পলাশ কুমার পাল - মায়াজম

Breaking

১৮ মার্চ, ২০১৬

পলাশ কুমার পাল

                                অলৌকিক: একটা মৃত আশা









অলৌকিক কেবল ভৌতিক নয়। লৌকিকের বিপরীতে একটা শব্দ, যার তরঙ্গে অসম্ভবের ঢেউ উঁকি দেয়। এককথায় অসম্ভবে রোপিত ক্ষেতই হল অলৌকিক।

জীবন ও সমাজের কাছে অপরিচিত এই ফসল। চেনা সাধারণ মানুষের মাঝে পাগল? হয়তো- পাগলের কথা সত্যই অলৌকিক; অসম্ভবভাবে হয়ে ওঠা কিছু বাক্য। তবে তারা যে বাক্য -এটাই শব্দটাকে গভীর করে দেয়। পাগলের ব্যক্ত কতগুলি অর্থবহ শব্দ, যার সংগঠন না-অর্থে। সভ্যতার স্থানীয়মানে যার অবস্থান নির্ণয় সম্ভবের মধ্যে পড়ে না। তবু আমরা সেই অঙ্ক কষি, যার গাণিতিক সমস্যা নির্ণয়ের কোনো সূত্রই পার্থিব নয়...
সমস্যা... না, সমস্যা বলাটাও ভুল। সমস্যা তো সমাধানের ক্ষেত্র। যার কোনো সমাধান নেই, সে সমস্যা হবে কীভাবে? জন্ম থেকে শিরায় শিরায় গেঁথে দেওয়া ভয়- ভূত, অন্ধকার, ঠাকুর -সব ক্রমশ বড় হয়... বড় হতে হতে জীবনের পরিণতিতে তারাও নিজেদের সম্পত্তি বুঝে নেয়। স্নায়ুর দেয়ালে দেয়ালে বাসা বেঁধে নিঃশব্দ যাপন করে। অনেকটা ভারতীয় রেলের জমিতে বসতি বা ফুটপাতে দোকান। শিক্ষার আলোও সেই নিঃশব্দকে ভেদ করতে পারে না বা সম্পূর্ণভাবে বিঁধতে পারে না। ফলে সেই অলৌকিকতা ক্রমে মহাকাব্য হয়ে ওঠে, যার মধ্যে সুখ ও দুঃখ -দুই চোখের শব্দ ছন্দময় সামাজিকতার মহাপয়ার। অস্থায়ী বসতি যেন স্থায়ী ঘর হয়ে ওঠে।
এই ছন্দময়তার মাঝে যেমন জন্মের হাসিমুখ আছে, তেমনই মৃত আত্মার ছোঁয়াও আছে। শৈশব থেকে দেখে যাওয়া প্রতি স্বপ্নকে ছুঁতে চাই। কখনো ছুঁতে পারি। অধিকাংশই স্পর্শের বাইরে থাকে। তাই প্রতি স্বপ্নকে নাগালে পেতে অসম্ভবে তুলি টানি শূন্য জানা সত্ত্বেও। দ্বারস্থ হই ঠাকুর-তাবিজ-মাদুলির সভায়। আসলে কার কাছে দরখাস্তটা পাঠাই সেটা নিজেরাও জানি না। অদৃশ্যের মাঝে অদৃশ্য ইচ্ছার প্রকাশ করি। হঠাৎ ইচ্ছার ঘুড়ি আকাশে উড়লে হাততালি দিই- যেন লৌকিকের ঊর্ধ্বে হাওয়ায় অসম্ভবকে জয় করেছি। শব্দের মূলঅর্থটা অপমানিত হয়। আসলে ঘুড়িটাই ছিল ইচ্ছাহীন। ইচ্ছাসুতো যুক্ত হতেই সেও সাহসিকতার ডানা মেলেছে।
ঘুড়ি কাটাকাটির খেলায় অবশেষরূপে বা সুতো ও লাটাইয়ের অভাবে বেশিরভাগ ঘুড়ি যখন মাটিতে জমতে থাকে, ঠিক তখন মনের আকাশ ছায় অন্ধকারের আবরণে। শৈশবের অন্ধকার ভয়টা শিরদাঁড়া বেয়ে আবার সারা অস্তিত্বতে খবর রটায় 'মৃত্যুর পদধ্বনি...'। সবকিছুকে অলৌকিক ও অসামাজিক মনে হয়। কোষে কোষে আগ্রহের বীজ শুকিয়ে যায় ক্রমে... বেঁচে থাকার জন্য সমাজে আটপৌড়ভাবে বাঁচা হারানোর বৃত্ত আঁকতে আঁকতে...
এই অঙ্কিত লৌকিক বৃত্তের মাঝে পূর্ণ ব্যর্থতার মহাত্মা , যার থেকে জীবাত্মাকে ফেরানো যায় না। তবু কেন্দ্রে কম্পাসসৃষ্ট একটা ফুটকি বা ছিদ্র বলে দেয় একটা আশার কথা; যার প্রতিধ্বনি অসম্ভব, যাকে ভাগ বা বাস্তবে পাওয়াটাই অলৌকিকচাষে সফল চাষি। না হলে ব্যর্থ চাষি, ঋণের দায়ে মানসিক যন্ত্রণায় দংশিত হতে হতে মৃত্যুর উপলব্ধিকে ছুঁয়ে ফেলে। নিজের চারপাশে শ্মশান গড়ে নিয়ে আঁধারে ভৌতিক পরিবেশ রচনা করে।
এই 'ভৌতিক' শব্দ এক অসম্ভব শব্দের বেরা। দৃশ্যত যার অবয়ব নেই, অথচ ভয় পায়। আসলে ভয় পায় সেই এক বিন্দু আশা বা বৃত্তের কেন্দ্রকে। নিজের ভাবনার মাঝে টুপ্ করে একটা ঢিল ছুঁয়ে দেওয়া। আর পুকুরের মাঝে সেই ঢিলের স্ফলন সারাপুকুর, এমনকি পুকুরপাড়ে খবর রটিয়ে দেয়। দৃশ্যত সে ঢিল পুকুরের গভীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। পায় না কিছুই। আর এই না-পাওয়াতেই ডুবুরি হয়ে অনুসন্ধানে নামা।
অনুসন্ধানে আস্থা রাখা আশা বড় হয়ে ওঠে গভীরে, বেলুনের মতো... কখনও ফাটে বা নিজের বিন্দু অবয়বে নিজেই সান্ত্বনা হয়। পরিণতিতে এই গল্পের নীতিকথায় তাই লৌকিকের অতীত রয়ে যায়। সমাজে স্বীকৃতিহীন আশা মনে-প্রাণে মারা যায়। তবু তারপর... মৃতের রেণুগুলোকে রক্তে নতুন সম্ভাবনার বীজ বুনে হারায়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র