বিছানা আলাদা হয়ে গেছে ২৩ বছর হল। তবু প্রতিবছর
২১ ফেব্রুয়ারি এলেই প্রচুর শুভ
বিবাহবার্ষিকী বা হ্যাপি অ্যানিভারসারি ম্যাসেজ ঝাঁপিয়ে পড়ে মোবাইলে, ফেসবুকের ওয়ালে বা ইনবক্সে। প্রতিটি
শুভেচ্ছাবার্তাই এক-একটা পিনের মতো ফোটে
বুকের মধ্যে। কী যে যন্ত্রণা ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে, বোঝানো
যায় না কাউকেই।
বিয়ের ঠিক হয়েছিল পরমজিতের দাদার সঙ্গে। কথাবার্তা ঠিকঠাক হল দ্রুতই। দেখাশোনার দিন দশেকের মধ্যেই পাকা কথা হল, বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু মানুষটা কী কারণে যেন বিয়ের পিঁড়িতে বসার কিছুক্ষণ আগেই এক কাকাকে বলে চলে গেল বিয়ের আসর থেকে। সারা বাড়ি স্তব্ধ। সেইসময় পরমজিৎকে সবাই রাজি করাল। আবার বিয়ে বাড়ি জেগে উঠল। এত বড় একটা হুলুস্থুলু ব্যাপার কারোর মনেই রেখাপাত করল না। আসলে পরমজিৎকে দেখতে শুনতে দাদার থেকে ভালোই। চাকরিও করে দাদার থেকেও ভালো। অমায়িক ব্যবহার। সব মিলিয়ে পরমজিৎকে পেয়ে বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজন বরং খুশিই হল।
বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে পরমজিৎ ওর বাড়ির লোকদের কাছে শর্ত দিল, বিয়ের পরপর কদিন কাটুক। তারপর আর দাদার সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্রব থাকবে না। যাকে বিয়ে করার কথা ছিল সে তখন হবে ভাইয়ের বউ। এমনকি অষ্টমঙ্গলার পরে ওই বাড়িতেও আর থাকবে না, আলাদা ফ্ল্যাটে থাকবে বলেও জানিয়ে দিল। আমি এসব কথা পরে শুনেছি। পরমজিৎ তো বৌভাতের পরের দিন থেকেই ফ্ল্যাট খোঁজা শুরু করে দিয়েছিল। আগে আমরা একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকতাম। ওদের বাড়ির কাছাকাছিই। মাস তিনেক পরে এই ফ্ল্যাটে চলে আসি। এখন আমার শ্বশুরবাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। আমরা যখন মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম ছুটির দিনে, তখন দাদা বাড়িতে থাকতেন না, কোনোদিনও না।
বড় সুখের ছিল সেইসব দিন। কিন্তু সুখ বেশিদিন সইল না আমার। সমস্যা দেখা দিল বছর তিনেক বাদে। একদিন দুপুরে হঠাৎই সেই দাদা ফ্ল্যাটে এসে হাজির। নানা কথা হল, কিন্তু কেন এসেছিলেন তা বললেন না। দুপুরে জোর করে খাইয়েই ছাড়লাম।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে পরমজিৎ সব শুনল। মুখটা গম্ভীর করে বলল, এতদিন যার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখলাম না, আজ কী মনে করে এলো সে ? আর তারপর থেকেই ক্রমশ দূরে সরে গেল পরমজিৎ। কথাও বন্ধ হয়ে গেল সবকিছুর মতোই।
বাবিন যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে প্রথম ব্যাঙ্গালুরু গেল, সেই ছ’বছর আগেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল। বলেছিল, মা তুমি তো একা একাই থাকো। ফেসবুক করো। সময় কাটবে, ভালো লাগবে। আমার সঙ্গেও চ্যাটিংয়ে রোজ গল্প করতে পারবে।
বাবিনই আমার জন্মতারিখ, বিয়ের তারিখ সব তথ্য সাজিয়ে দিয়েছে ফেসবুকে। ফলে ফেসবুকের বন্ধুরা জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানায়, বিবাহবার্ষিকীতেও জানায়। যাদের সঙ্গে সখ্যতা বেড়েছে, ফোন নম্বর দেওয়া-নেওয়া হয়েছে, তারা ফোনেও শুভকামনা জানায়। আর আমাকে যন্ত্রণা সইতে সইতে লিখতে হয় থ্যাঙ্কস, বা ভালো থেকো। আমি যে নিজেই ভালো নেই, সে খবর কেউ জানে না।
কতবার বলেছি এইসব তারিখ-টারিখ হাইড করে দে বাবিন। কিছুতেই শুনবে না কথা। অথচ ও বোঝে মায়ের কষ্ট। তবু দেবে না। আমি নিজেও বুঝি না এসব। এত বছর হল, তবু এসব ব্যাপার বুঝে উঠতে পারি না কিছুতেই। কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও সাহস হয় না। কেন হাইড করতে চাই এই প্রশ্ন করে বসে যদি কেউ !
_ দেখ বাবিন, তুই তো বুঝিস সব বাবা , জন্মতারিখটা থাক। অন্তত বিবাহবার্ষিকীর দিনটা হাইড করে দে !
_ থাক না মা, এই দিনটা যে আমার কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
_ তোর কাছে ?
_ হ্যাঁ মা, এই দিনটায় তুমি আর বাবা যদি এক না-হতে তাহলে আমি যে থাকতাম না মা !
আরও নানা যুক্তি দিয়ে গেল। কিছুতেই হাইড করাতে রাজি করা গেল না। ব্যাঙ্গালুরুতে পড়তে গিয়ে সেখানেই সেট্ল করে গেল বাবিন।
(২)
বিপ্রদাস মল্লিক মাঝে মাঝে ছোঁক ছোঁক করে। ইনিয়েবিনিয়ে নানা কথা বলে ইনবক্সে। না-জেনেই বলে, আমি নিশ্চিত। জানবেই বা কী করে। আমার নাম ছিল বিপাশা রায়। আর বিয়ের পরে ভালোবেসে পরমজিৎ নাম রেখেছিল বলাকা। হয়তো আগের সব ঘটনার মতো আমার আগের নামটাও মুছে দিতে চেয়েছে। আর বাবিনের জন্য ফেসবুকেও আমার নাম বলাকা ঘোষ। আর কৈশোরের সেই শ্যামলা রোগা মেয়েটি তো আর নেই, এখন আমি পৃথুলা। মুখের গড়ন পালটে গেছে অনেকটাই। কিশোরী বিপাশার ছবি আছে যদিও, কিন্তু সেটা পোস্ট করতে চাই না কারো কাছেই। পুরানো বন্ধুরা যদি চিনে ফেলে, আর যদি প্রশ্ন করে বিবাহসম্পর্কের তল-অতল ? তখন কী জবাব দেবো ? জনে জনে আমার দুঃখগীতি গেয়ে বেড়াব ? সে কি সম্ভব ? আমি পারব না, কিছুতেই পারব না। তাই বয়ে বেড়াতেই হবে এই যন্ত্রণার অভিজ্ঞান।
বিপ্রদা ছিল লেখালেখির জগতের লোক। বাবার একমাত্র কবিতার বইটা যখন বের হল, বাড়িতেই একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান হল। বিপ্রদা সবকিছ দেখাশোনা করছিল। মনে আছে, অনুষ্ঠান শেষে কয়েকজন মিলে উপরের ঘরে আড্ডা দিচ্ছিল। বিপ্রদা নীচে নেমে এলো সিগারেট খেতে। কী একটা কাজে আমিও নেমে এলাম। সিঁড়ির শেষ ধাপে যখন, তখনই বিপ্রদা আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। আমি ছিটকে সরে গেলাম। তামাকের কটু গন্ধের জন্য নয়, জোর করাটা আমার ভিতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি তো বিপ্রদাতে মুগ্ধই। একবার বলতে পারল না মুখ ফুটে ? নাকি সেদিন সারাক্ষণ বিপ্রদার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম বলে জোর করার অধিকার পেয়ে বসেছিল ? খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। কষ্টও কম পাইনি।
মাঝে মাঝে ভাবি ফেসবুকে ঢুকবোই না আর। কিন্তু কী এক অমোঘ টানে প্রতিদিন ফেসবুক ওপেন করি। আসলে আর যাই দেখি না কেন, বিপ্রদার প্রোফাইলে একবার ঘুরে আসি। কোনো পোস্ট না-দেখলে ভাবি, অসুখবিসুখ করেনি তো ? আর মনে মনে বলি, আমি কিন্তু এখনো তোমাকে ...
হঠাৎই মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। কালই ২১ ফেব্রুয়ারি, তার মানে আজ মধ্যরাত থেকেই আছড়ে পড়বে নানা শুভেচ্ছাবার্তা।
একবার উঁকি মেরে দেখে আসি বাবিনের বাবাকে। প্রতিদিনই দেখে আসি এইসময়। আর অবধারিত একই দৃশ্য দেখতে হয়, অঘোরে ঘুমোচ্ছে মাথার নীচে হাত রেখে।
রাত অনেক হল। বাবিন থাকলে বারোটার আগে ঘুমাতেই যাই না আমরা। আর এখন দশটা বাজলেই টেবিলের উপর রান্নার দিদির ঢাকা দেওয়া খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। কেউ কাউকে ডাকি না খাবার খেতে। নিজের নিজের মতো খেয়ে নিই।
শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে ফেসবুক খুলে একবার বিপ্রদার প্রোফাইল ছবি দেখি অনেকক্ষণ ধরে। চোখ দুটো দিয়ে যেন হাসি ছড়িয়ে পড়ছে ! তারপর নেট বন্ধ করে শুয়ে পড়ি।
বিপ্রদা দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢোকে। একমুখ দাড়ি আর উজ্জ্বল দুটো চোখ দিয়ে যেন জ্যোতি বের হচ্ছে। আস্তে আস্তে এসে আমার হাত ধরল বিপ্রদা। তারপর আমাকে টেনে তুলল বিছানা থেকে। সম্মোহিতের মতো আমি উঠে দাঁড়াই। কীভাবে বিপ্রদা এত রাতে এখান এলো ? তাহলে কি আমাকে চিনতে পেরেছিল বিপ্রদা ? উপরে আমরা দুজনেই দরজা খুলে ঘুমাই। কিন্তু নীচের কোলাপসিব্ল কে খুলে দিল ? ভাবি, কিন্তু কিছুই বলতে পারি না। ঘোরের মধ্যেই বিপ্রদার হাত ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। কোনো কথা হয় না আমাদের। আমরা যেন কথা হারিয়ে ফেলেছি।
খুব তৃষ্ণার্ত মনে হয় নিজেকে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। বিপ্রদার ঠোঁটে মুখ ডুবিয়ে তৃষ্ণা মেটাই। বিপ্রদাও কি খুব তৃষ্ণার্ত ছিল ? না-হলে এমন করে দীর্ঘ চুম্বনে আমাকে আটকে রেখেছিল কেন ? সারা শরীরে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল কেন ?
আমাকে প্রায় কোলে করে বিপ্রদা খাটে নিয়ে আসে। তারপর গুরুগুরু মেঘ ডাকল। আর শিরশিরে হাওয়া। নেমে এলো তুমুল বৃষ্টি। বিদ্যুতের ঝলক ছুঁয়ে দিল শিরদাঁড়া। সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে আমার। ওহ্, কতদিন পরে শরীরজুড়ে বৃষ্টি নামল আমার !
ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলেই বিপ্রদার কথা মনে হল। একটা অসম্ভব ভালো লাগা লেপ্টে আছে পোশাকহীন শরীরে। পাশ ফিরে দেখি কেউ নেই। আর চকিতে আবিষ্কার করি আমি পরমজিতের বিছানায় শুয়ে আছি আমি।
তাড়াতাড়ি কাপড়টা খাটের নীচ থেকে তুলে গায়ে জড়িয়ে নিই। ততক্ষণে পরমজিৎ চা নিয়ে এসেছে। ঠিক বিয়ের প্রথম তিনবছর যেমন করত। মুখে পরম আদুরে হাসি।
তাহলে বিপ্রদা ছাড়া বাকি সব সত্যিই ? একদম সত্যি ? তার আবেশ, তার সমস্ত চিহ্ন সেকথাই তো প্রমাণ করে !
স্নান সেরে পাশের বাড়ির মিতিনকে ডাকি। “আমাদের একটা ছবি তুলে দিবি মিতিন মা ?” গতবছরই মিতিন মাধ্যমিক পাশ করেছে। মাঝে মাঝে মিতিনই আমার একাকীত্বের নীরবতা ভাঙে। কোনো কোনো একলা বিকেলে মিতিন আমাকে সঙ্গ দেয়। “একটু বাদেই আসছি কাকিমণি।” মিতিন জানিয়ে দেয়।
আলমারি খুলে খুঁজতে থাকি কী শাড়ি পরব। আজকের দিনে ঠিক কোনটা আমাকে মানাবে। বেনারসী ? ভাবনাটা মাথায় আসার পরেই মনে মনে হেসে উঠি। তাহলে কি ইক্কত ? দেখি পরমজিৎ সবুজ পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে আমিও সবুজ গাদোয়ালটাই পরি ? জিজ্ঞাসাটা যেন পরমজিৎকেই।
মিতিনের তোলা কয়েকটা ছবির থেকে বাছাই করে একটা ছবি ফেসবুকে আপলোড করলাম। ক্যাপশন দিলাম “ ২৩তম বিবাহদিনে আমরা।” আর একটা দিলাম বাবিনের হোয়াটসঅ্যাপে।
ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। অনেক অনেক দূরে। হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে। তাকিয়ে দেখি বাবিনের নাম ভেসে উঠল।
বিয়ের ঠিক হয়েছিল পরমজিতের দাদার সঙ্গে। কথাবার্তা ঠিকঠাক হল দ্রুতই। দেখাশোনার দিন দশেকের মধ্যেই পাকা কথা হল, বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু মানুষটা কী কারণে যেন বিয়ের পিঁড়িতে বসার কিছুক্ষণ আগেই এক কাকাকে বলে চলে গেল বিয়ের আসর থেকে। সারা বাড়ি স্তব্ধ। সেইসময় পরমজিৎকে সবাই রাজি করাল। আবার বিয়ে বাড়ি জেগে উঠল। এত বড় একটা হুলুস্থুলু ব্যাপার কারোর মনেই রেখাপাত করল না। আসলে পরমজিৎকে দেখতে শুনতে দাদার থেকে ভালোই। চাকরিও করে দাদার থেকেও ভালো। অমায়িক ব্যবহার। সব মিলিয়ে পরমজিৎকে পেয়ে বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজন বরং খুশিই হল।
বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে পরমজিৎ ওর বাড়ির লোকদের কাছে শর্ত দিল, বিয়ের পরপর কদিন কাটুক। তারপর আর দাদার সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্রব থাকবে না। যাকে বিয়ে করার কথা ছিল সে তখন হবে ভাইয়ের বউ। এমনকি অষ্টমঙ্গলার পরে ওই বাড়িতেও আর থাকবে না, আলাদা ফ্ল্যাটে থাকবে বলেও জানিয়ে দিল। আমি এসব কথা পরে শুনেছি। পরমজিৎ তো বৌভাতের পরের দিন থেকেই ফ্ল্যাট খোঁজা শুরু করে দিয়েছিল। আগে আমরা একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকতাম। ওদের বাড়ির কাছাকাছিই। মাস তিনেক পরে এই ফ্ল্যাটে চলে আসি। এখন আমার শ্বশুরবাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। আমরা যখন মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম ছুটির দিনে, তখন দাদা বাড়িতে থাকতেন না, কোনোদিনও না।
বড় সুখের ছিল সেইসব দিন। কিন্তু সুখ বেশিদিন সইল না আমার। সমস্যা দেখা দিল বছর তিনেক বাদে। একদিন দুপুরে হঠাৎই সেই দাদা ফ্ল্যাটে এসে হাজির। নানা কথা হল, কিন্তু কেন এসেছিলেন তা বললেন না। দুপুরে জোর করে খাইয়েই ছাড়লাম।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে পরমজিৎ সব শুনল। মুখটা গম্ভীর করে বলল, এতদিন যার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখলাম না, আজ কী মনে করে এলো সে ? আর তারপর থেকেই ক্রমশ দূরে সরে গেল পরমজিৎ। কথাও বন্ধ হয়ে গেল সবকিছুর মতোই।
বাবিন যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে প্রথম ব্যাঙ্গালুরু গেল, সেই ছ’বছর আগেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল। বলেছিল, মা তুমি তো একা একাই থাকো। ফেসবুক করো। সময় কাটবে, ভালো লাগবে। আমার সঙ্গেও চ্যাটিংয়ে রোজ গল্প করতে পারবে।
বাবিনই আমার জন্মতারিখ, বিয়ের তারিখ সব তথ্য সাজিয়ে দিয়েছে ফেসবুকে। ফলে ফেসবুকের বন্ধুরা জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানায়, বিবাহবার্ষিকীতেও জানায়। যাদের সঙ্গে সখ্যতা বেড়েছে, ফোন নম্বর দেওয়া-নেওয়া হয়েছে, তারা ফোনেও শুভকামনা জানায়। আর আমাকে যন্ত্রণা সইতে সইতে লিখতে হয় থ্যাঙ্কস, বা ভালো থেকো। আমি যে নিজেই ভালো নেই, সে খবর কেউ জানে না।
কতবার বলেছি এইসব তারিখ-টারিখ হাইড করে দে বাবিন। কিছুতেই শুনবে না কথা। অথচ ও বোঝে মায়ের কষ্ট। তবু দেবে না। আমি নিজেও বুঝি না এসব। এত বছর হল, তবু এসব ব্যাপার বুঝে উঠতে পারি না কিছুতেই। কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও সাহস হয় না। কেন হাইড করতে চাই এই প্রশ্ন করে বসে যদি কেউ !
_ দেখ বাবিন, তুই তো বুঝিস সব বাবা , জন্মতারিখটা থাক। অন্তত বিবাহবার্ষিকীর দিনটা হাইড করে দে !
_ থাক না মা, এই দিনটা যে আমার কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
_ তোর কাছে ?
_ হ্যাঁ মা, এই দিনটায় তুমি আর বাবা যদি এক না-হতে তাহলে আমি যে থাকতাম না মা !
আরও নানা যুক্তি দিয়ে গেল। কিছুতেই হাইড করাতে রাজি করা গেল না। ব্যাঙ্গালুরুতে পড়তে গিয়ে সেখানেই সেট্ল করে গেল বাবিন।
(২)
বিপ্রদাস মল্লিক মাঝে মাঝে ছোঁক ছোঁক করে। ইনিয়েবিনিয়ে নানা কথা বলে ইনবক্সে। না-জেনেই বলে, আমি নিশ্চিত। জানবেই বা কী করে। আমার নাম ছিল বিপাশা রায়। আর বিয়ের পরে ভালোবেসে পরমজিৎ নাম রেখেছিল বলাকা। হয়তো আগের সব ঘটনার মতো আমার আগের নামটাও মুছে দিতে চেয়েছে। আর বাবিনের জন্য ফেসবুকেও আমার নাম বলাকা ঘোষ। আর কৈশোরের সেই শ্যামলা রোগা মেয়েটি তো আর নেই, এখন আমি পৃথুলা। মুখের গড়ন পালটে গেছে অনেকটাই। কিশোরী বিপাশার ছবি আছে যদিও, কিন্তু সেটা পোস্ট করতে চাই না কারো কাছেই। পুরানো বন্ধুরা যদি চিনে ফেলে, আর যদি প্রশ্ন করে বিবাহসম্পর্কের তল-অতল ? তখন কী জবাব দেবো ? জনে জনে আমার দুঃখগীতি গেয়ে বেড়াব ? সে কি সম্ভব ? আমি পারব না, কিছুতেই পারব না। তাই বয়ে বেড়াতেই হবে এই যন্ত্রণার অভিজ্ঞান।
বিপ্রদা ছিল লেখালেখির জগতের লোক। বাবার একমাত্র কবিতার বইটা যখন বের হল, বাড়িতেই একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান হল। বিপ্রদা সবকিছ দেখাশোনা করছিল। মনে আছে, অনুষ্ঠান শেষে কয়েকজন মিলে উপরের ঘরে আড্ডা দিচ্ছিল। বিপ্রদা নীচে নেমে এলো সিগারেট খেতে। কী একটা কাজে আমিও নেমে এলাম। সিঁড়ির শেষ ধাপে যখন, তখনই বিপ্রদা আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। আমি ছিটকে সরে গেলাম। তামাকের কটু গন্ধের জন্য নয়, জোর করাটা আমার ভিতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি তো বিপ্রদাতে মুগ্ধই। একবার বলতে পারল না মুখ ফুটে ? নাকি সেদিন সারাক্ষণ বিপ্রদার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম বলে জোর করার অধিকার পেয়ে বসেছিল ? খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। কষ্টও কম পাইনি।
মাঝে মাঝে ভাবি ফেসবুকে ঢুকবোই না আর। কিন্তু কী এক অমোঘ টানে প্রতিদিন ফেসবুক ওপেন করি। আসলে আর যাই দেখি না কেন, বিপ্রদার প্রোফাইলে একবার ঘুরে আসি। কোনো পোস্ট না-দেখলে ভাবি, অসুখবিসুখ করেনি তো ? আর মনে মনে বলি, আমি কিন্তু এখনো তোমাকে ...
হঠাৎই মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। কালই ২১ ফেব্রুয়ারি, তার মানে আজ মধ্যরাত থেকেই আছড়ে পড়বে নানা শুভেচ্ছাবার্তা।
একবার উঁকি মেরে দেখে আসি বাবিনের বাবাকে। প্রতিদিনই দেখে আসি এইসময়। আর অবধারিত একই দৃশ্য দেখতে হয়, অঘোরে ঘুমোচ্ছে মাথার নীচে হাত রেখে।
রাত অনেক হল। বাবিন থাকলে বারোটার আগে ঘুমাতেই যাই না আমরা। আর এখন দশটা বাজলেই টেবিলের উপর রান্নার দিদির ঢাকা দেওয়া খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। কেউ কাউকে ডাকি না খাবার খেতে। নিজের নিজের মতো খেয়ে নিই।
শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে ফেসবুক খুলে একবার বিপ্রদার প্রোফাইল ছবি দেখি অনেকক্ষণ ধরে। চোখ দুটো দিয়ে যেন হাসি ছড়িয়ে পড়ছে ! তারপর নেট বন্ধ করে শুয়ে পড়ি।
বিপ্রদা দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢোকে। একমুখ দাড়ি আর উজ্জ্বল দুটো চোখ দিয়ে যেন জ্যোতি বের হচ্ছে। আস্তে আস্তে এসে আমার হাত ধরল বিপ্রদা। তারপর আমাকে টেনে তুলল বিছানা থেকে। সম্মোহিতের মতো আমি উঠে দাঁড়াই। কীভাবে বিপ্রদা এত রাতে এখান এলো ? তাহলে কি আমাকে চিনতে পেরেছিল বিপ্রদা ? উপরে আমরা দুজনেই দরজা খুলে ঘুমাই। কিন্তু নীচের কোলাপসিব্ল কে খুলে দিল ? ভাবি, কিন্তু কিছুই বলতে পারি না। ঘোরের মধ্যেই বিপ্রদার হাত ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। কোনো কথা হয় না আমাদের। আমরা যেন কথা হারিয়ে ফেলেছি।
খুব তৃষ্ণার্ত মনে হয় নিজেকে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। বিপ্রদার ঠোঁটে মুখ ডুবিয়ে তৃষ্ণা মেটাই। বিপ্রদাও কি খুব তৃষ্ণার্ত ছিল ? না-হলে এমন করে দীর্ঘ চুম্বনে আমাকে আটকে রেখেছিল কেন ? সারা শরীরে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল কেন ?
আমাকে প্রায় কোলে করে বিপ্রদা খাটে নিয়ে আসে। তারপর গুরুগুরু মেঘ ডাকল। আর শিরশিরে হাওয়া। নেমে এলো তুমুল বৃষ্টি। বিদ্যুতের ঝলক ছুঁয়ে দিল শিরদাঁড়া। সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে আমার। ওহ্, কতদিন পরে শরীরজুড়ে বৃষ্টি নামল আমার !
ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলেই বিপ্রদার কথা মনে হল। একটা অসম্ভব ভালো লাগা লেপ্টে আছে পোশাকহীন শরীরে। পাশ ফিরে দেখি কেউ নেই। আর চকিতে আবিষ্কার করি আমি পরমজিতের বিছানায় শুয়ে আছি আমি।
তাড়াতাড়ি কাপড়টা খাটের নীচ থেকে তুলে গায়ে জড়িয়ে নিই। ততক্ষণে পরমজিৎ চা নিয়ে এসেছে। ঠিক বিয়ের প্রথম তিনবছর যেমন করত। মুখে পরম আদুরে হাসি।
তাহলে বিপ্রদা ছাড়া বাকি সব সত্যিই ? একদম সত্যি ? তার আবেশ, তার সমস্ত চিহ্ন সেকথাই তো প্রমাণ করে !
স্নান সেরে পাশের বাড়ির মিতিনকে ডাকি। “আমাদের একটা ছবি তুলে দিবি মিতিন মা ?” গতবছরই মিতিন মাধ্যমিক পাশ করেছে। মাঝে মাঝে মিতিনই আমার একাকীত্বের নীরবতা ভাঙে। কোনো কোনো একলা বিকেলে মিতিন আমাকে সঙ্গ দেয়। “একটু বাদেই আসছি কাকিমণি।” মিতিন জানিয়ে দেয়।
আলমারি খুলে খুঁজতে থাকি কী শাড়ি পরব। আজকের দিনে ঠিক কোনটা আমাকে মানাবে। বেনারসী ? ভাবনাটা মাথায় আসার পরেই মনে মনে হেসে উঠি। তাহলে কি ইক্কত ? দেখি পরমজিৎ সবুজ পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে আমিও সবুজ গাদোয়ালটাই পরি ? জিজ্ঞাসাটা যেন পরমজিৎকেই।
মিতিনের তোলা কয়েকটা ছবির থেকে বাছাই করে একটা ছবি ফেসবুকে আপলোড করলাম। ক্যাপশন দিলাম “ ২৩তম বিবাহদিনে আমরা।” আর একটা দিলাম বাবিনের হোয়াটসঅ্যাপে।
ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। অনেক অনেক দূরে। হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে। তাকিয়ে দেখি বাবিনের নাম ভেসে উঠল।
খুব ভালো লেগেছে গল্পটি।ঝরঝরে,সুখপাঠ্য।এক নিশ্বাসে পড়ে গেলাম।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লেগেছে গল্পটি।ঝরঝরে,সুখপাঠ্য।এক নিশ্বাসে পড়ে গেলাম।
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা রইল কাজরী বোস। ভালো থাকবেন।
উত্তরমুছুন