রুখসানা কাজল - মায়াজম

Breaking

১৮ মার্চ, ২০১৬

রুখসানা কাজল

                             অলৌকিক আবছায়া












অজগর সাপের মত পিঠ বাঁকিয়ে উপরে উঠে গেছে রাস্তা। অনেকখানি পথ পেরিয়ে মনে হচ্ছে যাক এবার শেষ হল। কিন্তু যেখানে শেষ ভেবেছিল, সেখানে এসে দেখে আরিব্বাস এত অনন্ত প্রসারী রাস্তা। আরো পথ ভাঙতে হবে। পাহাড়ে উঠার অভ্যাস আছে। ছুটি পেলেই ওরা বেরিয়ে পড়ে। এবার এসেছে চিম্বুক পাহাড়ে। পাপার প্রিয় পাহাড়। এই পাহাড়ের শিখরে নাকি পাপার পূর্বপুরুষদের আত্মা দেবতাদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। মুচকি হাসে সরা। টোটাল ভিজুয়ালাইজেশন অর এন্টায়ার সাপোজিশন। কিন্তু কে বলবে পাপাকে? পাপার গভীর আবেগ জড়িয়ে আছে এই কল্পনায়। পাহাড়ের সবুজ ঘাসগুলো মোহন আগুনের মত জ্বলছে। আয়না-রঙ মাটি। কিছু বড়গাছ পাহাড়ের ঢালুতে ঝাঁকড়া চুলে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ণিল পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতিদল ।
সরাআআআআআ ----- নীচ থেকে চেঁচাচ্ছে পাপা। উত্তর কি দেবে? হলি শীট! তাহলে ওকেও চেঁচাতে হয়। বুদ্ধি করে ব্যাকপ্যাক থেকে একটি চকোলেট রাস্তায় রেখে দেয়। পাপার চোখে পড়বেই। তখন বুঝবে, সরা ইজ অ্যাবসলিউটলি ওকে। ও জানে সাপ, বাঘ, হাতি, পড়েছরে হাত পা ভাঙ্গা মচকানো রক্তারক্তির ভয় নয়, পাপা ভয় পাচ্ছে মানুষকে। সেই সব মানুষকে যারা পাহাড়িদের ভূমি দখলের জন্যে ভূমি সন্তানদের ঘরে আগুন দেয়, গরু বাছুর ছাগল লুট করে, ভূমি কন্যাদের রেপ করে ফেলে যায় অথবা স্রেফ মেরে ফেলে।
খুব মিষ্টি শীত। প্রচুর এনজয় করছে ওরা। মাম্মা ত মহাখুশী। কি বিউটিফুল পিকনিক ওয়েদার এন্ড স্পট তাই না উইলি? পাপা শুনেও থামতে রাজী নয়। সরাকে চিম্বুক পাহাড়ের উপর নিয়ে যেতেই হবে। আসছে মার্চ আঠারো পূর্ণ হবে মেয়ের। এরপর বাবামায়ের সাথে থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। পাপার তাই ইচ্ছা পূর্বপুরুষদের আত্মার সদ্গতির জন্যে অন্তত একবার তর্পণ করুক সরা। সে জন্যেই চিম্বুক পাহাড়ে আসা।
কি আছে সেখানে ? জ্যাকসনহাইটের বাড়িতে বসে পাপা সরাকে অজানা সেই কাহিনী শুনায় । এক কাঠকুড়ানি মায়ের গল্প। পাহাড়ের গায়ে জুম চাষীনী মা মাথায় শুকনো কাঠ নিয়ে নেমে আসছে ঘরে। তার হাজার গল্প। গাঁও দেবতার গল্প, নদিমা জলপাখির গল্প। উঠোনে ভাত বসিয়ে মেটে আলু, বাঁশের কোড়, পাখি অথবা কোন সরীসৃপের মাংস রানতে রানতে সেই পাহাড়ি মা কত গল্প শোনাত পাপাকে। কখনো কখনো একজন পুরুষ হাসিমুখে চুলোর আগুনে বিড়ি ধরিয়ে ছেলেকে আদর করেই তড়িৎ চলে যেত বনজঙ্গলে। কে তিনি ? তিনিই কি তার বাবা ছিলেন ?
গল্পের এই জায়গায় এসে পাপা কেমন চুপ করে যেত। বাবার চেহারা মনে করতে চেষ্টা করত । আট বছরের ক্ষুদ্র জীবনে বাবাকে খুব কম দেখেছে । কেন যেন অনেক পাহাড়ি পুরুষদের মত বাবা কাকা জেঠুরা দূর বনজঙ্গলে পালিয়ে থাকত। মাঝে মাঝে অস্ত্র হাতে কারা আসত। ঘড়রর ঘড়রর করে তাদের গাড়ির ইঞ্জিন চলত। ঘরবাড়ি তছনছ করে চাল ডাল জমানো আলু পেঁয়াজ মুরগী লুটে নিত। শিশুদের হটিয়ে জুলুম করে নারীদের নিয়ে যেত ঝোপের আড়ালে কেউবা ঘরের ভেতর। আর্ত-চীৎকার গালিগালাজ শাপশাপান্ত শেষে শোনা যেত নারীদের কান্না আর গোঙানির শব্দ। ঝটিকা তাণ্ডব করে চলে যেত দুর্বৃত্তরা । পেছনে পড়ে থাকত লুণ্ঠিত সংসার, বিধ্বস্ত মানুষগুলো । কি যে কাঁদত অসহায় পাহাড়ি মানুষগুলো। পাপার গলায় জমাট কান্নার দমক। পাপার হাত ধরে কেঁদে ফেলত মাম্মা, একবার যাবে উইলিয়াম ? দেখতে বড় ইচ্ছা করে ---
সরা জানে পাপা মাম্মা একদেশের পাহাড়ি মানুষ নয়। কিছুটা এক রকমের চেহারা হলেও জাতিসত্তায় দুজন আলাদা। পাপা বাংলাদেশের চাকমা মাম্মা ভারতের খাসিয়া। দুজনেই আমেরিকার দুই পরিবারের দত্তক সন্তান। মাম্মার স্মৃতিতেও মাঝরাতের হামলা, কান্না, দাউদাউ আগুন। কেউ একজন তাকে কোলে নিয়ে ছুটছে ছুটছে। কাঁচা গির্জাবাড়ির উঠোনে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছে, পালা পালা। গির্জার আঙিনায় মরিচ টোম্যাটো, কপিক্ষেতের ভেতর লুকিয়ে থরথর সেই ভয় মাম্মাকে এখনো কাঁপায়। শুধু মনে করতে পারেনা কে তাকে বাঁচালো! সে কে ? তার বাবা না মা ? নাকি কোনো পাহাড়ি দেবতা!
এত ভোরে চিম্বুক পাহাড়ের শীর্ষে মহানৈঃশব্দের মিহিন স্তব্ধতা। আরো নির্জনে সরে আসে পাপা । পাহাড়ের নীচ থেকে পাক খেয়ে উঠে আসছে ধুসর কুয়াসা। নীচে লম্বা একটি ধোঁয়া রাস্তা দেখা যাচ্ছে । পাপা জানায় রাস্তা নয়। পাহাড়ি নদী। শীতে কুচকে আছে। বর্ষা এলেই ভাসিয়ে দেবে গহন অতল জলস্রোতে। পাহাড় দেবতা তখন জল পাবে। শুকনো বুকের গভীরে জল সিঞ্চন করে পাথুরে ঘুম থেকে জেগে উঠবে ভূমি সন্তানের আত্মারা। ছুটে বেরিয়ে আসবে তারা। পাহাড়ি জনপদে খুঁজে ফিরবে স্বজন পরিজনদের। জুম ক্ষেতে অদৃশ্য হাত লাগাবে, পাহাড়িয়া গান গাইবে, চু, হাঁড়িয়া, মহুয়া খেয়ে ঝুম নাচবে। আর গির্জাঘরের সামনে তাদের বুনো দেবতাদের নিয়ে ঠায় বসে থাকবে। অশ্রুভরা চোখে দেখবে নতুন ধর্মের নতুন প্রজন্ম বুকে ক্রশ আঁকার সাথে সাথে তাদের কি একেবারে ভুলে গেল? নাকি মনে রেখেছে কেউ কেউ এখনো !
একজন প্রাচীন বৃদ্ধকে ঘিরে কয়েকজন পাহাড়ি নারীপুরুষ বসে আছে। পরিচয় করিয়ে পাপা জানায়, আমার মেয়ে সরস্বতী উইলিয়ামস। ও তর্পণ করবে। প্রাচীন বৃদ্ধটি আগুন জ্বেলে মন্ত্র পড়ে। ধোঁয়ায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে সরার । তবুও দেখতে পায় প্রাচীন মানুষটির গোলাকার মুখসহ সমস্ত শরীর জুড়ে বয়সের হাজার ঝুরি। তাতে পিঁপড়ের ঘর। উইয়ের ঢিবি। ভিজমাটির অভিজ্ঞান উল্কিতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে অজানা অচেনা অবোধ্য এক ইতিহাস। সাথের নারী পুরুষরাও কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া , কুয়াশামাখা । বৃদ্ধের পেছনে রানজেই আর কার্পাসের থাবিং পরা একজন তরুণী সরার চোখে চোখ রেখে হাসছে। ভাল করে দেখে সরা । জন্মজন্মান্তরের মায়াময় চোখে চিরচেনা প্রতিচ্ছবির ঘূর্ণিনাচন তুলে ধূসর আবছায়ায় তরুণী অলৌকিক আঙ্গুলে ছুঁয়ে দেয় সরাকে। মুহূর্তেই চিনে ফেলে সরা। এত সে !
বহু বছর আগের পাহাড়ি তরুণী সরস্বতী। বৈসাবির পবিত্র ভোরে বান্ধবীদের সাথে সাঙ্গু নদিতে এসেছে ফুল ভাসাতে। একটু পরেই পুণ্য জলখেলা। প্রেমিকের গায়ে জল ছিটিয়ে আজ সে বেছে নেবে তার জীবনসাথী। কিন্তু এত আগুন কেন ? কান্না আর্তনাদ, মৃত্যু চিৎকার হাহাকার ? অইত রক্তাক্ত সরস্বতী ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাহাড়ি নদীর খরস্রোতে! কার হাত থেকে বাঁচতে !

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র