সৌমিত্র চক্রবর্তী - মায়াজম

Breaking

১৫ এপ্রি, ২০১৫

সৌমিত্র চক্রবর্তী

shiরকবাজী ছকবাজী



মাইরি সে একখান সময় গেছে। উলস্! শালা ভাবলেও গায়ের লোম উচাটন হয়ে খাড়া খাড়া হয়ে টাইম মেশিনে চড়ার চেষ্টা করে, আর তারপরেই যেই বোঝে, নাহ্ যাহা গেল, গেল তো গেলই, তাহা আর ফিরিবার নয়, ওমনি ধুপ্পুস করে নেতিয়ে আবার সেই ক্যালাকাত্তিক স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের আওতায় এসে বাধ্য সোয়ামী হওয়ার কায়দা রপ্ত করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।

আচ্ছা সত্যি কথা বলি, এই সশাল্লা আলু ঢ্যাঁড়সের ট্যালট্যালে ঝোল মার্কা বাড়ী অফিস বাড়ী লাইফের চেয়ে ওই হোল বেকার টো টো লাইফ… উফস্… হেল এন্ড হেভেন দূরত্ব, মানে ওই শ্রীরামপুর থেকে গড়িয়া যাওয়ার মতো ব্যাপার আর কি। লঝঝড়ে তিন নম্বরে চেপে যাচ্ছি তো যাচ্ছি…যাচ্ছি তো যাচ্ছি … আজ চাপলে এ মাসের শেষ নাগাদ পৌঁছব কিনা সন্দেহ!
রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে মারক্যুইজ থেকে ফিদা হুসেনের আর পাক্কা এক প্যাকেট বিড়ি খান দুই সিগারেটের সহযোগে শ্রাদ্ধ করে কোলবালিশকে চুমু খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ে সকালে সূর্যদা নরম হাসি ছেড়ে যেই ধমকাতে শুরু করলো, তখন মায়ের গজগজ গায়ে মাখতে মাখতে উঠে পড়ে কোনোরকমে ব্রাশ আর চা চুকিয়েই দৌড়…রক অপেক্ষায় আছে।

যে কটা রকবাজ ছিল, ক্যাটাগরিতে মোটামুটি সব উনিশ আর বিশ। সব কটাই তখন বাড়ীর আপাতত খরচের খাতায় নাম লিখিয়ে মা’র কাছে গাইগুই করে কিছু জুটিয়ে কিম্বা টিউশ্যনের টিপে টিপে খরচের গান্ধীছাপে হাত বুলিয়ে আর শুঁকেই চালিয়ে যাচ্ছে। তা সেই রকের পাশে একখানা দু ফুটিয়া রেলিং ছিল আর তার ওপরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা আর ষণ্ডগুলোর সাথে কি কায়দায় যে আড্ডা হতো, এখন ভাবলে আলাদিনের দৈত্যও শিউরে উঠবে। স্কুল, কলেজ থেকে বিকেলে ফেরার পর, খোকার চায়ের দোকানে বসতো আড্ডা । বাড়ির সামনের রক। মশার কামড় খেতে খেতে বিকেল গড়িয়ে রাত অবধি ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, উত্তমকুমার-সৌমিত্র কত বাকযুদ্ধই হত।

অবিশ্যি, রকের ব্যাপারে বাঙালি খুব উদার। যেকোনো জায়গায় আড্ডার গায়ে রকবাজীর লেবেল ছিটিয়ে দিতে আমাদের একটুও কিপটেমি নেই। আরে সেই খোকার চায়ের দোকান! সাড়ে তিন টাকা পকেটে নিয়ে সকাল থেকে দুপুর, ফের বিকেল থেকে রাত্রি। এ বলে তুই খাওয়া, ও বলে তুই। একটা চা তিনভাগ, বিড়ি হলে দুই আর সিগারেট যে কতগুলো ভাগ হতো খোদাই জানেন। বোধহয় খোকাও দু চার টান টেনে নিত তার থেকে। মাসের পর মাস কড়কড়ে অনেকগুলো টাকাই বাকী পড়ত কিনা ওর দোকানে। ‘দিয়ে দেব রে আসছে মাসে’ শুনলে খোকার ঠোঁটের কোনেও বিন্তিরিং হাসির ছোঁয়া চলকে উঠত।

কয়েকটা মেয়ে বেশ ভালো নেকুপুষুমুনু ট্রেডছাপ দেওয়া এই রকিয়াদের এড়িয়ে চলত। আবার কয়েকটা আনিশা, তানিশা, মনীষা বেশ পছন্দই করত রকের গা ঘেঁষে ফুড়ুৎ গন্ধ ছড়িয়ে আমাদের রীতিমত উতলা করে দিয়ে টলকে চলকে চলে যেতে। রকে যাদের দেখলে আমরা ওভারস্মার্ট হয়ে যেতাম, হঠাৎ রাস্তায় একা মুখোমুখি হয়ে গেলে এক্কেরে ক্যাবলাকান্ত ঢোলগোবিন্দ। কিন্তু ঠেকের পাশ দিয়ে যাবার পরে সেই সব ছমকছল্লুদের চারপাশে অন্তত কিছুক্ষণ উড়ে বেড়াত আমাদের মত মহান পুরুষদের কতরকম বাণী, ভাবলেও নিজের ছবির ক্যালেন্ডার করে ফুল ছড়াতে ইচ্ছে করে আজ।

আর মুখে মারিতং জগত! গপ্পের কত ডাল আর তারচেয়েও বেশী পালা হয় সে ওই বাঙালির আড্ডা ছাড়া জানা যাবেনা। অমিতাভ থেকে খরাজ, বিদ্যা বালান থেকে শুভশ্রী, নেরুদা থেকে শ্রীজাত, সাহারা থেকে সারদা, আরএসএস থেকে আইএস, ওবামা থেকে অনুব্রত জ্ঞানের কি ভাণ্ডার! আহা! সে যখন বেরোয় ভাকরা নাঙ্গালের জল ছাড়ার মত কিম্বা নায়াগ্রার প্রপাত। যেকোনো কর্পোরেট কোম্পানির ইন্টারভিউয়ার ভিরমি খেয়ে যাবে ওই ডিসকাসন শুনলে। বাঙালি কত জানে, কিন্তু কোনো অহংকার নেই!

তবে আর একটা জিনিস, রকের গায়ে বয়সের কোনো ছাপ পড়ে না। আমাদের রক, উহাদের রক, তাহাদের রক, সব ভিন্ন প্রজাতির বয়সের রক ফটাফট চলছে তো চলছেই...চলছে তো চলছেই। বিড়ি বা সিগারেটটা একটু লুকিয়ে হাতের আড়াল করে টানলেই, ব্যস কেল্লা ফতে। আর একটু দূরে চলছে মাবু মামাদের রক। সেখানেও জ্ঞান ডাম্প হতে হতে ছড়িয়ে যায় অ্যাস্ফল্টের রাস্তায়। আরেকটু দূরে পার্কের মধ্যে জেঠু, দাদু সব সেপারেট সেপারেট মত্ত।

ওহো! বলাই হয়নি। রকের প্রধান ফিসফিস কিন্ত পিএনপিসি। আঃহা! টক ঝাল মিষ্টির এমন ঘটিগরম সোয়াদিষ্ট আলোচনা আর কোথায় পাব? কার মেয়ে পালালো। কার ছেলে পালানোর ফন্দি আঁটছে। কার বউ কাকে দেখে মুচকি হেসেছে। কোন দাদা চুপিচুপি অন্য এক দাদা বাড়ী না থাকলেই...! এসব তো আছেই, তাছাড়াও আছে কে উঁচু দাঁত নীচু করে এসেছে, কে প্লাস্টিক সার্জারি করে বুক বাঁধিয়েছে, আর কে ই বা বোঁচা নাক খোঁচা করার জন্যে ডাক্তারের কাছে ধর্না দিয়ে তাঁর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এছাড়াও পাড়ার টুবলু প্রোমোটারি করে বিএম ডাবলু হাঁকাচ্ছে, ধনাদা শেয়ার মার্কেটের দালালি করতে করতে কেমন এমএলএ হয়ে গেল এটসেটরা...এটসেটরা...

এই আড্ডা দেওয়ার কাজটা আজ যত সহজ সেদিন তা ছিল না। আড্ডা যে কত প্রেমের জন্ম দিয়েছে, আর কত বিরহীর জ্বালা জুড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বিকেলবেলা লেকের ধারে একটু-আধটু ‘আমি-তুমি’ করার কত জ্বালা ছিল! এই বুঝি পুলিশ এল। ফেরিওয়ালা বিরক্ত করল। পাড়ার কাকু মামা বুঝি দেখে ফেলল।

আহা তখন যদি ফেসবুক থাকতো, হাইকি মেসেঞ্জারে আড্ডা দেওয়ার কত সুবিধে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে... আনন্দে, দুঃখে... হাসিতে, কান্নায়... প্রত্যেকটা মুহূর্ত আপনার আপনজনের সঙ্গে শেয়ার করে নিন। বাবার কানমলা নেই। পাড়ার বড়দের নিন্দে নেই। গোবরে পড়ে যাওয়া নেই। শুধুই আড্ডা। হ্যাঁ, এই আমাদের হোয়াটস অ্যাপ, হাইকির রকবাজি.. বা ছোট্ট মিষ্টি করে ডাকলে, “ফেবু”।

নিজের পছন্দমতো জায়গায়, পছন্দমতো সময়ে, পছন্দমতো বিষয়ে (যেটা বেশির ভাগ সময়ে পরনিন্দা বা পরচর্চা হয়ে থাকে) আড্ডা মারলে তাকে আজকের যুগে জাল সাঁতার’ বলা হয়। ঠিক এই ব্যাপারটাই যে কেউই নেটওয়ার্কিং সাইটের বগলদাবা হয়ে করতে পারে।
বাঙালির আড্ডার দিন অন্যভাবে ফিরে এল । আবালবৃদ্ধবনিতা আড্ডা মারবে, হইচই করবে, হাসবে, কাঁদবে, প্রেম করবে হোক না তা ল্যাপটপে বা ফোনে। দুপুরবেলা ভাতঘুম দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আপনি যখন আপনার পড়শির নিন্দে করবেন, আর আপনার বন্ধুরা শুনে সাধু সাধু বলবে আহা তার যে কী আনন্দ! আর এই পুরো পরিষেবাই গুগল আপনাকে দিচ্ছে ফ্রিতে। ভাবা যায়!

তা হলে আর দেরি কেন? শুরু করে ফেলুন আপনার সাইবার রকবাজি। মশা নেই, কানমলা নেই... আহা এখন আছে গুগল কাকুর রকবাজি! দল বেঁধে আড্ডা দিতে পারেন। দশ জন অবধি ভিডিও চ্যাট করতে পারেন। নানা ধরনের ইমোজি (একটা জাপানি শব্দ, যার মানে হল ছবি+চিঠি) শেয়ার করতে পারেন। মানে আপনার খুব হাসি পেলে দাঁত বের করা ছবি পাঠালেন। যাকে পাঠালেন, সেও বুঝল আপনি দাঁত বের করে হাসছেন। 

সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল, এই পুরো আড্ডাটাই রেকর্ড হয়ে থাকবে। যে কোনও দিন, যে কোনও সময়ে আপনি স্মৃতি হাতড়ে সে দিনের সেই মজার আড্ডা আর একবার উপভোগ করতে পারবেন। 

ভাবছেন এর ব্যবহার নিশ্চয়ই খুব খটোমটো? একদম নয়। চেষ্টায় এখন স্কাইপিতে বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে, তাহলে? পারিব না এ কথাটি বলিও না হে আর! আড্ডা নেই, রকবাজী ফসিল হয়ে গেছে, এইসব হাহুতাশ না করে বি পজিটিভ। আরে নাহ! রক্তের গ্রুপের কথা বলিনি। একটু উঁচু গলায় হাসতে বলছি আর হোক না ঘরের মধ্যেই, বউ কিম্বা বরেরএর গজগজ করায় কান না দিয়ে, চালাও পানসি বেলঘরিয়া। শুরু হোক বিশ্ব সাইবার রকবাজীর ছকবাজী।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র