ঝর্না বিশ্বাস - মায়াজম

Breaking

২০ জুন, ২০২০

ঝর্না বিশ্বাস

আলু পোস্ত



১।
প্রতি দিন চার বাটির টিফিন নিয়ে আসে মেয়েটা। একটায় তিনটে রুটি, অন্য দুটোয় ডাল ও সব্জি। বাকিতে স্যালাড। এই সময়টায় সুভাষের খুব মনে পড়ে, মায়ের হাতের পাতলা মাছের ঝোল আর মুসুর ডালের সাথে আলু ভাজা। তবে এখন এতেই অভ্যেস করতে হবে।
অমিয়বাবুই বললেন, একা থাকছ, রান্নার অসুবিধা। টিফিন সিস্টেম করে নাও। সকালে কিছু একটা খেয়ে বেরিয়ে যাবে আর দুপুরে এখানে, একদম ঘরোয়া খাবার।
প্রথম প্রথম এ শহরে এসে খুব অসুবিধা হত...কি যে সব খায় ওরা...পাও এর ভেতর একটা চিমটে মার্কা আলুর বড়া আর ওপরে লাল, সবুজ চাটনী...সাথে ঝুরো ঝুরো শুকনো নারকেল কোরা আর লঙ্কাগুড়ো...ওটা নাকি মাখিয়ে খেতে হবে।
শুরুর দিন খেয়েই সুভাষ বুঝেছিল কোথায় এসে পড়েছে...বাড়িতে শত বায়না করা ছেলেটাকে এবার মানুষ হতে হবে। সুতরাং চার কামড়েই শেষ করে দিল বড়া পাও। তবে নেহাত বিপদে না পড়লে ও আর এটার মুখোমুখি হয়না।
এখানে এসে একটা ঘরও নিয়েছে সুভাষ। ছোট হলেও মোটামুটি চলে যায়। আর জিনিস বলতেও তো ওই এক স্যুটকেস, কাঁধের একটা ব্যাগ ও কার্টনে কটা বাসন পত্র। এই নিয়েই সেদিন হাওড়া স্টেশনে। মা-কে আসতে বার বার বারণ করে দিয়েছিল, কারণ ও জানে ট্রেনের চলে যাওয়ার সাথে মায়ের চোখের জল সামলানো কতটা মুশকিল। তাই শুধু দিদি আর বাবা এসে উঠিয়ে দিয়ে গেল। জায়গাতে গুছিয়ে নিয়ে বসতেই বাবা পই পই করে বলে দিলেন, পূজোয় আসিস এবার। দেখিস ছুটি হয় কিনা...
দিদিও,
হ্যাঁ ভাই, তোকে ছাড়া রাতের প্যান্ডেলে বেরানোটা নাহলে বন্ধ হয়ে যাবে।
বড় যত্নে টিফিন সাজায় মেয়েটা। সময়েরও হের ফের নেই। সাড়ে বারোটায় কাঁটায় কাঁটায় অমিয়বাবু উঠে যান। তারপর কোনের একটা টেবিলে বাটি সাজিয়ে বসেন।
সুভাষের একটু দেরী হয়, তাও যখন হাত মুখ ধুয়ে বসে, খাবার হালকা গরম থাকে। ও রোজই রুটি ছিড়তে ছিড়েতে ভাবে এরা যদি রাতেও সাপ্লাই দিত,ভালো হত। কিন্তু টাকার হিসেব করতে গিয়ে সামলে নেয়। নতুন চাকরিতে সবে, পরে দেখা যাবে।
অমিয়বাবুর সাথে কথায় কথায় সুভাষ জানল মেয়েটার নাম বাবলি...মায়ের কাজে সাহায্য করে...কখনও ও নিজে আসে, কখনও বা মায়ের সঙ্গে। সুভাষের খুব ইচ্ছে হয় একদিন আলাপ সারবে। এটলিস্ট একটা ধন্যবাদ। মস্ত বড় মুশকিলের সুরাহা করেছে ওরা। নইলে সাত সকালে উঠে সেই খাবার বানিয়ে অনটাইমের ট্রেন ধরাটা খুব ঝামেলার হচ্ছিল।
বাড়ি ফিরে রাতের খাবার বানানোতে লেট হয়ে যায় সুভাষের...সাতটা পয়তাল্লিশের ট্রেন যখন ওর গন্তব্যে থামে তখন পুরো ঘামে ভিজে চপচপ...তারপর বাড়ি ফিরে স্নান, কাপড় জামাগুলোর ঠিকঠাক করতে করতে যখন ন’টা, ও রান্না সারতে যায়...ফ্রিজ এখনও কিনে উঠতে পারেনি...তবে অনলাইনে দেখে রেখেছে। কিস্তিতে নিয়ে নেবে সামনের মাসে।
কোনও মতে ডাল, চাল আর আলু মিলিয়ে সিদ্ধ ভাত ও ঘি দিয়ে রাতের খাবার সারে সুভাষ। ঘিয়ের শিশিটা সেদিন মা-ই ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল জোর করে। এখন ওটা সবচেয়ে বেশি কাজে লাগছে। তারপর গড়িমড়শি করে শুতে শুতে সাড়ে দশ হয়ে যায়...মাঝে একটু খুঁটখাট মোবাইলে, ফেসবুক আপডেট...সাথে ইনস্টা-তে মোনালীকে ফলো করে আর ওর পেজে পোস্টানো বিদেশী বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফটোটাকে জুম করে লাভ সাইন দেয়...
কলেজে এই নিয়ে একবার সহেলির সাথে তর্ক।
তুই খুব পজেজিভ সুভাষ...এতটাও ভালো না। কারণটা ছিল, সহেলি ওকে না জানিয়ে বাকিদের সাথে মুভিতে গিয়েছিল। বাকি বলতে রাগ শুধু সৌরভের ওপর। সুভাষের মনে হয়, সহেলি ওকে ছেড়ে যাওয়ার প্ল্যান করছে। এবং একদিন হলোও তাই। সত্যি সত্যি মেয়েটা সৌরভের গলায় মালা দিল। তারপর মুকুটমনিপুরে গিয়ে হানিমুনের ছবি, তিনি ঝিনুক কুড়োচ্ছেন...
সুভাষও লাইক দিল...সাথে কমেন্টস বক্সে “ভালো থাকিস”...
আলু পোস্ত বানানোটা কোনও রকেট সায়েন্স না। দিদি গুগল ঘেঁটে বুঝিয়ে দিল গোটা ব্যাপারটা...কিন্তু এই এক রোববার এত কাজ...তবুও গুছিয়ে নিয়ে বসল সব। আলু চৌকো করে কেটে ভাজা হলো। তারপর রেডিমেড পেস্ট ঢেলে ফুটতে দিল কিছুক্ষণ...আর ওপর থেকে নুন চিনি হলুদ। ব্যস্‌ রান্নাবান্না সারা...
পোস্ত ভালোলাগা কবে থেকে মনে করাতে, রজতকে মনে পড়ল আজ অনেকদিন পর। সুভাষের খুব কাছের বন্ধু ছিল রজত, লোকে ওকে পাগলা বলত। তবে মোটেও পাগলা না। প্রচন্ড মেধাবী, হাঁটতে চলতে যেন অঙ্ক করছে। প্রায়ই ও টিফিনে রুটি আর আলু পোস্ত নিয়ে আসত। খাওয়ার গল্পেও পোস্ত রাজা.... আর তখন থেকে সুভাষেরও প্রিয় হতে শুরু করল খাবারটা...সুভাষদের বাড়িতে এগুলোর চল নেই... ঠাকুমার সামনে তো পোস্ত নাম বলাই যাবেনা...একপ্রস্থ শুনিয়ে দেবে ঘটি-বাঙাল নিয়ে...তবে টিফিনের আবার ঘটি বাঙাল কি...তাই দুজনের টিফিন বদল হত...রজতের ভালো লাগত মায়ের হাতের তরকারি আর সুভাষ তখন পোস্ততে মন দিয়েছে।
যদিও রজত একদিন কাউকে না জানিয়ে হারিয়ে গেল...
পরে জানা গেল, দিকশূন্যহীন হয়ে চলছিল আর সেখানেই অ্যাক্সিডেন্ট...
দুপুরে সেদিন খেতে বসে ওর মনে হলো, দিদি ঠিকই বলে। সত্যিই রান্নাটা কোনও বড় ব্যাপার না...তাই খেতে শুরু করার আগে প্লেটে সাজিয়ে ছবি তুলল কটা কায়দা করে ও ফেসবুকে ট্যাগ করল বন্ধুদের...কিছু সময়ের মধ্যেই ওতে একুশটা লাইক ও দুটো হার্ট...যার একটা ছিল সহেলির...
মা প্রায়ই এখন বলাবলি করে, মেয়ে দেখার কথা হয়... কিন্তু সুভাষ থামিয়ে দেয় প্রতিবার, অন্তত একটা বছর।
কাছের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র অনিমেষ ভালো আছে বিয়ের পর, বাকি সবার কিছু না কিছু লেগেই আছে। সুভাষ এই মুহূর্তে ওতে জড়াতে চায়না...তাই টালবাহানায় সময় বাড়ায়। আপাতত ইচ্ছে একটা ভালো পোস্ট, আর মোটা টাকার স্যালারি। প্রচুর প্রচুর স্বপ্ন যা পূরণ করতে হবে... তাই এ চাকরীটা পেয়ে খুব খুশি ছিল সুভাষ। কল লেটার হাতে নিয়ে প্রথমেই দেখা করতে যায় মাস্টারমশাইয়ের সাথে। অনেকক্ষন গল্প করে, মিতু চা মুড়িও খাওয়ায়...তারপর ওদের বারান্দায় বসে একটানা অনেক গল্প। মাস্টারমশাই কথায় কথায় মেয়ের বিয়ের জন্যেও ছেলে দেখার কথা বলেন।
উনি খুব সোজাসাপটা মানুষ তাই বলেও দিলেন, ওর রঙটা চাপা তো। তাই পাত্রপক্ষ ফিরে আর উত্তর দেয়না...সুভাষ কথা দেয়, মিতুর জন্য একটা ছেলে দেখবে। বন্ধু সার্কেলে বা চেনাশোনার মধ্যে কেউ, যাতে ও ভালো থাকে।
মিতু কথা বলে কম, তাও সেদিন বসে গল্প করল। কবে যাচ্ছি, কোথায় উঠব সব। সুভাষ দেখল, অনেকটা সময় হয়ে গেছে...তারপর উঠতে গিয়ে প্রনাম সারল। মাস্টারমশাই বললেন,
বাড়িতে এসো মাঝে মাঝে। তোমার বাবারও বয়স হয়েছে।
সুভাষও সায় দিল।
পূজোতে পারলে আসার ইচ্ছে আছে। দেখি কি হয়...
সুভাষ বেরিয়ে গেলে মিতু গেটের দরজাটা বন্ধ করতে করতে বলল, আবার আসবেন। বাবা মাঝে মাঝেই আপনার কথা বলেন।
একটু অশ্বস্তি হচ্ছিল যদিও আপনি-তে তাও সুভাষের মনে হলো এটাই ঠিক...পরিচয় তো ছিল না কোনদিন।
ইশ্‌, বাবলি যদি জানত আলু পোস্তটা, তাহলে রোজ দুপুরে জাদুবাক্সর মত টিফিন খুললেই ম্যাজিক। এমনটাই ভাবছিল সুভাষ। মাসের শেষে মেয়েটা এলো টাকা নিতে। অফিসে একজনই ঢুকতে পারবে তাও ওই বিরতিতে। মা-কে নীচে বসিয়ে ও একাই এলো...সেদিন একটু অপেক্ষা করতে হলো, কারণ মিটিং শেষে বেরোতে সুভাষের অনেকটা সময় গেল। কাচের ওপাশ থেকে দেখা যাচ্ছিল মেয়েটকে। ছোটখাটো হাইট...দাঁত দিয়ে ওড়নার একটা অংশ সমানে চিবিয়ে যাচ্ছে।
আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল,
আপ সুভাষবাবু...
মুচকি হাসল সুভাষ। ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করে কিভাবে জানলো, তারপর দূর থেকে দেখে অমিয় ইশারা করে যাচ্ছে। সুভাষ ওর হাতে টাকা দিল, আর জানালো রান্না ভালোলাগার কথা... মেয়েটা মিচকি হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।
এদিকে মনটাও আজ খুব খুশি সুভাষের। মোটামুটি রবি শনি মিলিয়ে গোটা সপ্তাহর ছুটি পাওয়া গেছে...পূজোটা ভালোই কাটবে বাড়িতে। তবে সোমবার অবশ্যই জয়েন করা চাই। সুভাষ রাজি হলো, সাথে একটানা ধন্যবাদ অমিয়বাবুকে। ও জানে এই সিফারিশটা ওনারই করা...
এরপর সবকিছু কেমন হঠাৎ করে ঘটে গেল... মিতুকে ভালোলাগার কোনও কারণ ছিলনা...
তাও একসাথে সেদিন রাতের ঠাকুর দেখার পর চিন্তাটা যেন আরো বাড়ছিল...আর কনফার্ম হতে পরদিনই ছুট্টে গেছিল সুভাষ...
স্পষ্ট লক্ষ্য করল, মিতু যেন কিছু একটা বলতে চায়...তবে সেদিন মাস্টারমশাইয়ের সাথে কথা বলেই বাড়ি ফিরল ও।
তবে মা-কে সে বারের মত কিছু না জানিয়েই আভাস দিয়ে গেল শুধু...
এর ঠিক এক মাস পর, পাকা কথা হয়ে গেল ওদের... মাস্টারমশাই তাঁর পুরনো ছাত্রটির সাথে ফোনে কথা সারলেন, ও বললেন তোমার এ মতে আমি খুব খুশি হয়েছি। মেয়েকে তুমি চেন। খারাপ হবেনা...
সুভাষের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বলে,
একবার দিন না ওকে ফোনটা...আমার কিছু বলার ছিল...
কথাও সাজিয়ে রেখেছিল সুভাষ...
সারা জীবন আলুপোস্ততে রাখতে হবে আমায়, পারবে তো!...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র