প্র তা প রা য় - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

প্র তা প রা য়

 মুখোশ এর অন্তরালে মুখোশ








স্রোতস্বিনী প্রাতঃকালে আমার বৃহৎ খাতাটি হাতে করিয়া আনিয়া কহিল –এ সব তুমি কী লিখিয়াছ! আমি যেসকল কথা কস্মিনকালে বলি নাই তুমি আমার মুখে কেন বসাইয়াছ?
আমি কহিলাম – তাহাতে দোষ কী হইয়াছে?
স্রোতস্বিনী কহিল – এমন করিয়া আমি কখনো কথা কহি না এবং কহিতে পারি না। যদি তুমি আমার মুখে এমন কথা দিতে, যাহা আমি বলি বা না বলি আমার পক্ষে বলা সম্ভব, তাহা হইলে আমি এমন লজ্জিত হইতাম না। কিন্তু এ যেন তুমি একখানা বই লিখিয়া আমার নামে চালাইতেছ।
(মনুষ্য) —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

স্রোতস্বিনী নিজে কি জানতেন তিনি কী কথা বলতে পারেন বা পারেন না? মনস্তাত্ত্বিকরা স্রোতস্বিনীর এই অভিযোগ সমর্থন করবেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ মানুষের চিন্তাধারা, বিবেচনা, ও তার প্রকাশ সতত পরিবর্তনশীল এবং তারা নিজেরাও জানেন না এই পরিবর্তনের পরিমাপ আদতে কী হতে পারে। দার্শনিক ফ্রয়েড যেমন বলেছিলেন, একজন গৃহবধু ও একজন বেশ্যার মূলত কোনও তফাৎ নেই। এই কথায় তদানীন্তন সামাজিক মোড়লরা রে রে করে উঠেছিলেন। প্রতিদিন আমরা একটু একটু করে বদলে যাই। আকৃতিতে, প্রকৃতিতে ও স্বত্তায়। সেই দিক থেকে বিচার করলে গতকালের আমি আর আজকের আমি দু’জন আলাদা মানুষ। সেই অর্থে ফ্রয়েডের এই যুক্তি নিতান্ত গ্রহণযোগ্য। এভাবে বদলাতে বদলাতে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার পর যদি কোনোদিন অতীতে ফিরে যাই, দেখি অতীতের কর্মকাণ্ড তখন নিজেরই মনে হয় সেদিন মুখোশ পরে ছিলাম বা আজ মুখোশ পরে আছি। নিজের সত্ত্বাকে খুঁজি, খুঁজে চলি জীবনের গহীনে। সময়ের সাথে তাল মেলাতে আবার নতুন করে সেজে নিতে হয় আমাকে, তোমাকে, সবাইকে। আপন ধারায় নিজস্ব স্বত্তা হারাতে হারাতে মানুষ একদিন স্বত্তা হারানোয় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। পাপ করতে করতে পাপীরা যেমন পাপকে তার কর্ম বলে গণ্য করতে শিখে যায় ঠিক তেমন করেই আমারা শিখে যাই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে মুখোশের আড়ালে।
কখনও স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে কখনও নিজেদের ভাবমূর্তি প্রয়োজনীয় ভাবে প্রকাশ করতে লুকিয়ে পড়ি মুখোশের আড়ালে। ঠিক যেমন অভিনয়ের প্রয়োজনে শিল্পীরা মুখোশ বানান, অভিনেতারা ব্যবহার করেন দর্শকের কাছে বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য ঠিক তেমন ভাবে মানুষ প্রয়োজনীয় কান্না কাঁদে, প্রয়োজনীয় হাসি হাসে, প্রয়োজনে রাগে আবার প্রয়োজনে রাগ সংবরণ করে। মানুষ স্বভাবত অনুভূতি প্রকাশ করে কিন্তু অনুভবের থেকে কিছু আলাদা প্রকাশ অভিনয়, আর এই অভিনয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা হাসিল করার অস্ত্র মুখোশ। মানুষের বহমান জীবনে স্বার্থপর হওয়া আদিম থেকেই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। কিছু পণ্ডিত যুক্তি তর্ক খাটিয়ে তা খানিক দোষমুক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিতও করে ফেলেছেন। যেমন সম্রাট আলেকজান্ডারের শিক্ষাগুরু দার্শনিক, পণ্ডিত অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘দোষমুক্ত স্বার্থপরতা মানব কল্যাণকর’ কিন্তু পৃথিবীর সকল মানুষই তো স্বার্থপর এবং তাদের বেশিরভাগেরই স্বার্থপরতা ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধিতেই ব্যস্ত থাকে। তা যাই হোক আমরা কিন্তু তাদের মুখে মুখোশই দেখি। কারণ তারা ভেতর থেকে এক এবং তাদের উপস্থাপন আরেক অর্থাৎ তারাও মুখোশে ঢেকে আছে তাদের মুখ।
পারিবারিক, সামাজিক এবং কর্মজগতে বিভিন্ন প্রয়োজনে আমাদের মুখোশ পরতে হয়। এখানেও সেই স্বার্থসিদ্ধির সূত্র। স্বার্থপর সবসময় নিজের জন্য হতে হয় এমনটা নয়, অথচ মুখোশের দায় নিতে হয় মুখোশধারীকে। ছোটবেলায় বাল্মিকির গল্পে যেমন পড়েছিলাম... ডাকাতির ভাগ সবাই নেয় কিন্তু পাপের ভার পাপীকেই বহন করতে হয়। সময়টা ১৯৮০ সালের আশেপাশে। আমাদের পারিবারিক বন্ধু একটি পরিবার। কর্তা ঠিকাদারির ব্যবসা করতেন। অত্যন্ত স্বাচ্ছলতা তার আর তার গোটা পরিবারের শারীরিক ভাষায় ফুটে উঠত। সদাহাস্য কর্তাটি একদিন একটা নবনির্মিত বাড়ির পাঁচতলা ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলেন। সৌভাগ্যক্রমে নিচের তলার কার্নিশে আটকে তিনি প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু আঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়েন। এবং তার নিজের মুখ থেকেই জানা যায়, তার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং পাওনাদারদের ধারদেনা শোধ করতে না পারার কারণে তিনি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কী আশ্চর্য, তার পরিবার পরিজন কেউই এই ভাঙনের পূর্বাভাস পাননি। কী নিখুঁত মুখোশ পরিধান করে থাকলে নিজের সবথেকে আপন মানুষের কাছেও মুখচ্ছবি লুকিয়ে রাখা যায়! কিন্তু এর গভীরে যে প্রশ্নটি উঁকি দেয় সেটা আরও ভয়ঙ্কর। ওই মানুষটি পরে বলেছিলেন, ‘তার মানসিক যন্ত্রণার কথা তিনি তার পরিবারকে জানান নি, পরিবার আঘাত পাবে, বা হতাশ হয়ে পড়বে এই ভেবে’ অথচ তার আত্মহননের পরিণতিতে পরিবারের কী অবস্থা হতে পারে সে কথা তিনি ভাবলেন না। তার এই স্বীকারোক্তি থেকে কিন্তু পরিষ্কার যে, তাঁর ধারণা তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে কোনও ভুল করেন নি। এর মধ্যে একটা অপরাধ প্রবণতা কাজ করছে আর এই হল মুখোশের সর্বনাশা দিক। হিটলার অসংখ্য মানুষকে হত্যা করার পরে বলেছিলেন, “আমার কালো কোর্টের নীচে একটা কোমল হৃদয় আছে, যে হৃদয় কাঁদতে জানে”।
এই হল দোষীদের সমস্যা, কার্যকারণ সঠিক বলে প্রমাণ করার চিরায়ত প্রচেষ্টা থেকে এদের নিষ্কৃতি নেই। সুতরাং তুমি নিজের জন্যে সঙ সাজো অথবা দেশ বা দশের জন্যে, মুখ লুকনোর দায় তোমারই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র