বিদ্যুৎলেখা ঘোষ - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

বিদ্যুৎলেখা ঘোষ

রকি পাটোয়ারী



- আয় আয় ভিতরে আয়, উঃ কী ঘুম রে বাবা! 
মনিমা’র ডাকে চোখ কচলে উঠে বসে জিজ্ঞাসা করল রকি :
- কী হয়েচে মনিমা ?
- ভিতরে আয় ঝড় উঠেছে। শুনবিই বা কীকরে, ঘুমোলে তুইতো মড়া।
রকি তখন ওর বিছানাপত্র নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে একপাশে মেঝেতে এসে শুয়ে পড়ে। রকি ছেলে নয়, ও একটা মেয়ে। কোনো মা যেন তাকে জন্ম দেয়নি। পথের ধারে গজিয়ে উঠেছে আগাছার মতো অনাকাঙ্খিত। 

দক্ষিনাপণের পিছনদিকে মনিকা গুহর বাড়ীর সামনে একটা আড্ডা মারার ভালো জায়গা তৈরি করে দিয়েছিলেন মনিকার স্বামী ঁসুগত গুহ। সেই রোয়াকেই থাকে মেয়েটা কোন ছেলেবেলা থেকে। দিনে দিনে সবার মুখে মুখে নাম ও জুটে গেলো ‘রকি’। রোয়াকে থাকে, ঘর পাহারা দেয়। এন জি ও –তে কাজ করতেও যায়। মনিমা স্নান করতে খেতে দেন। তিনি চেয়েছিলেন রকি ঘরের কাজ করুক কিন্তু সে যে মুক্ত বিহঙ্গ। পথের মেয়ে বলে কি না জানা নেই, ও বেশীক্ষন ঘরে থাকতে পারেনা। রোয়াকে গিয়ে বসে পা ঝুলিয়ে যতক্ষণ না সুইই সুইইইই করে সিটি মারতে পারছে ততক্ষন ওর স্বস্তি হয় না। জামাকাপড় এপাড়া ওপাড়ার দাদাদের থেকে জুটে যায়। শার্ট প্যান্ট পরে। কখনো চুড়িদার নাইটি এসব কেউ দিলেও পরে না। হাবভাব ও দাদা গোছের। নারীত্বের কোনও আভাষ লালিমা ওর মধ্যে নেই। একদিকে ভালই যে কোনও পুরুষ তাকে সেভাবে দেখার কথা মনেও আনে না।

রকি কোনোদিন কারো থেকে এই দাও সেই দাও বলে কিছু চায় না। ঢাকুরিয়া রেল বস্তি লাগোয়া একটা এন জি ও তে হোম আছে , যেখানে প্রতিবন্ধী মেয়েরা থাকে। রকি ওদের পায়খানা পেচ্ছাপ এমন কী ন্যাপকিন পাল্টাতেও সাহায্য করে। ওর ঘেন্না পিত্তে নেই এসব কাজে। আশাদীপের দিদিমনিরা তাকে টাকা দেন মাস মাইনে নয়, রোজ হিসেবে। লেখাপড়া যতটুকু শিখেছে ওখানেই।হোমের মেয়েরা ওকে রকি দা বলে ডাকে। রকিও ঠাট্টা করে বলে : 
- রকি দা বলিস কেন? খুব রস হয়েচে না কী? এমন চেপে ধরবো না, সব রস নিগড়ে বার করে দোব। 
এসব কথা শুনে মেয়েগুলো হেসে গড়িয়ে পড়ে এ ওর গায়ে। কারো দুটো হাত নেই। কারো হাত যদিবা আছে সে অকেজো। পা আছে তো পোলিওগ্রস্ত। এই মেয়েগুলোকে অপরিমেয় ভালবাসে রকি। নিজে একটুও অনাথ অসহায় পথের মেয়ে বলে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে না। দিব্যি নকলি টার্কয়েস রিষ্টব্যান্ড পরে কলার উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর কেউ থাকুক না থাকুক মনিমা তো আছে।
অনেকের কাজ করে দেয় রকি , যে যেমন বলে। মৈত্রজেঠু পঞ্চাশটাকা সব্জিবাজার করতে দিয়াছিলো। বাজার করে হিসেব বুঝিয়ে দেবার সময় জেঠু জিগেস করল :
- আর পাঁচটাকা কী করেছিস?
- কেন? আমার ট্যাক্স, বাজার করেদিলাম তার জন্য?
- সেকথা তো ছিলোনা।
- নাও তোমার পাঁচটাকা আর কখনো কিছু বোলো না। সালা কাজ করাবে, পয়সা দেবে না! মাগনা পেয়েচ নাকি গো?
- ওঃ বাবা, ঘাট হয়েছে নে নে। কাল একটু বেশী বাজার করতে হবে। লোকজন আসবে বাড়ীতে বুঝেছিস।
- ঠিক হ্যায় কিন্তু পঞ্চাস টাকায় পাঁচটাকা, দেবে তো ডেকো। বেসি বাতেলা ভাও লাগেনা।
- বদমাইশ মেয়ে! টাটা বিড়লার ঘরে জন্মালে কারবার জমিয়ে দিতে পারতিস। 
খ্যা খ্যা করে কেমন কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসে রকি। 
গরমের ছুটি বলে আলাদা কিছু নেই হোমে। তবে মে মাসের শেষ পনেরোদিন আবাসিক দিদিমনিরা যার যার নিজের বাড়ীতে চলে যান। দুর্গাপুজোর পরেও তাই। এই সময়টা হোম কীরকম যেন নিঃঝুম লাগে।এসময়ে অনেকবারই ও দুপুরে থেকে গেছে মেয়েদের সঙ্গে। সুপার টা খুব রাগী। অন্যায় করলে মারেও আবার এই মেয়েদের।পয়লা জানুয়ারীর পিকনিকের পর হোমে কাজে এসে সবিতা কে দেখতে না পেয়ে দিদিমনিকে জিগেস করলো। দিদিমনি বলল সুপার জানে। ওই রগচটা লোকটার সামনে জেতেও ভালোলাগেনা যে সামনে গিয়ে জিগ্যেস করবে কোথায় ও, বাড়ি গেলো বা আবার আসবে কি না। চলতে লাগলো সব গতানুগতিক। আগের মে মাসে চলে গিয়েছে রেহানা। বাড়ীতে গেলে বলে যেতে কী মুখে ব্যথা করে? মনে মনে গজগজ করতে করতে কাজ সেরে রোয়াকে না বসে ঘরে ঢুকে মনিমা কে ডাকতে থাকে। পেটের ভিতরটা কেমন যেন হচ্ছে।সুজনকে দেখে বলল :
- মনিমা কোতায় গো? সাড়া পাচ্চিনা কেন?
এঘর ওঘর ঘুরে রকি ডাকছে মনিমাকে আর মনিকা সুগত’র ছেলে সুজন কেমন হতবাক হয়ে রকির আধাময়লা স্কাইরঙা জিন্সের পিছনটা দেখছে বারবার।
- কী সুজন দা ? ওর’ম বমকে গেলে কেন?
সুজন আঙুল তুলে রকি কে কিছু বলতে গেলে মনিমা এসে ব্যাপার-স্যাপার দেখে একটা ঘরে নিয়ে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো :
- কখন শুরু হয়েছে?
- ক্কী কী গো মনিমা? আমি কিছু করিনি তো?
- তুই করবি কেন, কপাল করেছে?
- কী হয়েচে ফস্কে বলো না।
- তোর জিন্সের পিছনটা রক্তে ভিজে গেছে।
- কী করে? আমারও জানো তো মনে হচ্চিলো কিচু হচ্চে। ভেজা ভাব বুয়েচি কিন্তু খোলসা বুজিনি।
মনিমা বুঝিয়ে দিলো নারী হয়ে ওঠার বর্ণপরিচয়। এসময়ে জিন্স না পরে চুড়িদার পরার কথা। রকির অবশ্য ওড়না, শাড়ি দুচক্ষের বিষ। কিন্তু সুজনের বিস্ফারিত দৃষ্টি তার মধ্যে প্রথম লজ্জা আড়াল টানলো। কোনোমতে ঐদিনগুলো চুড়িদার পরে কাটায়। তারপর আবার জিন্স, ফুর্তি। মুদি দোকানের গনু দা ফ্রী বিড়ি খাইয়ে অভ্যাসটা জমিয়ে দিয়েছে।
আন্দাজমতো রকির বয়েস এখন আঠারো ঊনিশ হবে। মনিমা বলেছে চেক শার্ট পড়তে। ও নিজেও খেয়াল করেছে এক কালারের গেঞ্জি পরলে সামনেটা কেমন মেয়ে মেয়ে লাগে। মনিমা দিদিমনি আর ঐ হোমের মেয়েরা ছাড়া আর কোনও মহিলা ওর পছন্দ নয়। কীরকম যেন ন্যাকা ন্যাকা ভাব সবার। তিনা মানে তৃণা দি’কে তো পুজোর সময় এক প্যান্ডেল লোকের সামনে খিস্তি করে ভূত ভাগিয়ে দিয়েছিল। অঞ্জলি দেবার সময় নেশা করা নিয়ে কিছু বোধহয় ঠেশ মেরে বলেছিল তৃণা। রকি উত্তর দিয়েছিল :
- বেশ করি নেশা করি। সালা গতর খাটানো পয়সা দিয়ে নেশা করি, গতর বেচা পয়সা দিয়ে না। যাও যাও সতীপনা মারিয়ো না। জানি জানি কে কোথায় কী করে বেড়ায়।

এবার দোলের সময় ভাঙ খেয়ে নেচে কুঁদে পাড়া জমিয়ে দিয়েছিল রকি। ঘরের জানলা থেকে সুজন ও মুখ বাড়িয়ে দেখছিল মজা। ওই ঘোরের মধ্যেও যেন অবাক লাগলো রকির।মনে মনে আলাপ চলছে কেবল, বাড়ন্ত একটা মেয়ে রাস্তায় নেশা করে বেহায়ার মতো নাচছে কই, সুজন দা তো রাগ করছে না। কেন করছেনা রাগ? ওর কেউ না বলে? প্রথম স্রাবের দিনের সেই বিস্ফারিত হতবাক দৃষ্টিতে যেন কত আপন জিজ্ঞাসা ছিল। এই খুশিমাখা দৃষ্টিতে তো কোথাও কোনো আত্মীয়তা নেই। কষ্ট হচ্ছে যেন ভিতরে। কোথায় কষ্ট কীসের কষ্ট বুঝতে পারে না রকি। আবার ভাবে, যাকগে সুজন দা এমনিতেও লেডিস লেডিস। মা আর পড়াশুনো ছাড়া কিছু জানে না। মনিমা যখন থাকবে না কী যে হবে হোঁদলটার। এরপর মনিমা এক হ্যাঁচকায় হিড় হিড় করে টেনে রোয়াকে এনে বসিয়ে দেয়। ওখানেই লেৎকে ঘুমিয়ে পড়ে। 

দিদিমনিরা থাকুক না থাকুক কাজ করতে হোমে যেতেই হয়। মাঝে মধ্যে ওদের সঙ্গেই খেয়ে গল্প করে দুপুর কাটিয়ে দেয়। সেদিনও মেয়েদের সঙ্গে গল্পই করছিল। চিল কান্নায় ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দৌড়ে দেখতে যেতে চাইলে মেয়েরা পথ আটকে বলল :
- যেওনা ওখানে, দেখতে পেলে তোমাকেও মারবে। 
ওদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে যেদিক থেকে শব্দ ভেসে আসছে ছুটে গেলো সেদিকে। হ্যাঁ সুপারের ঘর থেকেই কান্না ভেসে আসছে। দড়াম করে দরজা খুলে দেখে দুটো হাত নেই ভরাট শরীরের প্রিয়াঙ্কার উপর চরাও হয়েছে সুপার। প্রিয়াঙ্কাকে প্রথমে মেয়েদের ঘরে পাঠিয়ে কলার উঁচিয়ে সুপারের দিকে চাইতেই সুপার চোখ রাঙিয়ে বলে উঠল :
- কিস্যু করতে পারবিনা আমার। সব কেনা আছে রে। ভালো চাস তো মুখ বন্ধ রাখবি। না হলে চালান করে দেব ওদের মতো।
রকি সজোরে লাথি চালায় সুপারের তলপেটে। কেঁউ কেঁউ করে তখন বলে :
- কাউকে কিছু বললে তুই পার পাবিনা। ভালো কথা শোন। আমি তোকে বিয়ে করতে পারি যদি তুই মুখ বন্ধ রাখিস। ভেবে দেখ রাস্তার মেয়ে তুই। এমন সুখের কপাল আর কোন দিন হবে না তোর।
এবার সরাসরি মুখের উপর বাঁহাত চালিয়ে মেঝেতে পেড়ে ফেলে সুপারকে। বুকের উপর চেপে বসে চীৎকার করে জিগ্যেস করে :
- অনেক টাকা না রে সালা তোর? বড্ড সুলুনি? এই ছুরি দেখেছিস? কুঁচো কুঁচো করে দোব। বল সালা মেয়েগুলো কোথায় যায়, কোথায় পাচার করিস ওদের। বল বল বল
- বোম্বাই আরবে পাচার হয়।আর তারপরে কঙ্কাল বিক্রি হয় অনেক দামে
রকি তখন মহাঘোরা ছিন্নমস্তা এলোপাথাড়ি কিল চড় লাথি ঘুষি চালিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে মেয়েরা লোকজন ডেকে জমা করে ফেলেছে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেলো সুপারকে।
আকস্মিকতায় একটু চুপচাপ এখন। হোমে মহিলা সুপার এসেছে। একটা বাড়তি কাজ নিজেই ঘাড়ে নিয়েছে। প্রতিদিন গুনে রাখে মেয়েদের। সন্ধ্যাবেলা চৈতি জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে গুহ বাড়ীর রোয়াক। সুজন বাইরে এসে রোয়াকে বসলে তার দিকে না তাকিয়েও ও ভালই জানে সুজন এখন চাঁদের দিকে তাকিয়ে কোন গান ভাঁজছে আপনমনে। রকি ভাবছে, মনিমা যখন থাকবেনা রকির কী হবে? ওকে কী সুজন দা তাড়িয়ে দেবে? বুড়ো মানুষদের জন্য তো আয়া দরকার হয়। ঘরের মেয়ে বউ’রা এসব কাজ পারে না। এই কাজগুলো রকি ভালো পারে।তাহলে মনিমা বুড়ো হলে তাকে দরকার হবে। সুজন দা’র বউ এলে কী সে তাকে তাড়িয়ে দেবে? ওদের যখন বাচ্চা হবে তখনও আয়া লাগবে। এসব ভেবে নিশ্চয়ই সে তাড়িয়ে দেবেনা। ফ্রী বিড়ি আছে, গনু দা আছে, বিলা হয়ে গেলে রোয়াক আছে আর কী লাগে? হি হি হি...সালা হারামি টা বলে বিয়ে করবে থুঃ থুঃ থুঃ...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র