সহেলী রায় - মায়াজম

Breaking

১৮ মার্চ, ২০১৬

সহেলী রায়

                                হাতিয়ার








চুলে তেল মালিশ করতে করতে দু ভুরুর মাঝখানে ডজন খানেক বিরক্তি আটকে রেখেছিল মনি। সেই মাধ্যমিক পরীক্ষার টেস্টের পর থেকে ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত চুলে জল, তেল কিছুই ভাল করে পড়েনি। জটে ভর্তি। তখন পড়া থেকে উঠে একটু অন্যমনস্ক হলেই বুড়ি যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হতেন।
- বলি নবাবনন্দিনীর কি লেখাপড়া শিকেয় উঠল
- আহ ঠাকুমা, খালি পড়া পড়া কোর না তো, এই তো উঠলুম
- তোর দিদিকে দ্যাখ, রাতদিন বইএ মুখ গুঁজে থাকে, এক তুই হয়েছিস, পড়া দেখলেই পালিয়ে বেড়াস। পালিয়ে আর যাবি কই? সেই হেঁশেলেই কাটবে জীবন
- তা পড়ে বুঝি হেঁশেল আন্দোলন করব? সেই তো বড় মাছটা ভাইয়েরই জোটে, জন্মদিনে পায়েস শুধু ওর জন্যই, আমার আর দিদির বেলায় কাঁচকলা
- খালি খাই খাই মুখপুড়ির। লেখাপড়া করলে অমন মাছ, পায়েস নিজেই খেতে পাবি, কারো হাত গুণতে হবেনি
বর্ধমান জেলার নাচন গ্রামের রায়পাড়ার একমাত্র দোতলা বাড়ির বরেন রায়ের একমাত্র ছোট নাতনী মনি। বড় অনি। পুত্রসন্তানের আশায় বরেন রায়ের একমাত্র ছেলের বৌ যখন আবার সন্তানসম্ভবা তখন বরেনবাবু শ্মশানকালী মন্দিরে তান্ত্রিক বাবার কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে ছিলেন, এবার যেন বংশপ্রদীপ আসে। কিন্তু দ্বিতীয় বারেও আশা ক্ষুণ্ণ হয়। ঠাকুমার আদরের মনি- বাবা, দাদুর চক্ষুশূল। মাকে আজও বুঝে উঠতে পারেনা সে।সারাক্ষণ কাঠের পুতুলের মত হাবভাব। তৃতীয়বার আর কোন ফাঁক রাখেননা বরেন রায়। বৌমাকে নিয়ে সটান হাজির তান্ত্রিক বাবার কাছে। ঘন্টাতিনেক সেখানেই রেখে আসে তাকে। ফেরার পর স্ত্রী উমারানী চেঁচামেচি শুরু করেন।উমারানীকে ঘরে আটকে শেকল তুলে দেন বরেন। সারাদিন খাওয়াও জোটেনি সেদিন। নমাসের মাথায় মনির মা ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়। মনির দিদি অনি ছোট থেকেই পড়াশোনায় মেধাবী। যদিও অল্প কিছুদিন পড়ার পর বরেনবাবু ঘোষণা করেন অনি এবার বাড়ির কাজকর্ম শিখুক। পড়ে কাজ নেই। কিন্তু গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টারমশাইয়ের অনুরোধ আর উমারানীর অত্যাচারে অনিকে স্কুল ছাড়ানো গেলনা কিছুতেই। অনি মাধ্যমিকে সাতটা লেটার আর স্টার মার্ক্স নিয়ে পাশ করল। হেডস্যর নিজে শহরের স্কুলে অনিকে ইলেভেন ক্লাসে ভর্তি করে এলেন। বরেনবাবু গ্রামের একজন মাতব্বর ব্যক্তি। চারিদিকে নারীশিক্ষার বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান।নাতনির বেলায় নিজের সম্মান রক্ষার্থে আর ঘরের কেচ্ছা বাইরে আনলেন না। তবে চুপচাপ, মেধাবী বড় নাতনিটিকে একটু সমঝেই চলেন তিনি। উমারানীর বড় গর্বের অনি। মনির পড়াশোনায় তেমন মন নেই। কিন্তু ঠাকুমার গঞ্জনায় সেও টেনে যাচ্ছে। মাথাটি ভালই তবে মোটেই পড়তে চায় না সে।
- কিরে একটু ইলেভেনের বইগুল তো দেখতে পারিস
অনি বারান্দায় বসে অঙ্ক কষছে। আর কিছুদিন পর তারও ইলেভেনের ফাইনাল পরীক্ষা।
- উফ দিদি তুইও? আগে এটা পাশ দি
- পাশ তো দিবিই
- তোর মত নাকি। নীরেন স্যর সেদিন বাড়ি বয়ে বলেই গেলেন, তুই এমনিই টুয়েলভে উঠে গেছিস। সমস্ত সেমিস্টারে তুইই হায়েস্ট। শুধু সরকারি নিয়ম, তাই তোকে বসতে হবে।
- অত নিয়ম টিয়ম জানিনে, আমি পরীক্ষা দেব। আর বোন, ঠাকুমা ঠিকই বলে। মেয়ে হয়েছি তাই শুধু রান্নাবান্না আর সন্তান উৎপাদন করব?
- চাকরি পেলে করবি দিদি? বাবা, দাদু করতে দেবে?
- করবই তো, তুইও করবি
ফেব্রুয়ারি মাস। গ্রামের দিকে এখনো ঠান্ডা ভাব। মনির বাবা মাধব রায় একটি সরকারি কলেজের আকাউন্টেট। মনির ভাই রাজু শহরের নামকরা ইংরেজি স্কুলে পড়ে। বরেন রায়ের নাতি গ্রামের বাংলা মিডিয়ামে পড়লে তাঁর নাক কাটা যায়। তাই এই ব্যবস্থা। সামনে রাজুরও ফাইনাল পরীক্ষা। তার জন্য বোর্নভিটা আর নতুন পেন্সিলবক্স নিয়ে মাধব ঘরে ঢুকলেন। মনি তখন ঠাকুমার ঘরে টিভি দেখছে।
- দেখলে, ভাইয়ের পরীক্ষা নিয়ে কত আদিখ্যেতা
- চুপ করে টিভি দ্যাখ, মাধ্যমিক অব্দি গড়িয়ে নিলি দাদুর আমলে এই তোর ভাগ্যি ভাল
- এসব একচক্ষু গেলে দিতে ইচ্ছে করে।
- চুপ করতে বললুম তো, দাদু শুনলেই...
কথা শেষ হবার আগেই বরেনবাবু ঘরে ঢুকলেন
-কিসের এত কথা হচ্চে?
- অ কিছু না তুমি যাও
উমারানী চাপা দেবার চেষ্টা করলেন
- কিছু নয় আবার কি? কই আমার, দিদির পরীক্ষায় তো এককাপ চাও জোটেনি। ভাইয়ের বেলায় বোর্নভিটা?
মনি গর্জে উঠল।
- ভাইয়ের খাবারে লোভ, মেয়ে মানুষের এত লোভ কিসের?
- লোভ কেন? একই বাড়িতে দুরকম নিয়ম কিসের?
মাধব ছুটে এলেন ঘর থেকে।
- দাদুর মুখে মুখে কথা?
বলেই দুরদার মারতে শুরু করলেন মেয়েকে। বরেনও হাত লাগালেন। উমারানী আটকাতে গিয়ে বরেনের হাতে চড় খেলেন।মনির মা ভয়ে সিটিয়ে রইলেন। অনিও পড়া ফেলে নেমে এল ঘর থেকে।
- গায়ে হাত তুললে?
- খুন করে দেব, যদি রাজুকে নিয়ে এ বাড়িতে একটাও কথা হয়। আজ তোমার জন্যই এত বেড়েছে মেয়েটা। ইচ্ছে নেই ওর পড়ার। তুমি জোর করে-
মনির ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরচ্ছে। গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ। ফোঁপাতে ফোঁপাতে শুয়ে রইল ঠাকুমার ঘরেই। উমারানিও রাতের খাবার খেলেন না। দরজায় শিকল দিয়ে শুয়ে পড়লেন।অনির কিছুতেই পড়ায় মন বসছে না আজ। মনিটা যে কি করে। এসব করে কি লাভ?
রাত দেড়টা। একটা হিস হিস শব্দে মনির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই ঠোঁটের পাশে ব্যথাটা অনুভব করল। ব্যথার চোটে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। পাশ ফিরে দেখল ঠাকুমা বিছানায় নেই। দরজার শিকল খোলা , আলতো করে ভেজানো।
- ঠাকুমা, ঠাকুমা
মনি ডাকতে ডাকতে বাইরে বেরিয়ে এল। গা শির শির করে উঠল।
সামনেই এক বিষধর ফনা তুলে মনির দিকেই তাক করে আছে। আর এক ধাপ এগোলেই মনি শেষ। মনি নড়তে পারছে না। কেউ যেন আটকে রেখেছে তাকে। মনির কাঁধে একটা ঠাণ্ডা হাত এসে ছুঁল। মনি শিউরে উঠল।
- ভয় কিসের, আমি আছি তো
মনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল উমারানী। লালপেড়ে শাড়িতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুরের টিপ কপালে। কি সুন্দর লাগছে ঠাকুমাকে। কিন্তু গালে এতটা পোড়া দাগ কেন?
- তুমি কোথায় ছিলে ঠাকুমা?
- এই তো তোর কাছেই, যা ঘরে যা। ঐ বিষধরের ছোবল খাবি নাকি? তোর গায়ে হাত দিতে এলে আমার কাছে নিস্তার নেই
ঠাকুমার চোখ জ্বলছে।
- তোমার গাল পুড়ল কি করে?
- কিছু না। সাপ মারার বিষ লেগেছে। তুই ঘরে যা। আমি ওটাকে মেরে আসি
- তুমি পারবে? বিষধর
- পারব। তুই শুধু কোন অবস্থাতেই লেখাপড়া ছাড়িস না। ওটাই তোর হাতিয়ার। কোন বিষ ছোঁবেনা তোকে।
দোতলার বারান্দার লাইট জ্বলে উঠল। অনি ওপর থেকে জিগেস করল
- বোন, এত রাতে কার সাথে কথা বলছিস? বাইরে এলি কেন?
- কিছু না দিদি, তুই পড়।

ওপরের আলো যেটুকু পড়েছে উঠোনে তাতে কাউকে দেখতে পেল না মনি। ঠাকুমা কোথায় গেল কে জানে।

মনি ঘরে এসে চোখ বুজল। ভোরবেলা মায়ের চিৎকারে ধড়মড় করে উঠল। বাবা, দাদু, দিদি, ভাই সবাই নেমে এসেছে। আশপাশ থেকে লোকজনো জড়ো হয়েছে। ঠাকুমা নিথর হয়ে পড়ে আছে। পাশে কার্বলিক আসিডের শিশি।
ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ কার্বলিক অ্যাসিড সেবনে মৃত্যু হয়েছে উমারানীর।
- দিদি, তুই যখন বারান্দায় এলি তখন কটা?
- দেড়টা
মনির হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল ঠাকুমার ইচ্ছে পুরণ হবেই। মনি হাতিয়ার তৈরি করবে।


1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র