অঞ্জলি সেনগুপ্ত - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

অঞ্জলি সেনগুপ্ত

রকবাজির গতিবদল



রকবাজি আজ ও রয়েছে , তবে গতিপথ বদলেছে মাত্র । যেমন নদীর বাঁক ঘুরে ,খরস্রোতা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাল হয়ে যায় , তেমনি আর কি ! চলার গতি বদলে গেলেও স্বভাবগতি কিন্তু সেই পিত্ত জ্বালানো মেয়ে খেপানো অভিভাবক ভ্রুকুঞ্চিত তরজা জ্ঞাপকই । পাড়ার রক থেকে ক্লাব,মেয়েদের কলেজের মোড় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর এদের গতিবিধি অবাধ । অন্তত মৃগনয়নী্র অভিজ্ঞতা তাই বলে । অনেকে সেটি র্যা গিং বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও মৃগনয়নী্ মানতে নারাজ । কারন সেই রকবাজির খপ্পর থেকে রক্ষা পান নি অধ্যাপক অধ্যাপিকা ,নবাগত পুরানো ছাত্রছাত্রী কেউ । বিশেষ করে মেয়েদের তো নিত্য বুক দুরু দুরু । অসমের গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বিখ্যাত রক দশপয়সা চত্বর আজও যথাযথ অমলিন । বছর বছর ধরে সেই মস্তানি পর্ব সহ্য করেনি এমন লোক কমই আছেন । উত্তর পঞ্চাশে এসে মৃগনয়নী্ আজও বুঝতে পারে না দশপয়সার আড্ডাবাজদের । ছোট শহরের মেয়ে মৃগ এসেছে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়য়ে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়তে । সঙ্গে রয়েছে ভাষা বিভ্রাট ও অপরিচিতের সঙ্কোচ। কে জানতো রে বাবা বিভাগে ঢোকার মুখে এমন হার্ডল রয়েছে । প্রথম মুখোমুখিতেই ঠক্কর – অই নতুন চিড়িয়া বে ! 

চিড়িয়া ? ভ্রুকুঞ্চিত মৃগনয়নী্র । এদিকে ভয়ে গলা কাঠ ! তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাঁচা যাক। 
--এই মেয়ে পালাচো কোথায় ? বলে তো যাও ইউনিভারসিটির চিড়িয়াখানাটা কোথায় ? ঢোঁক গিলে মৃগ । ডাইনে বামে মাথা দোলে জানি না । হো হো হা হা , সম্মিলিত অট্টহাসির সামনে বেচারি জুবুথুবু ।
-- থাকা হয় কোথায় ? 
-- এ,টি,থ্রি গার্লস হোস্টেল । শুকনো কণ্ঠে ভীতু জবাব টুপটাপ শিশির ঝরার মতো ।
তারপরই ঘটেছিল বিস্ফোরণটা । অ্যাটম বোমা-র মতো আছড়ে পড়লো হাসির আর,ডি,এক্স । হা হা হো হো হি হি । রকমারি হাসির আঘাতে কাঁপছে গোটা চত্বর । বুকের কাছে ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে চেঁচা দৌড় ছাড়া আর গতি কী ছিল ? বুকটা হাপরের মতো উঠছে নাবছে । সোজা হোস্টেল । সামনে সিনিয়র দিদি তপতী ঘোষ ।--কী হলো রে , হাফাচ্ছিস কেন ?
--তুমি তো একবছর আগে এসেছো , বলো তো ইউনিভারসিটির চিড়িয়াখানাটা কোথায় ?
ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি তপতীর –কেন রে কেঊ জিজ্ঞেস করেছে বুঝি ?
মৃগনয়নী্র সরল নিস্পাপ মুখের ঢলঢলে চোখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো তপতীর ।--তুই যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস, সেটাই ভার্সিটির জু ।
--বলো কী গো ? আমরা সব জন্তু?
-আরে না বাবা । ওরা মেয়েদের বলে চিড়িয়া অর্থাৎ পাখি ! কিচির মিচির কলকল । সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে ঝাঁপ ফেলে দেয় । কড়া নজরদারি , ছেলেরা ঢুকতে পারে না , তাই চিড়িয়াখানা !
আর,সি,সি বয়েজ হোস্টেলের সামনে আর একটি হার্ডল । হাফপ্যান্ট , টি সার্ট ,স্যান্ডগেঞ্জি, সিগারেট সকলেই তখন ঋষি কাপুর । ওই হোস্টেল পেরিয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে তারপর ওই দশ পয়সার বিখ্যাত জটলা ছাড়িয়ে তবেই বিভাগ ।মৃগনয়নী্ দল বাঁধে । অসমিয়া বাঙালি বোড়ো মনিপুরি নেপালি মিলে বেশ চকচকে একটি দল । সকলেরি তখন সুচিত্রা চোখ ও নীতু সিং শরীর ! মধ্যমনি মৃগনয়নী্ ।কুশিয়ারার কন্যা মৃগর শরীর জুড়ে তখন ভরা বর্ষার বান । সঙ্গে প্রমীলা বাহিনীর ঠমক চমক চাল । ব্যস জুটে গেল রক্ষাকর্তা রোমিওদের দল । এইবার দশ পয়সাকে কে ভয় পায়। 
দিন ঘুরে ,দৃশ্যপট বদলে যায় । মৃগ এখন পোক্ত , মৃগ এখন সাহসী ।মৃগনয়নী্র ফাঁদে পা দিয়েছে দশ পয়সার আড্ডাবাজরা । প্রস্তাবটা মৃগই দিয়েছিল । চল বন্ধুত্ব করা যাক । সবাই লাল গোলাপ নিয়ে এসো মেয়েদের হোস্টেলে । শনিবারের বিকেল এ,টি,থ্রি গার্লস হোস্টেলের গেইটের সামনে মশালের মতো লাল গোলাপ হাতে সারি সারি ছেলের দল । আর হোস্টেলের বারান্দায় সারি সারি প্রদীপমালার মতো মালবিকা কমলিকা নীহারিকার দল । আওয়াজ উঠলো ।‘ওই আসে ওই দশ পয়সা । ময়না গো কার জন্য এতো লালের সমারোহ’ তারপরই সন্মিলিত হাসির সুর তরঙ্গ । ঢেঊ-এর লহর আছড়ে পড়ল এ,টি,থ্রির গেইটের মজবুত প্রাচীরে । দশ পয়সার লাল গোলাপ লজ্জ্যায় বিবর্ণ ।’বিহুর নাচ ধামাইল মিলে মিশে একাকার ,শিমুলের তুলাগুলো যেমনি উড়িছে,তেমনি উড়িবার মন’। ভার্সিটির চিড়িয়াখানায় তুমুল হাসির লহর । ‘আজ সন্ধ্যায় তোর বাড়ি যাব ময়না । বের হয়ে আসিবি তুই ‘। গোলাপ নতমুখি । পালানোর পথ খোঁজে । মৃগনয়নী্ ভুলে নি প্রথমদিনের অপমান । 

--পালাবে কোথায় থেকে আগে আমাদের প্রশ্নের ঊত্তর দাওদিখিনি ভার্সিটির দশ পয়সা কারা ?
মৃগনয়নী্ আজ প্রতিষ্ঠিত বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা । সেই রক রক দিনগুলোর কথা কদাচিৎ মনে পরে । কাক ডাকা অলস দুপুরে কখনো কী মনে পরে দশ পয়সাদের চত্বরের দুরন্ত দিনগুলোর কে ? ক্লাসে রকবাজি নিয়ে ছাত্রীর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনে পড়লো বাংলা সাহিত্যের প্রথম রকবাজ সম্ভবত যমুনা পুলিনে নন্দ মহারাজের পালিত পুত্র কৃষ্ণ ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র