্ডাল”। তবে এটাও ঠিক আড্ডা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে আটকে থাকে না। তাস খেলার ব্রিজ চলে যায় ওভারব্রিজে, মহাকাল চলে যায় কালপুরুষে। মাথার চুল চলে যেতে পারে চুলকানিতে। সব্জির দাম হয়ে যেতে পাওলি দাম। আড্ডা কোথায় কোথায় না চড়ে বেড়ায়।

রকে বসে গোষ্ঠীগত আড্ডা হলেও ট্রেনের আড্ডা সব গোষ্ঠীর সীমানা পেড়িয়ে। প্রাইভেট কোম্পানির বছর ছাব্বিশ-আঠাশের সেলসম্যান যুবক থেকে পঞ্চাশোর্ধ কোর্টের উকিল থেকে মধ্য ত্রিশ স্কুল টিচার থেকে রিটায়ারমেন্টের অপেক্ষায় থাকা সরকারী অফিসের বড়বাবু সব যেন এক রকের রকবাজ। অবাক হতে হয় যে যার নিজের পেশা ভুলে কিভাবে রকবাজিতে সামিল হন। রকবাজি কোনদিনই খারাপ কিছু ছিলনা। বরং একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবনে একটু মুক্তির স্বাদ। কোনো গন্তব্যহীন উচ্ছ্বাসে নিজেকে ভাসিয়ে সারাদিনের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি থেকে মুক্ত হওয়া। আবার একেবারেই যে খুব ভালো কিছু ছিল সেটাও বলা যায় কি! “কে তুমি নন্দিনী” বলে পিছন থেকে কাউকে ডাকলে কোন মেয়েরই বা ভালো লাগবে! জিন্স টি-সার্ট পড়া স্কুল টিচার তাঁর পেশা ভুলে অনায়াসে ভরা ট্রেনে গালি দিলে তাঁর সম্মানটাই বা কোথায় এসে দাঁড়ায়। উকিল তাঁর বাড়িতে থাকা যুবতী মেয়ের কথা ভুলে গিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে কোনো কলেজের মেয়েকে টিজ করলে তাঁর কোন পিতৃত্ব অবশিষ্ট থাকে। ষাট ছুঁই ছুঁই ব্যক্তি যখন বলেন ‘বাছুরদের সঙ্গে নিয়ে গাই চরতে গেছে, তাই গরু মাল মারছে’, তিনি তাঁর পুত্র পুত্রবধূদের জন্য কতটা সম্মান বরাদ্দ রাখলেন। 

সেই সময়ের আড্ডায় কিছুটা হলেও শালীনতা বোধটুকু অন্তত ছিল। চরম খিস্তি-খেউরের মাঝে কোনো বয়ঃজ্যোষ্ঠ্যকে দেখলে সিগারেটটা আড়াল করতাম। অশালীন কিছু আলোচনা হলে চুপ করে যেতাম। উনি পেড়িয়ে যাবার পর আবার শুরু হতো। তখন রকবাজিটা মূলত ছিল বেকার ছেলেদের বা কলেজেপড়া ছেলেদের। এখন এই বিশেষ গোষ্ঠীর রকবাজি এক জগাখিচুড়ি রকবাজিতে পরিণত হয়েছে। 

এই দলেরই কোনো একজন ট্রেনেরই কোনো মহিলাকে টোন টিটকারিতে এমন পর্যুদস্ত করলেন মহিলা হয়তো মনে মনে গালমন্দ করতে করতে স্থান পরিবর্তন করলেন আর আড্ডাবাজদের মধ্যে হাসির হিল্লোল বয়ে গেল। অথচ দেখা গেল সেই ভদ্রমহিলার মেয়েকেই হয়তো স্কুলে গিয়ে বিবেকানন্দ নেতাজীর নীতিবাক্য শোনাচ্ছেন জিন্স টি-শার্টের শিক্ষক মহাশয়। বা হয়তো কোর্টে গিয়ে ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে জোর সওয়াল করছেন এদেরই একজন। 

রক উঠে গেলেও আড্ডাপ্রিয় বাঙালীর রকবাজি থামেনা। থামবেনা। ঠিক যেভাবে পেশায় নিযুক্ত মানুষেরা আড্ডার সময়ের অভাবে তাদের আড্ডার জায়গা শিফট করে নিয়ে গেছেন আসা যাওয়ার পথে বাস ট্রেন বা অন্য যানবাহনে। কলেজের ছেলেমেয়েরা বা অফিসের পড়েও যারা কিছুটা সময় বাচাতে পারেন তাদের জন্য সিসিডি বা শপিং মলগুলো। আড্ডা মরেনি। শুধু নাম বদলে গেছে...... “হ্যাঙিং আউট”।















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র