যেসব কবিতার সঙ্গে
পরিচিতি অনেকদিনের, তাদের নিয়ে আলোচনা পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া অসম্ভব নয়। যেমন অসম্ভব ছিল
না পুরনো স্মৃতির ফিরে-ফিরে আসা, একেকটা কবিতা ঘিরে। মন বড় অবাধ্য। আমাকে টেনে নিয়ে
যায় ২০১৩’র জুন মাসে, রানাঘাটে। একতলা একটা বাড়ির কড়িবরগা’র ছাদ, অ্যাশট্রে আর ঠাণ্ডা
মেঝে যে মেহফিল গড়ে তুলেছিল, তা কেন স্মরণীয় হবে না, যদি কানে ভেসে আসে –
“আমার ভিতরে
ভালোবাসা-ঘেন্নার
দুটো ঘর আছে।
অজান্তে তুই
মাঝে-মাঝে স্থান
বদলাস।”
সেই আমার প্রথম আলাপ
শিঞ্জিনীর সাথে। শিঞ্জিনী কে, এ প্রশ্ন করবেন না। কোনও কোনও অনুভূতি আড়ালেই সুন্দর
হয়ে ওঠে। তবে, সেদিন চিনেছিলাম মিলন চট্টোপাধ্যায়’কে। এমন একটা নাম বললেই চোখের সামনে
ভারিক্কিপুরুষ এসে দাঁড়ান যেন। সে আতঙ্ক এড়ানোর জন্যেই সে হয়ে উঠেছিল ‘মিলনদা’, আমার
‘পাগলা মিলন মাস্টার’।
‘দোয়াতে যুবতী চাঁদ’
বইটা নিয়ে আলোচনা করা আমার পক্ষে সত্যিই দুঃসাধ্য। কারণ একের পর এক স্মৃতি ছুটে আসছে
কবিতা ঘিরে। মনে পড়ছে নভেম্বরের একদিন, সারারাত জেগে আমার আর মিলনদা’র কবিতা বাছাই’এর
মুহূর্তগুলো। ঘরের মধ্যে ঘর গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা মশারি শিখিয়েছিল সেদিন। চোখের সামনে
তিল তিল জন্মাতে দেখেছিলাম একটা বই’কে। তারপর, সূচিপত্র, প্রচ্ছদ নিয়ে আলোচনা – ‘দোয়াতে
যুবতী চাঁদ’ কি আমারও প্রথম বই নয়? বইমেলায় অন্যদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করেছি, এবং শেষ
পর্যন্ত প্রথম ক্রেতা আমিই। এরকম একটা পরিস্থিতিতে ‘আলোচনা’ শব্দটা বড্ড গম্ভীর হয়ে
দাঁড়ায়, যেন ‘ভালোবাসা’ই যথার্থ ছিল এর জন্যে।
“ভালবাসাহীন শীৎকার
নিয়ে সুখী হোক / আমার ভালবাসার মানুষ...” – প্রথম পড়েছিলাম ‘সুতরাং’ পত্রিকায়, অণুকবিতা
হিসেবে। পড়েই মিলনদা’কে ফোন করেছিলাম। সব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে
নীরবতাই সব কথা বলে দেয়। মিলনদা বুঝেছিল। হেসেছিল সেদিন। তাই যখন বইটার উৎসর্গপত্রে
ভেসে রইল শুধুমাত্র এই দুটো লাইন, অবাক হইনি। অমোঘ – যেন এ হওয়ারই কথা ছিল। এর থেকে
আলাদা কিছু যে হতেও পারত, ভাবতে পারি না আজও।
মনে পড়ছে, গতবছর
দোলের দিন। রান্নাঘরে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, জানলা দিয়ে দেখছি ছোট-ছোট ছেলেদের রঙ
খেলা। মা আমায় জিজ্ঞেস করল, “কীরে, রঙ খেলতে যাবি না?” বলে উঠেছিলাম -
“আমি তো খেলি না
রঙ
মায়ের পায়ের পাতায়
দিই শুধু
ফুলের পরাগ!”
মা হেসে বলেছিল,
“তোর মিলনদা’র লেখা না?” অবাক হয়েছিলাম। আনন্দ হয়েছিল আরও বেশি। মা কবিতা পড়ে না বিশেষ।
কিন্তু ‘দোলের দুপুর’ কবিতাটা যেহেতু ‘কর্কটক্রান্তি’তে প্রকাশিত হয়েছিল, পড়েছিল। সেই
পড়া যে এভাবে গেঁথে যাবে, ভাবিনি। যেমন ভাবিনি সামান্য পজ্ দিয়ে পড়ায় একটা কবিতা কেমন
ঐশ্বরিক হয়ে উঠতে পারে। “হাম্ (সামান্য থেমে) দিল দে চুকে সনম”। আর সেই থামাটুকুর বাতাবরণ
যেন ফোনের মধ্যে বৃষ্টি নিয়ে এসেছিল। তার আগের কয়েকটা লাইন -
“কখনও ভাবোনি তুমি
–
একা কেউ জেগে বসে
থাকে
প্রেম বলে মিছিমিছি
খেয়েছ কসম...”
অভিমানে কতবার যে
বিড়বিড় করেছি কথাগুলো! যার উদ্দেশ্যে, শোনেনি। বলার সার্থকতা তাতে কমেনি এতটুকু। আসলে
আমরা সবাই “ব্র্যান্ডহীন বোকা এক কবি”। আমাদের সম্বল ভাঙা নহবতখানাটুকু। তাই মিলনদা
যখন বলেছিল -
“শুধু বোকা বলেই
আমার বোধহয়
একা একা লাগে!”
নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম।
অথচ চালাক হওয়ার কোনও উপায় মিলনদা তো বলে যায়নি! কেন? নিজের সঙ্গে সেই শঠতাটুকু করতে
পারেনি বলে?
সেও এক রানাঘাটের
রাত। আমি আর মিলনদা বসে আছি একতলা সেই ঘরে। ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসছে কান্না। সুপ্রিয়’র।
মিলনদা পড়ছে -
“প্রিয় অমলতাস,
কেমন হলুদ ফুল ফুটিয়েছ
ডালে?
হুহু বসন্ত আসে,
ঝরে পড়ে নক্ষত্রের মত আলো।
প্রবল দহন বুকে,
তবু দেখো বেসে ফেলি
ভাল।
ভালবাসা ভাল নয়।
ভাল নয় এমন উদাস
ভালবাসা ঠিক যেন
-
মরণের দিকে হেঁটে
চলা।
কষ্টের জ্বালা বারোমাস...
ও অমলতাস, কথা শোনো
চলে যাও অন্য কোথাও...
রূপের আগুন জ্বেলে
আমাকেই কেন রোজ খাও!”
মিলনদা’র গলা ভেজা-ভেজা।
আমার চোখ ছলছল। সুপ্রিয় কাঁদছে। কারণ, একটি কবিতা। যে কবিতা আমাদের তিনজন’কে বেঁধে
দিয়েছে এক ব্যথার সুরে।
এমন অনেক মুহূর্ত
দু’মলাটের মধ্যে জমে থাকতে দেখে আজ তাই হারিয়ে ফেলেছি তথাকথিত ‘গ্রন্থ সমালোচনা’র সামান্য
ক্ষমতাটুকুও। আমার দ্বারা এ হওয়ার নয়। ‘দোয়াতে যুবতী চাঁদ’ মিলনদার সন্তান হলে, আমি
‘কাকা’ গোছের কিছু একটা তো বটেই! যেমনই হোক – চঞ্চল বা শান্ত, নিজের ভাইপো’র চরিত্র
নিয়ে আলোচনা করতে কারই বা ভালো লাগে! তাই রেখে গেলাম কিছু মুহূর্তকথা, যা আমাদের নিজস্ব।
বারান্দায় প্ল্যাস্টিকের লাল ফুটবল নিয়ে খেলার মতোই সুখস্মৃতি ঘিরে আছে যাদের। আমার
সাধ্য কী, হাঁড়িমুখ ‘আলোচনা’য় তাদের পর করে দিই!
“পাশে রাখো। কাছে
রাখো।
কথাদেরও আশ্রয় লাগে।”
খুব ভালো আলোচনা। মিলনের বইটাও চমৎকার ! যেমন মিলন নিজেও চমৎকার মনের মানুষ। আলোচককে শুভেচ্ছা জানাই।
উত্তরমুছুন