অরুণিমা চৌধুরী - মায়াজম

Breaking

১৮ মার্চ, ২০১৬

অরুণিমা চৌধুরী

             চেতনার পিছনে প্রগাঢ় অন্ধকার  








বেশ লম্বা একটা সাধনার ফলে আমি কতকটা উল্টা উল্টা পড়ালেখা শিখে গেছি। যেমন--গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে, আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে অথবা বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে...


এই যে সচেতন বেঁচে থাকা,বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সচেতন থাকা,অথবা সচেতনতার প্রয়োজনে বেঁচে থাকা..কী কারণে, কেন এবং কীভাবে, সে প্রশ্নের রসায়নটি যেমন জটিল,উত্তরটি বোধহয় আরো বেশি জটিল।আমার প্রসঙ্গ অচেতন মন। প্রশ্ন, অচেতন অবস্থায় মন কি ভাবতে সক্ষম!সম্পূর্ণ সজ্ঞানে যেমন ভাবনা,অজ্ঞান অবস্থায় মস্তিষ্কের যে ব্যাখ্যাতীত ভাবনাজাল,তা কি নিয়ন্ত্রণ বিহীন!

এ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা....।
বড় রকমের কিছু প্রয়োজন ছাড়া বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থায়, পুরোপুরি অজ্ঞান করার আর তেমন চল নেই।সেরকমই একটি অবস্থায়,ভয়ংকর টেনশনে, অপারেশনের আগের রাত...তিনবার তিনজন অ্যানেস্থেসিস্ট এসে দফায় দফায় চোখে এবং যন্ত্রে কত কী মেপে টেপে গেছেন।কত কী আওড়েছেন,আমি তার কিছুই জানিনা।শুধু জনে জনে জিজ্ঞাসা করে চলেছি,অজ্ঞান হলে ঠিক কীরকম লাগে,ওই মুহূর্তে,অজ্ঞান থাকার মুহূর্তে ,কিম্বা চেতন অচেতনের একদম মাঝখানের সময়টুকু! এই যে তুড়ি মারলাম,...ফট,...এই যে তুড়ির শব্দটা বাতাসে ফুরিয়ে গেলো, শব্দ ওঠা আর মিলিয়ে যাওয়ার আগের এই ছোট্ট ফাঁক টুকু..এখানে কী থাকে? বলো! কী থাকে! কী থাকে?

অপারেশনটি অনেক বড়,সময়সাপেক্ষ, এবং যথারীতি টুপ করে মরে যাওয়ার সম্ভাবনাও যে কিছু কম,তেমনটা কিন্তু নয়! তবু ওই যে,আমার চিন্তা শুধু মস্তিষ্কের ওই অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থাটি নিয়েই।সেখানেই যত লুকিয়ে থাকা রহস্য।ভাবছি,মরে যাওয়া আর অজ্ঞান হওয়া,...কী তার তফাৎ! কী তার অনুভূতি! প্রশ্ন করি,উত্তর পাইনা।কেউ সেভাবে উত্তর দেয়না,অথবা, এভাবে কেউ ভাবেনা,ভাবতে চায়না বলেই,যেমন জন্মালাম বাঁচলাম,আর টুক করে একদিন মরে গেলাম এর মতো সবটাই জলবৎ তরলং একটা ব্যাখ্যা, যে যেমন পারলেন, আমাকে গছিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করে, আশ্বাস দিলেন,ভয়ের কিছুই নেই।
অতএব, কড়া সিডেটিভের নিশ্চিন্ত ছায়াও আমাকে ঘুমে পেড়ে ফেলতে পারেনা।আমি ভেবে চলি, অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত, এ কোন অলৌকিক মুহূর্তের দিকে এগিয়ে চলেছি! থার্ড ফ্লোর থেকে ফিফথ ফ্লোর,লিফট থেকে টেবিল পর্যন্ত যেন এক অনন্ত যাত্রা.. আমার পথ আর ফুরোয় না..।

টেবিলের উপর শুয়ে চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছি,কত মেশিন,কত রকমের স্ক্রিন! নিজেকে কেমন শহীদ শহীদ ভেবে দু:খ হল।এই যে এত বড় কান্ড একটু পরেই ঘটতে চলেছে,কিছুই কি তার ছায়া ফেলবেনা চেতনায়!!মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে অ্যানেস্থেশিয়ার মাস্ক মুখের উপর চেপে বসানো হয়,আমি চোখ উলটে যতটা সম্ভব দেখার চেষ্টা করি।একবার,দুবার,তিন বার স্প্রে করা হয় ঠান্ডা ইথার..।
কেউ যেন একটা তুড়ি দিলো,...ফট।একটা বুদ্বুদ যেন ফেটে গেলো,.. ফট।মুহূর্তে অন্ধকার।তলিয়ে যাচ্ছি.. কোথাও.. কোথায়! জানিনা তো! মাথার ভেতরটা খুব ফাঁকা,হাল্কা,একটা ফুরফুরে ভাব।যেন গভীর কোন খাদে আমি ভারহীন ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি, যাচ্ছি তো যাচ্ছিই..তারপর আবার অন্ধকার।

চোখের সামনে দুটো জ্বলজ্বলে বিন্দু।কী দেখছি! আমার গা শিরশির করছে,আমি সেই ছোটবেলার শিউলি গাছতলায় ফুল কুড়াচ্ছি,উঁচু ডালে পাতার ফাঁকে একটা উজ্জ্বল সবুজ।নড়ছে,দুলছে,আর চিড়িক চিড়িক চেরা জিভ বের করছে।লাউডগা সাপ! পাশের ডালেই আমার হাত..আমার চোখ বুজে আসছে,আমি আবার তলিয়ে যাচ্ছি, নামছি,আরো গভীর, আরো অনেক গভীরে,সাপের মাথার পাশ দিয়ে,শিউলি গাছের তলা দিয়ে, এবড়োখেবড়ো রাস্তার ঢাল বেয়ে...কোথায়! কীভাবে! জানিনা তো!

দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে,একটা সাইকেল,জল কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে,ডানামেলা অ্যালব্যাট্রসের মতো। তুমুল বৃষ্টি, তুমুল ঝড়।আমি দুটো হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়েছি।আশেপাশে ধান মাঠ,রাস্তা বাড়িঘর,নি:ঝুম,কেউ কোথাও নেই,একলা আমি উড়ে চলেছি দুহাত মেলে,অথবা আমায় নিয়ে আমার সাইকেল! ফিসফিস করে আমি বৃষ্টিকে আদেশ করছি, থামো, থামো। দুহাত বাড়িয়ে ঝড়কে আগলে বলছি,থামো!বৃষ্টির ফোঁটা আর ঝোড়ো বাতাসে আমার শরীর শিউরে উঠছে,আবার,আবার,আবার আমার ভীষণ শীত করছে..আমি নেমে যাচ্ছি আলপথ বেয়ে..আমি নেমে যাচ্ছি চাকায় জল আর মাটি জড়িয়ে,গায়ে শীত জড়িয়ে, জল কণা ছড়িয়ে,তড়তড় করে নেমে যাচ্ছি.. কোথায়! কীভাবে! জানিনা তো!
একটা টলমলে পা এগিয়ে আসছে,একটা দুধের গন্ধ মুখ টানছে আঁচল..মা! মা!মা!আমি পিছন ফিরেছি।আমার সন্তান,গড়াতে গড়াতে খাটের কিনারে অর্ধেক ঝুলে কোন রকমে আঁচল আগলে প্রাণপণ ডাকছে মা!আমি আবার শিউরে উঠছি,ভয়ে আতঙ্কে আমার গায়ে আবার কাঁটা ফুটছে,বাবান! পড়ে যাচ্ছে! আমি কোথাও তলিয়ে যেতে যেতে এবার গাঢ় নির্লিপ্তি ভেঙে চিৎকার করে উঠি,বাবান! বাবান!
একটা হাত কোথা থেকে এগিয়ে আসছে,একটা সাদা শাড়ির পাড়,একটা হলুদের দাগের নির্ভরতা.. হাত বাড়িয়ে তুলে নিচ্ছে আমার সোনাকে..আমি কঁকিয়ে উঠি মা!মা!

আমার চারপাশটা অন্ধকারে আরেকবার ঢেকে যাচ্ছে, আমি তলিয়ে যেতে যেতে একবার জলে ডোবা মানুষের মতো ভুস করে ভেসে উঠছি,আবার ডুবছি,আবার ভাসছি,আবার...
কোথায়! জানিনা তো!

কোথাও কেউ যেন গোঙাচ্ছে,কাতরাচ্ছে..অনেক দূরে.. কোথায়!.. আমি দেখতে পাচ্ছিনা,শুনতে পাচ্ছি,চেনা,অথচ,অচেনা একটা কণ্ঠ.. আমি এগিয়ে যাচ্ছি তার দিকে..অন্ধকারে...,। ভীষণ সঙ্কীর্ণ এক গলিপথে সেই প্রবল কাতরানির দিকে এগোচ্ছি,যেন বুড়ো আঙুলের মতো ছোট্ট, ছায়ার মতো পলকা,আমার সত্ত্বা।হঠাৎ যেন আছাড় খেলাম নরম তপতপে মাটিতে।হঠাৎ, একটা আলো খুব ক্ষীণ রুগ্ন বিড়ালের সরু লেজের মতো চোখে ঝাপটা মারে।একটা শব্দ হয়,ফট! আমার মাথার উপর হাত এসে পড়ে,..জ্ঞান এসে গেছে।

আমি অবাক হয়ে চারপাশে তাকাই,কোথায় গভীর খাদ! কোথায় শিউলি গাছের লাউডগা সাপের চেরা জিভ! কোথায় সাইকেল!! আমিতো অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে আছি! এতক্ষণ যা দেখেছি,যা শুনেছি,যা অনুভব করেছি,তার কোন বাস্তবতা নেই।সেই ফট করে তুড়ি মারা আর শব্দের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার মধ্যের ওই ফাঁকটুকুর যে অলৌকিক যাত্রা, এই যে তিন ঘণ্টা সময়,যেন এক লহমা,এক অন্য জগত, এক অন্য জীবন,আমি তার মধ্যে থেকেও নেই,যে ভাবনাজাল ছিঁড়তে ছিঁড়তে আর গড়াতে গড়াতে নেমেছি অতল অন্ধকারে,তার থেকে মৃত্যুর অলৌকিক থাবার দূরত্ব মাত্র এক ছটাক,আমি তার কিছুই জানিনা..।শুধু জানি অন্ধকার থেকে আলো, আর আলো থেকে অন্ধকারের বুদ্বুদ এর দূরত্ব মাত্র একটা তুড়ি,মাত্র একটা শব্দ,.. ফট,..তৈরি হওয়া আর মিলিয়ে যাওয়া, চেতন আর অচেতন, অচেতন আর অবচেতন.. বাকিটা ধোঁওয়াশা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র