শৌনক দত্ত - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

শৌনক দত্ত

রকবাজ পৃথিবীটাই পাঠশালা...


ব্যাঙচাতরা রোডের রাজীবগন্ধী স্মৃতিবেদী ভেঙে এখন সেখানে মিষ্টির দোকান।তখন বেদীটা ঘিরেই আড্ডাবাজিটা হতো প্রচলিত শব্দে বিকাল গড়তেই ঠেকবাজরা আসতে শুরু করতো।যেভাবেই ভাবা হোক আর যে যা-ই বলুন,এ খুবই সত্যি কথা-অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় কোনো শিক্ষক নেই,আড্ডার চেয়ে নেই কোন স্কুল!

কোচবিহারের জেনকিন্স আর সুনীতি স্কুল ছুটির পর যারা ছুটে যেতো তেঁতুলতলায়,মুচির দোকানে সাইকেল স্ট্যান্ড করে যারা আড্ডায় মাততো তাদের যতই প্রিয় মানুষটির জন্য প্রতীক্ষিত চোখ থাকতো তার চেয়ে অনেক বেশি উঠে আসতো সমবয়সী তরুণী থেকে সুমন চাটুজ্জ্যে,রাজনীতি থেকে খেলা,সাহিত্য থেকে ইতিহাস,ভূগোল থেকে সমাজ,অর্থনীতি থেকে দেশ।

বৈভব কথাগুলো নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবে দেখেছে।একেবারে চোখের সামনে নিয়ে,চোখের সামনে নিয়ে মানে চোখ থেকে মাথার ভেতর নিয়ে আর এটা করতে গিয়েই উপলব্ধি করতে পারে অভিজ্ঞতা যা শিখিয়েছে তা শেখাতে পারেনি কেউ।আর আড্ডায় যা শুনেছে,শিখেছে,বুঝেছে তা যে একেবারে চোখের সামনে খোলা পৃথিবীর পাঠশালা।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঠেক বদলেছে।কোচবিহার ডিএম অফিসের সামনে সাগরদীঘির পাড়ে যে বেঞ্চ সেটা একসময় হয়ে ওঠে জেনকিনিয়ান্স ঠেক।বৈভবরা তখন সেখানেই আড্ডা দিতো বলা ভালো ঠেক মারতো।তখন কারো কারো ঠোঁটে সিগারেট জ্বলতে শিখেছে।সৌমজা,পৌলমিরা পাশের রাস্তা দিয়ে লাল সাইকেলের মায়া রেখে চলে গেলেও বৈভবের অনুরোধেই অঞ্জনা আর সঞ্চিতারা কখনো সখনো মায়া বুকেই আসতো ঠেকে।সাগরদীঘিতে তখন বিকাল মানেই মাইকে বাজত গান।গান কথাটি মনে পড়তেই বৈভবের চোখ জুড়ে ভেসে উঠে ম্যাগাজিন রোডের লিলি কটেজ শুভঙ্কর সিনহার এই বাড়ীর দোতালা ঘরে ছুটির দিনে প্রভাতী ঠেকটা বসতো আর সেই দুরন্ত দিনে সনু নিগমের প্রথম ফিতা ক্যাসেটে 'আব মুঝে রাত দিন'গানটি শুনতে শুনতে যে যেভাবে ছিল স্ট্যাচু হয়ে গেলো জিনিয়া আর সমর্পিতা এসে তখন অবাক!

কফি হাউজের সেই আড্ডার মতো আজ সব কিছু ধুলো মেখে স্বপ্নের বৃক্ষ। ধুলো সরাতে সরাতে রানীবাগানের সেনগুপ্ত বাড়ীর শুভজ্যোতি সেনগুপ্ত হরফে বুচুর কথা মনে পড়ে বৈভবের!এই বাড়ীতে যে পরিমাণ আড্ডা আর অত্যাচার হয়েছে তা ঐ বাড়ীর ইটে ইটে লেগে আছে।তখন সবে টুয়েলভ টেস্ট হয়েছে পিকনিক আয়োজন করা হলো ভীষণ কৌতূহলী সবাই কেননা সারারাত ব্যাপী চলবে ভিডিও দেখা তখনো সিডি ডিভিডির যুগ আসেনি।ভাড়া ভিসিপি আর ক্যাসেট এলো সাথে এলো দুটো বোতল।মাংস ভাত খেয়ে উঠতেই লিলি কটেজ থেকে ফোন সিনহা কে বাড়ী ফিরতে হবে।রাতের অন্ধকার পলকেই সবার চোখেমুখে।অনেক কিছু করেও সে রাতে বান্ধবীদের যার যার বাড়ী পৌঁছে দেয়া ছাড়া আর কিছুতেই ভিসিপি দেখা হলো না।বিনিদ্র রাত জাগল একা একা ভাড়াটে ভিসিপি আর বোতল দুটো স্পর্শহীন।টুয়েলভ পরীক্ষার পর ভবতোষের গ্রামের বাড়ী ডাওয়াগুড়িতে তাঁবু ফেলা হলো পিকনিকের,হ্যাজাক লাইটের সেই ক্ষেতের মাঝে পিকনিকে যেতে গিয়ে বাঁশঝাড়ে ভূতের ভয়ে আটকে গেলো কয়েকজন ত্রাণকর্তা হয়ে বৈভবকেই যেতে হলো।ভূটানীজ ভাস্কর বরগাও রান্নার দায়িত্ব ফেলে তাদের আঞ্চলিক মন্ত্র পাঠ করতে করতে সঙ্গী হলো।গিয়ে দেখা গেলো প্রথম অস্পর্শ বোতলের ভূত সিনহা,মন্ডলদের এতটাই চেপে ধরেছিল যে বাঁশের কঞ্চি যে শার্ট আর গেঞ্জির কলারকে আটকে ধরেছিল তাই মামদো ভূতের আক্রমণ হয়ে গোটা গ্রাম রটে গেছিলো।আনমনেই হেসে ওঠে বৈভব।সে রাতে এক ছিপি সেও খেয়েছিল!এক ঝাঁক পাখি রোদ মেখে ফিরছে প্রবীণ আকাশে ডানা ঝাঁপটে।অয়ন্তিকার জন্য সেই পিকনিকে ভবতোষের কান্নার কথা মনে পড়ে যায় তার।মনে পড়ে সেই রাতে প্রথম মাতাল হবার সুখ বুকে সবার বেতাল হয়ে উঠার গল্প আর সেই রাতে সবাইকে সামলে রেখে বন্ধু মহলে তার অভিভাবক হয়ে উঠার কথা।রোড লাইট জ্বলে উঠছে।আজো ড্রিংকসপার্টি মানেই নিশ্চয়তার নাম বৈভব আর বৈভব সেদিন শিখেছিল আত্মনিয়ন্ত্রণ।

পরীক্ষার শেষ আর রেজাল্টের মাঝের সময়টিতে আরেক দফা বদলায় ঠেক সকাল থেকে দুপুর লিলিকটেজ এর দোতলায় সিনহার রুমে আর সন্ধ্যায় পৌরসভার চত্বরে।সকাল হতেই লিলিকটেজে জমতে থাকে সাইকেল।কেউ তাস,কেউ দাবা,কেউ ক্যারাম কেউ বা কডলেস ফোন নিয়ে মেতে উঠে।কোন কোন দিন ফ্রিজ থেকে বেরিয়ে আসে চিল বিয়ার।তখন প্রায় সবাই ঠোঁটে আগুন জ্বালাতে শিখে গেছে।কিচেন থেকে কফি মগ নিয়ে বসতেই লোডশেডিং দক্ষিণের জানালা ভাসিয়ে ঘরে ঢুকে আসে এক জানালা জোছনা।মনে পড়ে যায় বৈভবের এমন এক জোছনা রাতেই দেবীবাড়ীর দাশ পরিবারে সিনহাকে নিয়ে গিয়েছিলো বৈভব।ঐ বাড়ীটি ছিল শম্পাদের।সিনহা তখন সমর্পিতায় ডুবে আছে।বৈভব ছিল দাশবাড়ীর অঘোষিত পুত্র সন্তান।শম্পা আর সোমাদি বৈভবকে ভাইফোঁটা দিতো।সাগরদীঘির আড্ডা থেকে বৈভব রোজই ঐ বাড়ী চলে যেতো কিছুসময়ের জন্য আর তাই শহরের চরম বন্ধুত্বের উদাহরণ সিনহা,বুচু আর ভব দের কাছে তার কম কথা শুনতে হয়নি।তবে কর্তব্য ও দায়িত্ব সে ঐ বন্ধু বাড়ীটি থেকেই শিখেছিল আড্ডার কটাক্ষ উপেক্ষা করেও!

শুভস্মিতা নন্দ কে প্রপোজ করবে বুচু তার রিহার্সাল চলছে বেশ কয়েক সপ্তাহ।সকালে লিলি কটেজে সন্ধ্যায় ঠেকে এতবার অভিনয় করা হলো তা গুনে বলা যাবে না।বৈভব কফি-মগে চুমুক দিয়ে হাসতে হাসতে জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়।ঘটনার দিনের ছবিটা জোছনার আলোর মত ফুটে ওঠে।বৈভব,সিনহা,ভবতোষ,কৌশিক সহ সবাই দাঁড়িয়ে সুদীপ্তা,জিনিয়ার সাথে নন্দ এসে বুচুর মুখোমুখি হতেই সাইকেল ফেলে বুচুর সে কি দৌড়।এই ঘটনাটি মনে হতেই বৈভব একা একা হেসে ওঠে আর তখনি সেলফোনটা বেজে ওঠে 'বসন্তের এই মাতাল সমীরণে..'রিংটোন বেজে বেজে থেমে যায়।ভাস্করের কথা মনে পড়ে,তখন কনকনে শীত।ইতিমধ্যে বড় থেকে ছোট সব ঠেকে একটি মিথ তৈরি হয়ে গেছিলো বৈভব কে নিয়ে,যে বৈভব কারো জন্য প্রেমপত্র লিখে দিলে প্রেম হয়েই যেতো।কুসংস্কার হলেও বৈভবের হস্তাক্ষর কিংবা চিঠি লেখার ধরনে এক অজানা ম্যাজিক থাকতো।আর এই মিথ থেকেই ভাস্কর একদিন এসে বৈভবকে ধরল তার জন্য একটি প্রেমপত্র লিখে দিতে হবে।সব বন্ধুদের তত্ত্বাবধানে ছয় ছয়টি চিঠি লেখা হলো দুই মাসে কিন্তু চরম মিথ ভেঙে প্রেম তো দূর থাক চিঠির উত্তর ও এলো না।কফি-মগে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে সেইদিন আড্ডায় ভব আর সিনহা দৌড়ে এসে খবর দেয় বৈভবের বাবা এক মহিলা আর ভাস্কর ঠেকের দিকে আসছে।পলকে আঙুল গলে পড়ে গেলো সব আগুন,ধোঁয়া আর গন্ধ তাড়ানোর প্রাণন্ত চেষ্টার মাঝেই বৈভব দেখল তার বাবা আর বাবার কলিগ সুচেতা আন্টি পাশে ভয়াক্রান্ত পাহাড়ের মতো ভাস্কর।কিছু বুঝে ওঠার আগেই বৈভবের বাবা পকেট থেকে ছয় ছয়টি চিঠি বের করলেন।তিনি কিছু বলার আগেই বৈভব সেইদিন অপলক চেয়ে থেকে জুতা মোজা খুলে সাগরদীঘির কনকনে ঠাণ্ডা জলে গিয়ে দাঁড়ালো।আজ হাসি পেলেও সেইদিন কাঁদতে কাঁদতে জলে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল বৈভব।সুচেতা আন্টি গিয়ে তুলে এনেছিলেন।বাবা শুধু গম্ভীর স্বরে বলেছিল আজ বাড়ী এসো।কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারছিলো না।সুচেতা আন্টি কেবল যাবার সময় বলল তোমার লেখা খুব সুন্দর শব্দ চয়নও তুমি কি সাহিত্য টাহিত্য লেখো?আর আমার মেয়ের নাম সৃজনী।কেউ কিচ্ছু বুঝল না বৈভবের চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে সুচেতা আন্টি চলে যেতেই আঙুলে আঙুলে আগুন জ্বলে উঠলো।ঘরের অন্ধকার শুষে জ্বলে উঠলো টিউবলাইট।কফি মগটায় শেষ চুমুক দিতে গিয়ে মনে হলো অন্ধকারটাই ভালো লাগছিলো।

ভাস্করকে ঘিরে ধরতেই ভাস্করের কাছে থেকে যে তথ্য বেরিয়ে এলো তাতে কাঁদো কাঁদো ঠেকে নিমিষে হাসির রোল পড়ে গেলো।ভাস্করের বয়ানে জানা গেলো সুচেতা আন্টি প্রতিদিন মেয়েকে কোচিং এ দিয়ে যান।কোচিং এ বসে থাকা কারো কাছে ভাস্কর বিনীত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো 'আন্টি উনার কি নাম।'বসে থাকা ভদ্রমহিলা বলেছিলেন সুচেতা ব্যাস এটা শুনেই সে দৌড়ে এসেছিলো চিঠি লেখাতে।আরো অনেক পড়ে জানা গিয়েছিলো সৃজনীর হাতে চিঠি দিলেও সুচেতা নাম দেখে সৃজনী সে চিঠি তার মা কেই দিয়ে দিতো।ভুল বোঝাবুঝির এই কালো মেঘ তো কেটেছিল।কিন্তু বন্ধুত্বের দুর্দান্ত উদাহরণ সিনহা,বুচু আর ভবতোষের ছাড়াছাড়ির কথা মনে পড়তেই বৈভব উদাস হয়ে পড়ে।সমর্পিতা কে বৃষ্টির দিনে ভিজতে ভিজতে গিয়ে চিঠি না দিতে পেরে এসে যে সিনহা কাক ভেজা বন্ধুদের কাছে এসে বলেছিল মেয়েদের চিঠি দেবার চেয়ে কঠিন কাজ নেই।সেই সিনহা কখন শম্পাকে ভালবাসতে শুরু করেছিলো কেউ জানেনা।আর যখন জানাজানি হলো তখন ঝড় উঠলো।

একখণ্ড কালো মেঘ এসে চাঁদ ঢেকে দিয়েছে কখন বৈভব খেয়াল করেনি।ছাদে উঠে এলো বৈভব।তপ্ত ছাদের উপর দিয়ে অচেনা এক বিমান উড়ে যাচ্ছে।বৈভবের চিৎকার ছাদ ছাড়িয়ে বিমানে পৌঁছায় না বরং বিমানের শব্দে মিলেমিশে হারিয়ে যায় তার কথা এ মেঘ সরিয়ে দিয়ে যাও।

বৈভবের সাথে বুচু,ভবতোষের সুসম্পর্ক যতটা সিনহার সাথেও ততটাই তবু মনে হয় তার জন্যই হয়ত বুচু,ভবতোষের সাথে সিনহার সম্পর্কে যে একটা দেয়াল উঠে গেছে তার জন্য সেই দায়ী।শম্পার সাথে পরিচয়টা না করালে,সিনহা আর শম্পা সংসার না পাতলে আজ হয়ত ওরা এক থাকতো।বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে।কেউ কেউ বলে হয়ত বৈভবের বিয়েতে সব মিটে চুকে যাবে কিন্তু বৈভব কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারেনা।নিজেকে বড় অপরাধী লাগে তার।পাশের ক্লাব মাঠে কোন উৎসব হচ্ছে সেখানে বাজাচ্ছে ,- 'জানি আসবে তুমি ঝড় হয়ে না জানি কত কত আশা নিয়ে,জানি যাবে চলে ফিরে ফিরে আমি পাশে থেকে একটু দূরে।বন্ধু দেখা হবে,বন্ধু দেখা হবে...'

পাড়ার ছেলেদের উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে বৈভবের মনে হয় ওদের ডেকে বলে এই রকবাজি বড় সুখের নয়,এ ঠেকবাজি বড় দুঃখের নয়।এই সুখে-দুঃখে,ভালবাসায় আড্ডাহীন আড্ডায়,স্মৃতি-বিস্মৃতিতে,মুখরতায়,একাকীত্বে বেঁচে আছি।ঠেকবাজির কোলাহল মাথায় বহন করে কোথায় কত দূরে হারিয়ে যাওয়া,এক ফোঁটা ভোরের শিশিরের মতো,তবুও বেঁচে থাক আমাদের সেই আড্ডা জীবন,সেই সুখ-দুঃখ,পাওয়া-না পাওয়া তোমাদের মাঝে কি সিনহা,বুচু,ভবতোষ আছে নাকি কেবল বৈভব,যে সব রকবাজির অন্তিম পরিণতি!বলা হয় না,কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস আরো কালো করে দেয়ে এক আকাশ নক্ষত্র...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র