মৌ দাশগুপ্তা - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

মৌ দাশগুপ্তা

মন মোর মেঘের সঙ্গী









আকাশে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি,বিরামহীন, সঙ্গী তার তাল হারানো আষাঢ়ে বাতাস। রুমিদের বাড়ি থেকে সানাইয়ের সুর ভেসে আসছে। আজ ওর দাদার বৌভাত। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে মন খারাপের কালো মেঘ। সাথে আচম্বিতেই ভিড় করে আসছে যত রাজ্যের অস্থির চিন্তাধারা।
রুমি আমার একদম ছোটবেলার বন্ধু। রুমিদের বাড়িতে আমার আর আমাদের বাড়িতে রুমির অবারিত দ্বার যাতায়াত ছিল। রুমির বাবা অরুণ মেসোর পেশাগত সুনাম তেমন ছিলনা,বরঞ্চ লোকে মুখের ওপর না বললেও আড়ালে ঘুষখোর, সুবিধাবাদী, দু’মুখো দালাল এই সব গালিগালাজ দিত। তাতে অবশ্য তেমন কিছু এসে যেত না ওদের। বৈভব বিলাসে পাড়ার সবাইকে টেক্কা দিয়ে যেত ওদের পরিবার। চলনে বলনে, দামী পোশাক, পারফিউমে, সিগারেট ধরানোর স্টাইলে, পাড়ার কম বয়সী মেয়েদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল শাক্যদা। এহেন শাক্যদার ওপর আমার দুর্বলতাটা নিতান্তই একমুখী ছিলোনা। এখনও একান্ত অবসরে, বিষণ্ণ মনের অতীতচারণায় একটি প্রিয় স্বর কানের কাছে ফিসফিসয়ে বলে,-- 
- একটা দিন খোলাচুলে সিঁদুর আর লাল শাড়িতে শুধু আমার জন্য সাজবি সুমি? দেখবো ঘোমটা দিয়ে বউ সাজলে কেমন মানায় তোকে… তুই আমার বউ হবি, সুমি?
- এই মুখপুড়ি , জানিস তুই বারণ করেছিস বলে তোকে চিঠি আর লিখি না বটে, কিন্তু সারাদিন মনে মনে কত কথা যে বলি... আমার ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমাতে যাবার মাঝের সময়টুকু তোকেই তো দিয়েছি, তাও কেন যে সারা রাত স্বপ্ন হয়ে জ্বালাস!

এখনো আমার সযত্নে তুলে রাখা কবিতার খাতায় পাতার ফাঁকে নীরবে সুবাস ছড়াচ্ছে শাক্যদার লেখা আর আমার মন কেমন করা ছোট্ট যতসব চিরকুট। ভাবনায় বাঁধা পড়লো, কে যেন নক করছে। ব্যাজার মুখে উঠে দরজা খুলতেই দেখি শ্রীতমাদি। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে দিদিভাই এখন চাকরীসূত্রে বাঙ্গালোরে। আমার জন্যই ওর আর বিয়েটা করা হোল না। এই শ্রীতমাদির দাদার সাথেই বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছিলো দিদিভাইয়ের। মনে মনে খুব খুশী হলেও কিন্তু এখন আমার বদমেজাজি মুখোশটা খুললে চলবে না। দরজার পাল্লা দু’হাতে আটকে চোখ কুঁচকে
চাইতেই শ্রীতমাদি হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,-- 
- তোর জন্য কালীঘাটে পুজো দিয়ে আসলাম, আসার পথে কাকীমা বললো ওষুধগুলো নিয়ে নিতে। ইয়ে, তোর শরীর এখন কেমন, না মানে বলছিলাম ওষুধগুলো ঠিক মতো খাচ্ছিস তো সুমি? ...’
খারাপ লাগলেও দরজাটা সপাটে’ শ্রীতমাদির মুখের ওপরেই বন্ধ করে দিয়ে আবার খাটের ওপর ছিটকে পড়লাম।এবারও মুখোশটা খুলতে পারলামনা। বেশ কয়েকদিন ধরেই মেজাজ একটু একটু করে খারাপ হওয়া শুরু হয়েছিলো। আসলে বায়োপ্সির ফাইনাল রিপোর্টটা হাতে পাবার পর থেকেই পাল্টে যাচ্ছিলাম। আমি চাইছিলাম, শাক্যদার মত আমার বাবা মাও আমাকে ভুল বুঝুক, আমার থেকে দুরে সরে যাক, শাক্যদার মত ওরাও আমায় ছেড়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাক। কিন্তু ওরা দুজন যেন আরো বেশী করে আমায় আঁকড়ে ধরছিলো। আমার জন্য অকালে বুড়িয়ে যেতে দেখতাম আমার বাবাকে, আমার মাকে,বাবার শেষ বয়সের জন্য সঞ্চিত ভাণ্ডার খালি হয়ে আসছিলো আমার জন্য।আমার মস্তিষ্ক বলতো নিজে বাঁচতে গিয়ে দুটো মানুষকে শেষজীবনে
কপর্দকশূন্য করার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো, কিন্তু মন সব বুঝেও অবুঝের মত খালি বাঁচতে চাইত। একটা মোটে দিদি আমার, অবস্থা দেখে বিয়ের ঠিক একমাস আগে বিয়ে ভেঙে দিয়ে চাকরী নিয়ে চলে গেল বাঙ্গালোর। রোজগারের সিংহভাগ দিদিটা বাড়ি পাঠায় আমার জন্য।ভালো খাওয়া, ভালো থাকা, উৎসব অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল বাড়ির সবার। দাঁতে দাঁত চেপে দিনের পর দিন নিজেদের সমস্যা ভুলে স্রেফ নুন আলুসিদ্ধ ভাত খেয়ে বাকি তিনটে মানুষ কেমন মরণপণ যুদ্ধে নেমে পড়ল শুধু আমায় ভালো করে তুলতে।আমার ওষুধ, আমার পথ্য, আমার ভালো থাকা, আমায় ভালো রাখা। সহ্য হত না আমার। তাই ধীরে ধীরে নিজেকে বদলে ফেলছিলাম।চাইতাম বাড়ীর সবাই আমাকে খুব খারাপ ভাবুক, ঘেন্না করুক আমায়। বিরক্ত হয়ে আমার জন্য নিজেদের ভালোমন্দ ভুলে যাওয়াটা সবাই বন্ধ করুক।সবাই আমার কথা ভুলে যাক।তাই বেপরোয়া হয়ে উঠছিলাম।ঝগড়ুটে,বদমেজাজি,স্বার্থপর একটা খারাপ মেয়ে হতে চাইছিলাম।আমার ব্যাবহারে দুঃখ পেত মা, বাবা। বাবা গম্ভীর মুখে সরে যেত সামনে থেকে, মা অসহায়ের মত কাঁদত, আমার খুব কষ্ট হত, ইচ্ছা হত আগের মত ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করি, আদর খাই, কিন্তু যেতাম না। ভালবাসার টান যত আলগা হবে তত আমায় ছেড়ে থাকার দুঃখ কম হবে ওনাদের, ভেবে মনকে শক্ত রাখতাম। আবার বন্ধুদের সামনে জোর করে দেখাতাম যে ক্যান্সার বলে কোনো অসুখ আমার নেই । যে অসুখের নাম শুনে ভালবাসার মিথ্যে অভিনয়ের মুখোশটা ঝেড়ে ফেলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে আমার প্রথম প্রেম,যে অসুখ ভালবাসার পাত্রী থেকে আমায় দয়া,করুণার পাত্রী করে তুলেছে আমার একদা প্রিয়জনের চোখে,যে অসুখ শাপেবর হয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে রুমিদের পরিবারের মান সম্মানের ভিত। মন ভালো করতে গান শুনতাম ,কবিতা লিখতাম , যতক্ষণ শরীর বইত ততক্ষণ ফেসবুক, স্কাইপে, অর্কুট, ফ্রপারে জমিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম, আর এ সবই করতাম নিজেকে মৃত্যু চিন্তা থেকে দূরে রাখতে। কে চায় তারুণ্যর শুরুতেই, জীবনের প্রারম্ভেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেমোথেরাপি নেয়া নিজের চেহারার ঔজ্জ্বল্য হারানো দেখতে ! রোজ একটু একটু করে মরে যেতে! তাই ডাক্তারের দেয়া কেমোথেরাপি নিতাম , ওষুধ খেতাম,পথ্য নিতাম , অথচ আগের সুমি আর ছিলাম না।

নহবতের সুর বাদলা দিনে মনকে শুধু কাঁদায় না, চোখকেও বানভাসি করে তোলে। ধীরে ধীরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ব্রেস্ট রিমুভ্যালের পর চেহারাটা কেমন বদলে গেছে। কেমোথেরাপির চোটে মাথার চুল প্রায় নেই বললেই হয়। মুখটা কালচে হয়ে গেছে। কিন্তু ওষুধের গুণে বেঁচে গেছি, বেঁচে আছি। চেহারা পাল্টালেও মনটা তো পাল্টায়নি, আর আয়নার সামনে মুখোশ পরে থাকা যায়না। তাই ঝাপসা চোখে দেখছিলাম বিসর্জনের পর দুর্গাপ্রতিমা থেকে যেমন রঙগুলো গলে ধুয়ে জলে মিশে যায় তেমনি ভাবে আমার মন্দমেয়ের মুখোশ ধুয়ে কেমন করে সব রঙ গলে নেমে আসছে অঝোর ধারায়, যন্ত্রণার নীল,বেদনার কালশিটে রঙা বেগুনি,
রাগের গনগনে লাল, ঈর্ষার সবুজ, মন খারাপর ন্যাবা হলুদ, বিষাদের ধুসর, হারানো ভালোবাসার তেজপাতারং…হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর থেকে কত চেষ্টা করছি মুখোশটা ছিঁড়ে খুলে ফেলার। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এমন জং ধরে আটকে গেছে যে খুলতে গিয়ে খুলতে পারতামনা। আজ বাদলাদিনের বেহাগ আমায় একধাক্কায় মুখোশহীনা করে দিল। পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো কেউ। স্পর্শে বুঝলাম ‘মা’। মুখোশহীন মুখ লুকানোর জন্য মায়ের আঁচলের চেয়ে বড় আশ্রয় আছে নাকি? মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে গঙ্গা যমুনার নীরব প্লাবনে ভেসে যেতে যেতে মনেমনে একটা কবিতা লিখে ফেললাম।

                              “একটা মুখোশ,
                            একজন মুখোশহীন মানুষ,
                               আর মায়ের আঁচল,

... এক দুর্দান্ত কোলাজ।।“

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র