মৌসুমী রায় - মায়াজম

Breaking

২০ জুন, ২০২০

মৌসুমী রায়

মেঘে বৃষ্টি ও নোয়ার নৌকা











মুখোমুখি ফ্ল্যাট...
কাটাকুটি রাস্তাটা সাপের মত বেঁকে লর্ডসের মোড় অবধি গিয়ে দম ফেলেছে ।
রাস্তার বাঁকে একচিলতে ত্রিকোনপার্ক ,দোলনা ,স্লিপ ,ঢেঁকি আর একটা নিঃসঙ্গ অমলতাস ।
রোজ বিকেলে মেঘ , বৃষ্টি আর বজ্র একসাথে আসে ।নাহ, বলা ভালো আসতো ।
এখন আসেনা ,কেউ আর আসেনা । আসতে মানা যে ! ভাইরাস ,ভাইরাস !
অমলতাস ,দোলনা ,ঢেঁকি আর স্লিপ যে যার মত একলা নিঝুম দাঁড়িয়ে ।চেয়ে থাকে অনিমেষ গেটটার দিকে ,চেয়েই থাকে ।


*
আস্তে আস্তে ব্যালকনির দরজাটা খুললো বৃষ্টি ,ভারী খেসের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে আশপাশটা দেখে নিয়ে, পা টিপেটিপে বাবির ফোনটা নিয়ে একদম কোনটাতে গিয়েই ,শর্মা আঙ্কলের নম্বরটাতে রিং....
-"হাঁ, বোলো ,বিকাশ "
-"হি হি , আমি বৃষ্টি আঙ্কেল"
-"বৃষ্টিবেটা ! ক্যায়সে হো ! মেঘকো চাহিয়ে ?
মেঘ ইধার আও ,বৃষ্টি বুলাতী হ্যায় "
-"বল "
-"বাইরে আয় না !"
-"নিকালনা মানা হ্যায় না, ভাইরাস ,ভাইরাস !"
-"ধুর বুদ্ধুরাম ,ব্যানকনিতে আয়"
মেঘ এক ছুটে ব্যালকনিতে ,-"হি হি "
-"হি হি "
*
হাসি আর হাসি ।রাস্তার ওপর দিয়ে হাসি আসছে ,হাসি ভাসছে ,হি হি ,হি হি ! অনেকদিন পরে ।গুমোট কাটছে ।রাস্তাটা একটু নড়েচড়ে উঠলো ।
উফ্ ,কতদিন গাড়ি নেই ,ঘোড়া নেই ।গাড়িঘোড়া কিচ্ছু নেই ।তাঁর সর্বাঙ্গে যেন বাত ধরে গেছে । সকাল হলেই দুধের গাড়ি ,বাচ্চাদের স্কুলের গাড়ি ।কলকল কলকল ।আরো কত কি গাড়ি ।ওলা উবের ।
সারাটা দিন এই হিসাব করতে করতেই কেটে যেত রাস্তাটার ।এখন শুয়ে শুয়েই মনে হয় শরীরে জং ধরে যাবে ।ভুলেই যাবে হয়তো লর্ডসের মোড় থেকে কিভাবে সাউথ সিটি যেতে হয় !
*
বজ্রবাহাদুর দের বেড়ার ঝুপড়িটা হঠাৎ ই টাল খেলো একটু ।অন্তত বজ্রের তাই মনে হোলো ।
বজ্রকে চেনোনা ?বৃষ্টিদের আবাসনের গ্রাউন্ডফ্লোরের শপিংমলটির পাহারাদার তো ওর বাবা ,শেরবাহাদুর ! বজ্র বিকেলে পার্কে যায় ।সেখানেই বৃষ্টি মেমসাব আর মেঘবাবুর সাথে তাঁর দোস্তি । দুজন ই বজ্রকে খুব খেপায় ,আবার ভালো ও বাসে ।
রাস্তায় নেমে এলো বজ্র ।যা ভেবেছে তাই ।মেঘসাব আর বৃষ্টিবেবী ।বজ্র নিরাপদ দূরত্ব থেকে মাপছে ওদের ।আজ আবার কি মতলব !
কি মতলব,কি মতলব !
-"আবে ঘোঁচুরাম , বজ্জর ডরপোক ,কাঁহাসে আ টপকা রে , হি হি হি " ,
-" ইঃ!বৃষ্টি , বৃষ্টি "
যা ভেবেছে তাই ,শুধু তাঁর টাং খিচবে আজ বৃষ্টি, বাবুজী বলে ,বারিশ মেমসাব । মুখ ভেংচালো বজ্র,জলদী পালাচ্ছে । জলদী,জলদী,খুব জলদী ।
-"দাঁড়া ।জরুরী ,খুব জরুরী দরকার ।
- " বজ্র তোদের দেশ কোথায় যেন বলেছিলি ?"
-"ঐ মেঘ, মেঘের দেশে "
-"ধুর ,আমার দেশ তো জামালপুর আছে ,পাটনার কাছে, সেখানে তোর দেশ ?বেওকুফ ! ।তুই ব্যাটা জংবাহাদুর পাহাড়ী বিচ্ছু ,হা হা হা "
-"সারে মেঘ কি এক আপহী হো ? আমাদের দেশটাই মেঘের ।
মেঘ পাহাড় বেয়ে বেয়ে ঘোরে ,ফেরে ,নাচে ,ঝম ঝমা ঝম বারিশ আনে ।বারিশ বারিশ বারিশ আসে।এ বারিশ বৃষ্টিমেমসাব না ,হা হা হা "
-"বজ্র ! বজ্রকন্ঠে হাঁক ছাড়ে বৃষ্টি
তোর মাথাটা গেছে । মেঘকে বলে ,মেঘ না ।বৃষ্টিকেও বৃষ্টি না !তবে আমরা কি ? দুখী আত্মা? বাবির মত ! অফিসের বস যে
বলে ,তোমরা আর স্টাফ না ।রিট্রেঞ্চমেন্ট,রিট্রেঞ্চমেন্ট !"
ধমক খেয়ে বজ্রবাহাদুরের বাহাদুরি ভুসসস!
মেঘ হাসছে । খিক খিক করে ,রাস্তাটাও ।
-"আমরা জানিস তো জামালপুর বাপস যাবো ।দাদাজীর ক্ষেতিবাড়ি ! পাপা দেখবে এবার ।"
-"কি মজা ,কি মজা ,মেঘ আমাকে তোর সঙ্গে নিবি ?"
-"ধুর পাগলী ,তুই ওই শুখী চাপাটি আর লহসুনের আচার খেতেই পারবি না । ট্র্যাক্টর চালানা আতী হ্যায়?"
-"বজ্র ,তবে তোর সঙ্গে যাই ? পাহাড়ের দেশে !
তুই নিবি আমায়?"
-"নাহি নাহি ,বৃষ্টি বেবী ,বহৎ তকলীফ হবে তোমার ! চহড়না ওর উতরনা ,দিনভর লাগা রহেতা হ্যায় ।ফির হামলোগ সারা দিন নারঙ্গীক্ষেত,চায় কি বাগিচে মে কাম করেঙ্গে।ইহাকা কাম তো গ্যয়ী পিতাজীকা "
-"ইঃ, দুটোই পাজী ।পাজী পাজী পাজী ,ছুঁচো! কেউ নেবেনা আমাকে ।
জানিস, আমাদের ও এই এত্ত জমি ছিলো,জমি ভরা ধান ছিলো ,বাড়ি ছিলো ,পুকুর ছিলো ,পুকুর ভরা মাছ ছিলো ,খলবল খলবল ,ঠাম ছিলো দাদু ছিলো , সব ,সবাই ছিলো ।এখন কিছু নেই ! বাবির জবটাও নেই ।ফ্ল্যাটটা নাকি অফিসের ।তাই বাড়িও নেই।মাইগ্রেটরী বার্ডসরাও তো ঘরে ফেরে ,আমাদের ঘরটাও যে নেই ।তবে ,কোথায় যাবো আমরা ? "



রাস্তাটা কেমন ভিজে ভিজে ।বৃষ্টি ঝরছে বুঝি ? ঝমঝম ,ঝমঝমাঝম ।
রাস্তাটা কাঁদছে ,ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ।পিঠটা বেঁকে , বেঁকে যাচ্ছে ।পার্কের গেটটা দুলে দুলে ঠকাস ,ঠকাস ।
এইসব কান্ডের মাঝে অমলতাসটা ভেবলে গিয়ে ফুলটুল ঝরিয়ে একেক্কার কান্ড !
-"উফফ্,এই শুরু হোলো ,যত ফুল সব আমার গায়ে ।" দোলনাটা দুলে দুলে ঝগড়া করছে অমলতাসের সাথে ।
-"কত নিষ্ঠুর তুই ! শুধু নিজের কথাই ভাবিস ।সবাই চলে যাচ্ছে দ্যাখ ।বজ্র মেঘ বৃষ্টি ।কেউ আর আসবে না ,কোনোদিন ।একা একাই দুলিস তুই ।হিংসুটে !"
স্লিপটা ভারী বোকা ।বুঝতেই পারছেনা কি গড়বড় ! দিব্বি তো ছিলো ।সব ছিলো ।সবাই ছিলো ।হাসি খুশী গান স্কুল সাঁতার ড্রয়িং অ্যাবাকাস,তাইকোন্ডে ,বার্থডে পার্টি !
হোলো কি পাড়াটার !
ঐ ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্ট গুলোতে তবে কে থাকবে ?
সবজান্তা রাস্তাটা ধমকে উঠলো ।
-"এও জানিস না ,কোন শূণ্য ই শূণ্য থাকে না ।
আসবে আসবে ।নতুন বাসিন্দারা বাক্সো প্যাঁটরা গুছিয়ে সব রেডি !"
-"কারা আসছে ? কারা ,কারা ?"
রাস্তা খিঁচিয়ে বললো ,উফ্, কিছুই জানিস না দেখছি। মানুষ চলে গেলে কারা পড়ে থাকে ! ভাইরাস,ব্যাকটেরিয়া ,মশা, মাছি আরশোলা ,ছারপোকা ,কেঁচো ,ব্যাঙ,সাপ ,ভূত ,পেত্নি ,হিংসা ,লোভ ,টাকা ,পয়সা ...
*
পৃথিবীর মনখারাপ ,পৃথিবী কষ্ট পাচ্ছে ।মায়ের মত ।তবু দুষ্টু বাচ্চাকে শাসন তো করতেই হবে । আবার সোহাগ ও সেই করবে ।
ওদিকে , চুপিচুপি সমুদ্দুরের বুকে একটা গভীর নিম্নচাপ দানা বাঁধছে,বাঁধছে ,বাঁধছে ।আকাশে কালো মেঘ ,মেঘ আর মেঘ ।মেঘের বুকে বজ্রের হাঁকডাক ।বৃষ্টি নামলো অবশেষে , চল্লিশ দিন বৃষ্টি,চল্লিশ রাত... বৃষ্টি ,অঝোর ,নাছোড় বৃষ্টি ।
রাস্তা,পার্ক ,অমলতাস ,দোলনা ,ফ্ল্যাট ক্রমশ ডুবছে ,সব ডুবছে ...
দূর থেকে নোয়ার নৌকা আসছে
রূপশালীধানের চারা ,মানুষের বীজ ,পাখপাখালির গান ,বুক ভরা অক্সিজেন,অমলতাসের সোনাঝুরি ফুল
আবার ...
আরো এক বার ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র