আর একটা বিশ্বাস ছিল, এই দহে তিনটে চিতল
মাছ আছে, যাদের ওজন এক মণের কম নয়, এবং এই চিতলের লেজের ঘা খেয়ে মনিঠাকুরের বাবা মারা যান ।
ফলে, এই স্থান নিয়ে ভীতি
ছিল গ্রামের সকলের । কেউ, একা, সন্ধ্যের পর, এখান দিয়ে যেতে চাইত
না ।
এসব কাহিনী বিশ্বাস করিনি আমি, বিশ্বাস
করার কোনো কারণও ছিল না ।
তো, সেদিন, স্কুল থেকে ফিরে, রেস্ট নিয়ে, যখন বেরিয়েছিলাম, সন্ধ্যে নেমে গেছে ।
হাঁটতে হাঁটতে কখন চলে এসেছি ঐ খালের কাছে,
খেয়াল করিনি । বলা
হয়নি, এই খালের উপর একটা বরাক বাঁশ পেতে
গ্রামের দুই পাড়ার মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে যোগাযোগসূত্র । কি ভেবে, ঐ সাঁকো পেরিয়ে চলে গেলাম । ও পাড়ায় থাকে আমার এক মাসি, ভাবলাম, দেখা করে আসি । আর
আমার এক সহপাঠিনীও থাকে সেদিকে ।
সহপাঠিনীর সঙ্গে দেখা করিনি, করেছি
মাসির সঙ্গে । আমাকে দেখে, তিনি খুব খুশি । বলল, আজ থেকে যাও ।
আমি থাকিনি । কিছুক্ষণ গল্প করে, চলে
এলাম । পথে এসে, দেখি, ঝির
ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে । পথ জনশূন্য, আশ্চর্য এক
নিস্তব্ধতা চারদিকে । মনিঠাকুরের বাড়ি পেরিয়ে,
পশ্চিমে, সামান্য এগিয়ে এসে, সেই এক সাঁকোর সামনে
দাঁড়ালাম । একটিই বাঁশ, ব্যালেন্স রেখে পার
হতে হয়, তবে,
গ্রামের লোকেদের সে
অভ্যেস আছে ।
সাঁকোয় পা রাখতে যাব, দেখি, সাঁকোর উপরে একটা কাল বিড়াল, হুলো
টাইপের । বিড়ালটাকে তাড়াতে চাইলাম, সরে গেল না । বিরক্ত
হয়ে একটা লাথি মেরে সরিয়ে দিলাম । লাথি খেয়ে,
ঝপাং করে, দহের জলে পড়ে গেল ।
সাঁকো পেরিয়ে এপারে আসব,
দেখি, প্রায় কুড়ি-পঁচিশটা কাল বিড়াল সাঁকোর প্রান্ত ঘিরে ম্যাঁও
ম্যাঁও করছে, আমার পা রাখার পথ বন্ধ করে ।
বুঝতে পারলাম না, এত বিড়াল কোথা থেকে, এক মুহূর্তে, চলে এল এখানে !
এক পায়ে সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে আমি, নিচে, প্রায় বারো তেরো হাত নিচে জল, সেখানে
অনেক বাঁশ পুঁতে রাখা হয়েছে মাছ ধরার লোভে । যদি পড়ে যাই, সে বাঁশের উপরেই পড়তে হবে,
সেক্ষেত্রে, আমার আর নিস্তার নেই । মরেও যেতে পারি ।
এই প্রথম, সারা শরীরে ও মনে ভয়
চেপে বসল । বিড়ালগুলিকে তাড়াবার চেষ্টা করছি,
পারছি না, বরং মনে হচ্ছে, বিড়ালের সংখ্যা যেন
দ্বিগুণ হয়ে গেল ! সারা গা কাঁটা দিয়ে উঠল আমার । ঘামতে শুরু করেছি ততক্ষণে ।
ব্যালেন্স রাখার শক্তিও শেষ হয়ে আসছে । একবার ডান পা, একবার বাঁ পা, পালটে পালটে, এতক্ষণ, ব্যালেন্স রাখছিলাম, তাও যেন আর পারছি না ।
আমার মা-র কথা মনে এল, আমি মরে গেলে, মা খুব একা হয়ে যাবে । আমি ছাড়া মা-র আর কেউ নেই । নিজেকে গালি
দিলাম, শুয়োর, কেন
ও পাড়ায় গিয়েছিলে ? কেন ?
শেষ বারের মত, বিড়ালগুলিকে তাড়াবার
চেষ্টা করলাম, দশ বারোটা বিড়াল ইতিমধ্যে উঠে এসেছে
সাঁকোয় । এবার আমার মরণ নিশ্চিত, আর বাঁচার কোনো সুযোগ
নেই, জলে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া ।
গলা শুকিয়ে গেছে আমার, দু-চোখ বেয়ে গড়াচ্ছে
জল । আমি তাহলে আর বাঁচব না ?
তখনই, দেখলাম, কে একজন, এক হাতে লণ্ঠন, এক হাতে ছাতা মাথায় ধরে,
বৈষ্ণব পদাবলীর এক পদ
গুন গুন করে গাইতে গাইতে আসছে !
তিনি এগিয়ে আসতেই, এক লহমায়, দেখলাম, বিড়ালগুলি কোথায় যেন
হাওয়া হয়ে গেল । কিছু বুঝে ওঠার আগে, আমি বোধ হয়, মাথা ঘুরে, পড়ে যাচ্ছিলাম, তিনি ধরে ফেললেন আমাকে ।
তুমি ললিতার পোলা না ?
উত্তর দেবার মত কোনো শক্তি আমার তখন নেই, কোনো রকমে, মাথা নেড়ে, জানালাম, হ্যাঁ ।
সাঁকোর উপর ওভাবে দাঁড়িয়েছিলে কেন ?
আমি কোনো রকমে বললাম, বিড়াল...
বিড়াল ? সে আবার এসেছে
জ্বালাতে ?
আমি অবাক হয়ে, লণ্ঠনের ঐ আলোয়, দেখলাম, লোকটার চোখেমুখে
আগুনের ফুলকি । বললেন, বাড়ি যাও, বিড়ালটাকে আমি দেখছি ।
কোনো কথা না বলে, এগিয়ে গেলাম বাড়ির
দিকে । কিন্তু লোকটা কে ! তাকে আমাদের গ্রামে কখনও দেখিনি ! তাহলে ?
কি ভেবে, পেছন ফিরে, তাকালাম, দেখি, লোকটা নেই । সাঁকো পেরুলেও,
ওপারে অন্তত তাকে
দেখতাম, না ওপারেও নেই !
ঝটিতি সাঁকোর কাছে ফিরে গেলাম, না, কোথাও তার চিহ্ন নেই !
এ কি ম্যাজিক না কি ! কি করে এটা সম্ভব ? কি করে ?
ঘরে এসে, মা-কে সব খুলে বললাম, মা আমাকে তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে লাগলেন অঝোরে । বললেন, তিনি
তোমাকে রক্ষা করুন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন