মানিক সাহা - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

মানিক সাহা

গানের বরাত 








কোন মানে হয়! এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করার পর এখন ফোন এল, তিনি আজ আর আসতে পারবেন না। বড় মানুষদের নিয়ে এই হল এক অসুবিধে। অন্য কেউ এ কাজ করলে তাকে ছেড়ে কথা বলত না শ্যামল। কিন্তু এম এল এ তো আর যে সে মানুষ না। সুতরাং দাঁতে রাগ চেপে বেরিয়ে এল সে। বাড়ি ফিরতে হবে। বাস ধরে যেতে সময় লাগবে কম করে হলেও দেড় ঘণ্টা। তারপর সাইকেল। সারাদিনের পরিশ্রম আজ মাটি।
এম এল এ বলেছিল, জেলার অনুষ্ঠান। বড় বড় লোক আসবে। মন্ত্রীরা আসবে। টিভিতেও দেখান হবে অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে গান গাওয়া, সে কী আর যে সে কথা! আসছে বুধবার দেখা করিস। তোর গানের একটা ব্যবস্থা করে দেব। সারা সপ্তাহ ধরে এই বুধবারের অপেক্ষায় ছিল শ্যামল। কিন্তু আজ তো কিছুই হল না!
বাসে সবসময় ভিড় থাকে। কোন রকমে পাদানিতে দাঁড়িয়ে গেল। একটু একটু করে ভেতরেও সেঁধিয়ে গেল। দাঁড়াবার জায়গা করে নেবার জন্য শরীরটাকে সাপের মত একিয়ে বেঁকিয়ে নিল। একজন স্থূলকায় মহিলার গায়ের নরম জায়গায় একটু স্পর্শ লেগে গেল। মহিলা আগুণ চোখ দেখাতেই শ্যামল শামুকের মত হয়ে গেল। এ তো আকছার হয়। বাসে চলতে গেলে এসব ব্যাপার ধরা যায় না।

শ্যামলদা, কোথায় গেছিলা? বা দিকে মাথা ঘুরিয়ে অরুণকে দেখতে পেল। শ্যামলের গ্রামের ছেলে। এলাকায় সুনাম থাকলে যারা নিজেদের নিয়ে গর্ব করে, অরুণ তাদের মত একজন।
এই একটু এদিকে। শ্যামল কথা গুটিয়ে নিতে চায়। কিন্তু অরুণ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সব খবর জেনে নেয়। শ্যামল লক্ষ করছিল, কথা বলার অছিলায় অরুণ তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে বিভিন্নভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছিল। মেয়েটির অস্বস্তি সহজেই বুঝতে পারছিল শ্যামল। মেয়েটির ফর্সা গাল, কানের লতি লাল হয়ে উঠছিল। কিন্তু প্রতিবাদ করছিল না। হয়ত ভয়। হয়ত বলার মত কিছু হয়নি বলেই তার মনে হয়েছিল। অরুণরা হয়ত এই সুযোগগুলো সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না।
এম এল এর কথা বিশ্বাস কইরো না দাদা। মিথ্যা কথা কওয়া এমন লোক দুইটা নাই। ওর পিছনে ঘুইরা লাভ হবে বইলা মনে হয় না।তার উপরে আবার মেয়েছেলের দোষ আছে শুনচি।
অরুণের এইসব কথা তার ভাল লাগে না। শ্যামল এম এল একে চেনে। বড় ভাল মানুষ। কথা যখন দিয়েছে, ঠিকই কথা রাখবে।
মাঝখানের মেয়েটি একদৃষ্টে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। নিজের শরীরটাকেই বড় বিরক্তিকর লাগে এসময়। অরুণ খুব মজা পাচ্ছিল। কথার মধ্যে মাঝে মাঝেই দু'একটি বাজে শব্দ ব্যবহার করছিল। অকারণেই। এ এক ধরণের আত্মরতি বলে শ্যামলের মনে হয়। কতক্ষণে যে বাস পৌঁছবে! ভাল লাগছিল না শ্যামলের।

বাড়ি ফিরে যমুনার প্রশ্নের মুখে পড়ে শ্যামল। কী হল? কী বলল? কিছু খাওয়ালো? যমুনার মত মানুষদের সবকিছুর মধ্যে খাওয়ার ব্যাপারটি অদ্ভুতভাবে চলে আসে। 'খাওয়া' দিয়েই তারা মানুষ বিচার করে। দেখা হয়নি শুনে মন খারাপ হয়ে গেল তার। শ্যামল আস্বস্ত করলে, মিলিয়ে যাওয়া হাসির অল্প কিছু ভগ্নাবশেষ ফিরে এল তার মায়াবী চোখে। বড় মিষ্টি দেখতে যমুনা। হ্যাঁ, নদীর মতই। জেলার অনুষ্ঠানে গান গাওয়া যেন বিরাট একটা কিছু হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জীবনে।
যদি দুই-চাইরশো টাকা চায়। না কইরো না কিন্তু। আমার কাছে জমানো আছে। যমুনার এমন বালিকাসুলভ কথায় শ্যামল না হেসে পারে না।

এম এল এ কি তোমার টাকার জন্য বইসা আছে ? উনি এমনিই গান করার চান্স দিয়া দিবে। কিছু নিবে না। তুমি ওনাকে চেনো না। খুব ভাল মানুষ!
যমুনা নিজের নির্বুদ্ধিতায় লজ্জা পায়। হেসে ফেলে। গুমোট ঘরের দেয়ালগুলি এই দম্পতীর আশু জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। রঙিন হয়ে ওঠে।
এম এল এ এর সঙ্গে আজও দেখা হল না। কাজের জন্য বাইরে গেছেন। ওনার লেজুড় দিবাকর রায় শ্যামলকে ডেকে নিয়ে গেল। গানের কথা বলতেই হে হে করে হেসে উঠলো। দারুণ রসিকতা করে ফেলেছে মনে হল শ্যামলের।
কী গান করবি তুই? কাজল ভোমরা আর বগার গান? ওই গান কে শুনবে রে? হ্যাঁ! কত বড় বড় শিল্পী আসবে জানিস?
কিন্তু এম এল এ সাহেব যে কথা দিছে। আমি কাজ কাম ফালায়া তাঁর নাগাল ধরার জন্য প্রতিদিন আসতাসি। গান আমার জীবন দাদা। কত যে স্বপ্ন দেখছি...
আরে ধুরও! পাগল হইছিস না কি? সাত ভেজালের মানুষ কখন কাকে কী কয়, অত মনে থাকে? আর এইসব ছোট জিনিস কি উনি দেখবে না কি? খায়া দায়া কাজ নাই?
শ্যমলের কল্পিত জগৎ এক ধাক্কায় ভেঙে যায়। দিবাকর কী যেন ভাবল। শোন একটা বুদ্ধি আছে। তোকে চান্স দিতে পারি, তবে একটু খরচ করা লাগবে। বুঝলি?
যমুনার কথা ভুল মনে করেছিল শ্যামল। কিন্তু এখন নিজেকেই ভুল মনে হচ্ছে তার। কত টাকা?
পাঁচ হাজার।.... চাইর।.... যা তোর জন্য তিন।....
শ্যামল বোকা হয়ে যাচ্ছিল। কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। গান করার জন্য এত টাকা দেওয়া সম্ভব নয়।
দাদা, এত টাকা কই পাবো কও? তুমি তো আমার অবস্থা জানো। তুমি ভাল মানুষ। দেখো না যদি কিছু করা যায়।

ভাল মানুষই বটে, না হলে এমন প্রস্তাব কি দেওয়া সম্ভব! দিবাকর শ্যামলের পরিস্থিতি নিয়ে রসিকতা করে। ব্যঙ্গ করে। খুব মজার একটি বিষয় পেয়ে গেছে সে। এমন সুযোগের অপেক্ষাতেই তো তার মত মানুষেরা থাকে।
এম এল এ সাহেব টাকা চাইতো না দাদা। তোমাকে ভাল মানুষ ভাবছিলাম। তুমি এমন!....
কথায় কথা বাড়ে। দিবাকরের রাগ বাড়তে থাকে। দিবাকর রাগে ফুঁসতে থাকে।
যা, এম এল এর কাছে। আমি তো টাকা চাইছি। তাও একা আমার জন্য না। তাতে এই কথা কইস? এম এল এর কাছে গেলে অন্য কিছু নিয়া যাইতে লাগবে। টাকায় মন ভিজাইতে পারবি না। ফালতু কোথাকার?
শ্যামল হতবাক হয়ে যায়। এ কী কথা! এও কি সম্ভব? অরুণের কথা মনে পড়ে। এমন কিছুরই ইঙ্গিত কি সে দিয়েছিল?

ক্রোধ আর অক্ষমতায় মাথা ঘুরতে শুরু করেছে তার। নিজের উপরই রাগ হতে লাগল। একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে ক্ষমতার পরিহাস - কী করবে বুঝতে পারছে না শ্যামল।
বাসে অকারণে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিল। আর একটু হলে তা হাতাহাতি পর্যায়ে পৌঁছে যেত। কিন্তু গেল না।
বাড়ি ফিরে সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল দোতরার উপর। দেয়াল থেকে টান মেরে উঠোনে ছুড়ে মারল। ছিন্নভিন্ন হৃদয়ের মত শ্যামলের দোতরা আর্তনাদ করে পড়ে রইল শুষ্ক কঠিন মাটির ওপর। তার তারগুলি ছিঁড়ে গেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র