জয়া চৌধুরী - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

জয়া চৌধুরী

এক রকে রক্ষে নেই তায়...



‘রক; শব্দটি কর্ণে প্রবেশ করা মাত্রই ইদানিং ছোটবেলায় আঁকা গ্রামের দৃশ্য মনে পড়ে যায়। সেই যে সাদা কাগজে উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো বস্তুটি যার মাঝখানে দিয়ে একটি শীর্ণ নদী বয়ে যাচ্ছে সামনে একপাশে ধানখেত আর অন্যপাশে বাংলার কুঁড়ে ঘর আঁকে নি এমন কোন বাঙালি বাচ্চা আছে? প্রথম শোনায় আমাদের মধ্যে যারা এট্টু ডানপিটে তারা এক্কেবারে সেই উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো রকে ক্লাইম্ব করতেও পিছপা হয় না। কলকাতা শহরে জন্মাবধি রয়েছি তাই আমার নজরের দৌড় চার্ণক বাবার তৈরি এই নগরেই ঘোরাফেরা করে। সেদিন কোনো এক পত্রিকালব্ধ জ্ঞান হল যে স্থাপত্যবিদেরা কলকাতা শহরটার বাড়ি ঘরের চরিত্রই নাকি উত্তর স্বাধীনতা কালে বদলে দিয়েছেন। সাহেবদের লন্ডন যেমন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে নিজেকে বদলেছে কলকাতা নাকি তেমন পারে নি। স্থপতিরা তার সাড়ে সব্বোনাশ ঘটিয়ে রেখেছেন। এই যেমন এখন আর কোন বাড়িরই সেই দুই অংশ হয় না এককালে যা কলকাতায় তৈরি দালানকোঠা –র অঙ্গের ভূষণ ছিল- চিলেকোঠা আর রক। এই ‘রক’ অবিশ্যি খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা বঙ্গ ভাষায় নির্মিত। এটিকে তখন মূলত: বাড়ির সিঁড়ির সঙ্গে লাগানো অবস্থায় দেখা যেত। প্রতিটি কোঠাবাড়িরই একটি সিঁড়ি ও তৎসহ রক ছিল উত্তর কলকাতার বাড়িগুলির একান্ত বৈশিষ্ট্য।

‘রক’ শব্দটি কে আর কোথায় পেয়েছি ভাবতে ভাবতে বেশ কিছু শব্দ আমার মাথায় খোঁচা মারতে লাগল। এই যেমন ধরা যাক ‘আরক’ বস্তুটি, এটি তরল গোছের কোন পাঁচন বলেই জানি। তবে কিনা এখানে ‘রক’ এর আগে স্বরবর্ণ ‘আ’ বসাতে হবে। আবার ‘মারক’ বলতে আঁতকে উঠবে না এমন মুর্শিদ কুলি খাঁ লোক পাওয়া মুশকিল। জাতক কাহিনীর ‘মার’ এখানে ব্যঞ্জনবর্ণ এর প্রথমটি সঙ্গে করেই সক্কলকে ভয় দেখান। ‘রক’ আমাদের এতই প্রাণনিধি যে এইটাকে আমরা শিশুদের ব্যকরণ বইয়ের মধ্যেও নিষ্ঠা ভরে ঢুকিয়ে দিয়েছি। পাঠক ভুলে গেলেন ইস্কুল পড়বার সময় কারক- বিভক্তির সেই আক্রমণ? কর্তৃকারকে আমাদের সবার আগ্রহ শুধু কর্ম বা করণে অনীহা। আমার আবার এর ঘাড়ে এটা তার ঘাড়ে ওটা লাগানোর খুব স্বভাব। তাই অধিকরণ কারক বললেই রাগ সংগীতের খেয়ালের অবরোহণ-এর কথা কেন জানি মনে পড়ে। ‘রক’ ছিলি বেশ ছিলি কেন যে ‘কা’ জুড়ে মরলি! জানিস না কি কা তব কান্তা কস্তে...? 

যে কোন ঐতিহ্য কে ধরে রাখবার জন্যও আমাদের এই রকের শরণাপন্ন হতে হয়। একবার ধাঁ করে’ধা’ জুড়ে ধারক বানিয়ে নিই। ‘ধারক’ ছাড়া কে তরিবে আর এই তরণী? আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ইত্যাদি ধরে রাখতে গেলেও এনারই পায়ে পড়তে হয় যে! এই সেদিন পর্যন্ত বাঙ্গালিদের আবেগ ‘রক’ সম্পর্কে ছিল আকাশ ছোঁয়া। আমাদের মাসতুতো জ্যাঠতুতো দাদা বড়দার আমল পর্যন্ত রক সার্থক হয়ে উঠতো কতশত ফোঁটা না ফোঁটা প্রেমের গাথায়। এই রকে বসেই গত শতকের তৃতীয় ভাগ অবধিও কত হীর রঞ্জা লায়লা মজনু রোমিও জুলিয়েট কতই না ঈশারা ইঙ্গিত চালিয়ে শেষ মেষ প্রেম ‘জারক’ রসে ডুবে ছাঁদনাতলায় দেহমন শীতল করেছে। আর প্রেমের কথা বলতে গেলেই প্রেম গুরু বাবা তারকনাথের কথা ভুলি ক্যামনে? শিশুকাল থেকে সেই ছাইমাখা জটাধারী ভোলানাথের মত প্রেমিক বা বাবা কিংবা স্বামী চায় না কজন বাঙালি মেয়ে? তারক বাবার মাথায় অমাবস্যে পুন্নিমে চতুর্দশী পঞ্চমী ঊনকোটি চৌষট্টি ছুতোয় জল ঢালে না কয়জনা? আফটার অল চিরকালই যত সব নিয়ম কানুন আচার বিচার ধম্ম কম্মের তো মেয়েরাই ধারক বাহক!

এহেন পরম দেবমন্ডপে বসে রাজা উজির মারেন নি কজন প্রৌঢ় কলকাতায় বেঁচে আছেন খুঁজে বের করুন দেখি! লাল মেঝের ঠাণ্ডা মেখে লাল রকে বসে ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ, ইন্দিরা গান্ধীর হারজিত থেকে ক্লাইভ ওয়ালকটের ভিনু মানকড়কে রক্তদান, রোহন কানহাই ওয়েসলি হলের সেই ইডেন গার্ডেনে ক্রিকেট খেলা তক কোন বিষয় নিয়ে রকে রকে আলোচনা টীকা তর্ক আন্দোলন হয় নি বলতে পারেন? এই রক কি কম জনসেবা করেছে? ঘোর গ্রীষ্মে কাশী বিশ্বনাথের জলসত্রের মত মোড়ে মোড়ে জল বিতরণের মত মহা পুণ্যি তারাও করেছে বৈকি! পথ চলতি পথিক চৈত্রের কাঠফাটা দুপুরে পথ চলতে চলতে কোন রক দেখতে পেলেই কেউ দেখছে কি না ইতিউতি চেয়ে নিশ্চিত হবার পর টুক করে রকে শুয়েই ভাত-ঘুমটা মেরে দিত। এই রকে বসেই ইন্টেলেকচুয়াল বিষয়ের হাতে খড়ি অবশ্য খুব বেশি হতো বলে শুনি নি।

আসলে রকের সঙ্গে মাটির একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধই আছে। যারা রকে বসে গপ্পো করে তারা যে গড়পড়তা মস্তিষ্ক ধারী সে বিষয়ে আঁতেলদের কোন সন্দেহ ছিল না। তারা ও কাজটা অন্য কোথাও সেরে নিতেন। এ প্রজন্ম প্রোমোটারদের চাপে ঐ বস্তু উপভোগ করা তো দূরস্থান চোখে দেখা থেকেও বঞ্চিত রয়ে গেল। আজকাল একটা সামান্য চেষ্টা হয় বটে চায়ের দোকানে এই ঠেক বানানোর...তবে সে তো ব্যবসার জায়গা। আজকাল কার অত সদয় হবার বিলাসিতা শোভা পায় বলুন? দিনকাল যা পালটে গেলো... রকে বসে জিরিয়ে ধীরে বেঁচে থাকাটাই উপভোগ করবে এমন প্রাথমিক ব্যাপারটাই আধুনিক মানুষ ভুলে গেছে। তবুও যারা সেই মৌতাত একবার পেয়েছে তাদের প্ররোচনায় উত্তর প্রজন্মের কেউ আগামীতে যদি ফ্ল্যাট না কিনে বাড়ি বানায় তাতে যেন আস্ত একটি লাল রক রাখে সেই স্বপ্নেই মজে আছি। সত্যি বলতে কি এখন দম আছে। এখনো চান্স পেলে শিরা ফুলিয়ে রকের আড্ডায় তুফান তুলতে পারি। হুঁ হুঁ বাবা আমার সঙ্গে রক নিয়ে নো রকবাজি...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র