হাসনাত শোয়েব - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

হাসনাত শোয়েব

এই নষ্ট শহরে নাম না জানা যেকোন মাস্তান



রক বলতে আমি কেবল গানই বুঝতাম। অতি অবশ্যই সেটা ব্যান্ডের গান। আর যারা সেই গান এবং গানের দলের সাথে যুক্ত তাদেরকে বলে রকার কিংবা রকবাজ। কাঁধে গিটার, মাথায় লম্বা চুল। কারো কারো হাতে ট্যাটু আঁকা। এছাড়া রকবাজদের চেনার আরো অনেক অনেক উপায় তখন আমরা বের করেছিলাম। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে কখনো কখনো সেইসব রকারদের দেখা মিলতো। এইভাবে আমার রকবাজদের সাথে পরিচিতি।

দূর থেকে দেখতাম। আর ভাবতাম কখন সেই রকবাজদের মতো করে একটা দিন কাটাবো। কখনো কখনো তাদের সেই গিটার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে পারলো অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করতো। একদিন পাড়ার রকবাজরা হারিয়ে যায়। নতুন রকবাজ আসে। তারাও হারিয়ে যায় আবার নতুন কেউ আসে। হঠাৎ একদিন খেয়াল করি পাড়ার সেই চায়ের দোকানে আমরাই বসে আছি রকবাজ সেজে। গিটার বাজিয়ে ঘুম ভাঙা শহরকে জাগিয়ে তুলতে তুলতে মানুষ পাখির গানের দিকে চলে যেতাম। কিংবা পাড়াতো মেয়েদের দিকে আলতো করে ছোঁড়ে দেওয়া ফেয়ার ওয়েল অ্যান্জেলিনার সুরের সাথে রঞ্জনাদের পাড়ার দিকে আর কখনো না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা। এভাবেই সব চলছিলো। হঠাৎ একদিন দেখি সেই চায়ের দোকানে আমরা আর নেই। এখন হয়তো অন্য কোন রকবাজ বসে রক দুনিয়ার গল্প করছে দিনরাত। হয়তো নতুন নতুন বাকের ভাইয়ের আগমনে চায়ের দোকানটা সরগরম হয়ে উঠছে প্রতিদিন।

আমাদের কাছে তখন ইউনিভার্সাল রকগুরু ছিলো নগরবাউল জেমস। সেই মেডিক্যালের কনসার্টে প্রথম সামনাসামনি দেখা। আমরা সকলে হতে চাইতাম জেমসের মত। ভাবতাম একদিন গিটার হাতে লেইস ফিতা লেইস গাইতে গাইতে মাতিয়ে দেবো পুরো ক্যাম্পাস। জেমসকে দেখেই আমার রকবাজ হতে চাওয়ার গল্প। পরে ওয়ারফেজ কিংবা আর্টসেলরা সে আগুনে ঘি দিয়েছে। তাই ‍হাতে গিটার তুলে নেওয়া। অর্ধেকেই থেমে গেছে আমার রকবাজ হতে চাওয়ার গল্প। তবে এখনো কী সে স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়েছি। এসব স্বপ্ন হয়তো কখনো বাদ দেওয়ার নয়।

এইসব রকবাজরা শহরের প্রাণ। বিভিন্ন মাত্রার রকবাজ এই শহরে দেখা যায়। কখনো গান বা কবিতা অথবা খেলাকে কেন্দ্র করে এইসব রকবাজদের গড়ে ওঠা। তারা কখনো বাকের ভাইকে দেখে, কখনো জেমস বা বিটলস অথবা আবুল হাসানদের দেখে জেগে উঠেছে। নতুন নতুন আইকন নিয়ে ফিরে এসেছে বারবার। এখন হয়তো মাশরাফি কিংবা সাকিবদের নামও রকবাজদের অনুপ্রেরণার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। 

রকইজমে বাকের ভাই তো অনবদ্য ফেনোমেনা। নাটকে যার ফাঁসির প্রতিবাদে বাস্তবে মিছিল হয়েছিলো। এখনো রকবাজেদের তালিকায় বাকের ভাইকে আইকন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হুমায়ূন আহমেদই মূলত এই রকবাজ বাকের ভাইয়ের স্রষ্টা যাকে পরে আসাদুজ্জামান নূর কিংবদন্তি চরিত্রে রূপ দিয়েছে। 
‘এই নষ্ট শহরে
নাম না জানা যেকোন মাস্তান,
সকল খিস্তি খেউর রাজা উজির মেরে
মাস্তানি সব সেরে,
বিকেল বেলা তোমার বাড়ির লাগোয়া পথ ধরে
যাচ্ছে যখন ফিরে,
ভুলে নাহয় দিয়েই ছিল শিস
হাত ছিল নিশপিশ
ছুঁড়ে নাহয় দিয়েই ছিল চিঠি!’
ফরহাদ মজহারের লেখায় সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া এই গানের মতো অনেক গল্প খুঁজে পাওয়া যায় রকবাজদের জীবনে। প্রতিনিয়ত প্রেমে পড়া এবং আবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার গল্পই যেনো রকবাজদের নিয়তি। আমাদের মধ্যবিত্ত সোশ্যাল ডিসকোর্স তাদের বরাবর তাদের বখাটে হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মূলত এই শহরের রকবাজদের বুঝতে চাওয়ার প্রবণতা আমাদের এখানে তৈরি হয়নি। হলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা হয়তো এড়ানো যেতো। নিজ পরিবারেও তারা ব্রাত্য হয়ে থাকে অনেক সময়। যার ফলে অনেক রকবাজ হয়তো শেষ পর্যন্ত অন্য পথে পা বাড়ায়। যদিও সে প্রবণতা থেকে হয়তো রেব হয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে এখন। 
‘‘‘স্বীকার করে বলি
এসব কাণ্ড খারাপ ছেলে করে,
আর স্বীকার করে বলি
এসব কাণ্ড খারাপ ছেলে করে।
তবু মেয়ে
প্রেম তবু তার মিথ্যে ছিল না
মিথ্যে ছিল না।’
হা উল্লেখিত গানেরই পরের অংশ এটি। হয়তো এমন দিন আসবে যখন মেয়েটি ভালো না বাসুক অন্তত ছেলেটির প্রেমকে বুঝতে শিখবে। মেয়েটির সাথে সাথে আমাদের সামাজিক ডিসকোর্সেও ছেলেটির যৌক্তিক মূল্যায়ন শুরু হবে। তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হবে। কে জানে, তখন প্রত্যাখ্যান থেকেই হয়তো তৈরি হবে দুর্দান্ত একটি রকবাজ জেনারেশন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র