-“গুড মর্নিং স্যার।”
-“কে বলছেন?” ব্ল্যাকবেরি
ফোনে মেইল চেক করছিলেন রুদ্রনীল। অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসায় যথেষ্ট বিরক্ত হলেন।
-“কৌশিক বলছি স্যার। নিউটাউনে আপনাদের ‘প্যারাডাইস’ সাইটে
স্টোরের চার্জে ছিলাম।”
-“আমাকে ফোন করেছ কেন?” ছেলেটা
আগেও কয়েকবার ফোন করেছিল। প্রত্যেকবারই রুদ্রনীল ভালোভাবে কথা বলেছিলেন। সেইজন্যই
হয়ত ছেলেটার সাহস বেড়ে গিয়েছে।
-“আমার কথাটা কিছু ভাবলেন স্যার?” ছেলেটার গলায় কাকুতির সুর।
-“কিছু ভাবার নেই কৌশিক। তোমাকে দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দেওয়া সম্ভব না
আমার পক্ষে।”
-“আমি কোনো অন্যায় করিনি স্যার। কেন বিশ্বাস করছেন না? নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনীশদা আমাকে
ফাঁসিয়েছেন।”
-“স্টপ টকিং লাই, কৌশিক।
অনীশ আমার সাথে অনেকদিন ধরে কাজ করছে। কখনো খারাপ রিপোর্ট পাইনি।” এখনকার ছেলেদের মধ্যে নীতিবোধ বলে কিছু
নেই, ভাবলেন রুদ্রনীল। চুরি করেও নিজের দোষ
ঢাকতে অন্যের নামে মিথ্যে কথা বলতে মুখে আটকাচ্ছে না।
-“স্যার, আমার
হাতে প্রমাণ থাকলে আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারতাম আমি কতটা সৎ!”
-“থাক,
তোমায় কষ্ট করে
প্রমাণ জোগাড় করতে হবে না। আমাকে ফোন করে আর বিরক্ত না করলেই আমি খুশী হব।”
-“বড় বিপদে আছি বলেই ফোন করি স্যার। আপনারা ছাঁটাই করার পরে বাড়ীতেই
বসে আছি। বদনামের চোটে আর কোথাও চাকরী পাচ্ছি না। বোনের বিয়েতে অনেক ধারদেনা করতে
হয়েছিল, তারজন্য পাওনাদারেরা বাড়ীতে ঘুরঘুর
করছে। চাকরীটা থাকলেও নাহয় অল্প অল্প করে মিটিয়ে দেওয়া যেত......” অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা কথাগুলো
আগেও শুনেছেন রুদ্রনীল। ফোনটা কেটে দিলেন।
২
দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত খেত, মাঝে পিচঢালা রাস্তা। ব্যারাকপুর
ছাড়িয়ে কল্যাণী রোড ধরে রুদ্রনীল রায়ের লাল মার্সিডিজটা নৈহাটির দিকে এগিয়ে চলেছে।
রাস্তার দুধারে মাঝে মাঝে জনবসতিও রয়েছে। এসব জায়গায় কাজ করার অনেক সুযোগ আছে, কলকাতার নামকরা বিন্ডারস ‘রয় এস্টেটস’এর এমডি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন।
কিছুটা সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কাঁকিনাড়া আর নৈহাটির মাঝামাঝি মাদ্রালে মেইন রোডের
ধারেই সতেরো একর জুড়ে একটা প্লট পছন্দ করেছেন রুদ্রনীল। কাছেই রেলের কারখানার
শিলান্যাসের খবরটা পেয়েই ঠিক করেছেন, এখানে
একটা টাউনশিপ গড়বেন। শাসক পার্টির ওপরতলার লোকেদের সাথে ওঠাবসা থাকায় রুদ্রনীল
জমিটা পেতে তেমন বেগ পাননি।
জুনের শেষ, বৃষ্টি যদিও শুরু হয়নি। কাজ শুরু করার
আগে আর্কিটেক্ট দেবাশিসকে নিয়ে সাইট ভিজিটে চলেছেন রুদ্রনীল। পেছনের সীটে এলিয়ে
বসে কিশোরকুমারের গান শুনতে শুনতে চোখ লেগে এসেছিল। মাদ্রাল আসতে আর বেশী বাকি
নেই। আচমকা গাড়ীটা সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। রুদ্রনীল চটকা ভেঙ্গে সোজা হয়ে
বসে দেখলেন, গাড়ীর চারপাশে নানাবয়সী স্থানীয় লোকের
ভীড়। তাদের চোখমুখ দেখে খুব একটা বন্ধুবৎসল বলে মনে হচ্ছে না।
-“চাষের জমিতে বাড়ীঘর হবে না তিনকড়িদা। আমরা মেনে নেব না।”
-“ডিসগাস্টিং। এসব কথার কি মানে তিনকড়িবাবু?”
-“আপনি উত্তেজিত হবেন না রায়বাবু। একটু ঠাণ্ডা মাথায়...”
-“হ্যাং ইয়োর ঠাণ্ডা মাথা! এসব লোকের কনসার্ন নিয়েই ত আপনি জায়গাটার
ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন। সেই ভেবেই আমি এগিয়েছি। এখন পাল্টি খাচ্ছেন?”
-“পরিস্থিতিটা ভালো না স্যার। এদের একজন লীডার আছে। শিক্ষিত ছেলে, তবে বেকার। গত দুমাসে সেই এদের খেপিয়ে
তুলেছে।”
-“চুপি চুপি কথা বলছ কেন তিনকড়িদা? যা বলার আমাদের সামনে স্পষ্ট করে জোর গলায় বলো”
গাড়ীটা থামার পরবর্তী এক ঘন্টায় যেন
ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গেল। পছন্দের প্লটে কাজ করার ক্ষেত্রে বাগড়া দিচ্ছে স্থানীয়
লোকজন। মূলত চাষিই সবাই। এই অঞ্চলের পঞ্চায়েত প্রধান তিনকড়ি মিত্র, যার মধ্যস্থতায় জায়গাটার ব্যাপারে ডিল
হয়েছিল, সেও পরিস্থিতি দেখে পিছিয়ে যাচ্ছে।
পঞ্চায়েত অফিসে আলোচনার নামে চিৎকারই হচ্ছে বেশী। চারিদিকে গ্রামের উত্তেজিত জনতা।
রুদ্রনীল রায় যারপরনাই অসন্তুষ্ট। কাজে বাঁধা পেলে তাঁর মেজাজ ঠিক থাকে না।
-“এদের লীডার না কার কথা বলছিলেন! কোথায় সেই স্কাউন্ড্রেলটা?” অধৈর্য রুদ্রনীল জোরেই বলে উঠলেন।
-“শালা, দাদাকে
গালি দিচ্ছে বে। এত্ত সাহস...” জনতার
মধ্যে থেকে একটা চ্যাংড়া ছেলে তেড়ে এল রুদ্রনীলের দিকে। “বেশী গলার আওয়াজ তুললে এখানেই সাবাড়
করে দেব তোকে। কোনো পুলিশ বাঁচাতে পারবে না শালা বড়লোক কুত্তা” আঙ্গুল তুলে রীতিমত হুমকির সুর। সাথে
অশ্রাব্য গালিগালাজ। নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না রুদ্রনীল।
ঠাস! মাটিতে পড়ে গেল ছেলেটা। এরপরে যা
হয়! পরিস্থিতিটা পুরোপুরি হাতের বাইরে চলে গেল। ধ্বস্তাধস্তি, মারামারির মধ্যে ড্রাইভারের মাথা ফেটে
রক্তারক্তি। মার্সিডিজের ওপরও আক্রোশ আছড়ে পড়ল। রুদ্রনীল আর দেবাশিসকে তিনকড়িবাবু
মারের হাত থেকে বাঁচালেও পঞ্চায়েত অফিসের পেছনেই একটা টালির ঘরে এখন ওদের নজরবন্দী
করে রাখা হয়েছে। মোবাইল, ল্যাপটপ
কেড়ে নেওয়ার ফলে রুদ্রনীলের পক্ষে পুলিশে বা অন্য কোথাও খবর দেওয়ার কোনো উপায় নেই।
কতক্ষণ থাকতে হবে জানা যাচ্ছে না। এদের লিডার সামন্ত এসে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার
নেবে। সন্ধ্যে হয়েছে। হতাশ রুদ্রনীল জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে।
এরকম পরিস্থিতিতে ফাঁসতে হবে, কয়েক
ঘন্টা আগেও আঁচ করা যায়নি। বিদ্যুৎ চমকালো। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। মাঠের মধ্যে
দিয়ে একটা ছেলেকে এই ঘরের দিকে আসতে দেখলেন রুদ্রনীল।
-“কি ঝামেলায় পড়লেন, বলুন
ত স্যার।” দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা।
গলাটা শুনেই ছেলেটাকে চিনলেন রুদ্রনীল। সাথে সাথে বুঝেও গেলেন আজকের পরিস্থিতির
পেছনের আসল কারণটা। কৌশিক সামন্ত। ওর কোম্পানির এক্স এমপ্লয়ী। মাস তিনেক আগে
সাইটের সিমেন্ট বাইরে বিক্রি করে দেওয়ার অপবাদে চাকরীটি খুইয়েছে। ছলে বলে অনেক
চেষ্টা করেও চাকরীতে পুনর্বহাল হতে পারেনি। তারই প্রতিশোধ নিতে রুদ্রনীলকে বিপদে
ফেলতে চাইছে!
৩
কৌশিকের সাহায্যে অস্থায়ী জেলখানা থেকে
বেরিয়ে ওর পেছন পেছন চলেছেন রুদ্রনীল আর দেবাশিস। ঘটনার এহেন পটপরিবর্তনে অবাক
হলেও রুদ্রনীলের কৌশিক সম্মন্ধে ধারনাটা চেঞ্জ হয়েছে। ছেলেটা খারাপ হলে তাঁকে আজ
বিপাকে পেয়ে কিছুতেই ছেড়ে দিত না। অনিচ্ছুক চাষিদের লিডার ওরই দাদা অলক সামন্ত।
অথচ কৌশিক গ্রামের লোকের নজর এড়িয়ে ঘুরপথ দিয়ে ওদের গাড়ীর কাছে নিয়ে চলেছে। কৌশিকই
জানালো, ড্রাইভার গাড়ীতেই আছে। কাছেই হাসপাতালে
নিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের মাথায় ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে। মোটামুটি সুস্থ সে।
-“তুমি কালই অফিসে এসে আমার সাথে দেখা করবে, কেমন!”
-“তার দরকার হবে না স্যার।”
-“তুমি কি কোথাও কাজ পেয়েছ কৌশিক?”
-“আমি কোথাও আর কাজ করব না স্যার” কৌশিকের গলায় স্পষ্ট অভিমান। “আপনারা দেরী না করে বেরিয়ে যান।” গাড়ী স্টার্ট নিয়েছে। কৌশিক রুদ্রনীলকে গাড়ীতে উঠতে তাড়া দিল।
কৌশিকের পাশ দিয়ে গাড়ীতে উঠতে গিয়েই
রুদ্রনীল নাকে একটা তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ পেলেন। মাথাটা একটু টাল খেয়ে গেল তাঁর।
কৌশিকের মুখ থেকেই আসছে! এতক্ষণ দূরে দূরে ছিল বলে বুঝতে পারেন নি। ভর
সন্ধ্যেবেলাতেই নেশা করেছে হয়ত।
-“একটা ঝাঁজালো গন্ধ পাচ্ছি কৌশিক। কোত্থেকে আসছে বল ত?”
-“আমার মুখ থেকে আসছে স্যার, অ্যাসিডের গন্ধ। বেকারত্বের জ্বালা সইতে না পেরে কাল রাতে আমি
অ্যাসিড খেয়েছিলাম।”
-“কিন্তু...কিন্তু...অ্যাসিড খেলে ত কেউ বাঁচে না! তু...তুমি ঠি...ঠিক
আছো ত?” হঠৎই খুব শীত করছে রুদ্রনীলের।
-“নাহ,
আজ বিকেলেই সব
শেষ হয়ে গেল স্যার! আমার বডিটা নিয়ে দাদা গ্রামের লোকেদের সাথে দাহ করতে গেছে। ওরা
ফিরে আসার আগেই চলে যান।” অনেক
দূর থেকে ভেসে আসছে কথাগুলো। “আপনি
ত আমায় বিশ্বাস করেননি, আমি
জীবন দিয়ে প্রমাণ দিলাম আমি সৎ।”
গরীব সৎ ছেলেটার চাকরী কেড়ে নেওয়ার
রিটার্ন যে এইভাবে পাবেন, ভাবতে
পারেননি রুদ্রনীল!
-সমাপ্ত-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন