রত্নদীপা দে ঘোষ - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

রত্নদীপা দে ঘোষ



মুখোশের সাল এবং তামামি






মুখোশ শব্দটিতে খুব একটা ছোটবেলার গন্ধ । অনেকখানি এক্কাদোক্কার লুডো , ছক্কাপাঞ্জার দুষ্টুমি । সেইসময় মুখোশ আসত স্বপ্নে । কখনো হাসির , কখনো ভয়ের । বাড়ির উঠোনে একগোছা কিশোরী । তাদের সবার মুখেই রাসমেলায় কেনা মুখোশ । কেউ কাউকে চিনতে পারছি না । জামার রঙ ধরে চিনে নিচ্ছি পার্থিব প্রিয় । কোন কোন মুখোশ রাক্ষসের । হঠাৎ অন্ধকারে ভয় করতো বইকি । কোনটি ছিল জোকারের । সার্কাস মনে করিয়ে দিত । অট্টহাসির দাঁত লাগানো সেইসব মুখোশ আমাদের খেলার মাঝে ছড়িয়ে দিত হাসির ফুল্কারি ... ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো মুখোশ । আড়াল আবডাল থেকে বেরিয়ে এলো মুখোশের ডালপালা । আমরা তখন প্রাচীরের আড়ালে । চিনতে শিখছি মুখোশ গড়ার মেলা ।

নিজের মুখের সাথে মিশে যাচ্ছে মুখোশের ত্বক । যখন আমি নিজে সন্ধ্যেবেলা , কী আশ্চর্য , মুখোশ তখন সদ্য সকাল । ভেতরে থইথই বর্ষা আর বাইরে মেঘসজল ভরসা । কেমন করে পেরবো মুখোশের আলোকবর্ষ ? মুখোশ মানে নাতিদীর্ঘ মুখজীবন । মুখোশ মানে মানুষের মুখকমলে হৃদপিণ্ডের আলাপন । যে মুখহীন সময়ের মধ্যে আমরা কিশোরী হলাম , যুবতী হলাম বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার ভেতরে আমরা গোলাপবন্দনায় রাজকীয় হলাম , আর সেই অবসরে মুখোশ ঢুকে পড়লো আমাদের শরীরে । আমরা আশ্চর্য হলেম না এতটুকু । আমাদের চশমার ফ্রেম কেঁপে উঠলো না জারদউসির জোরাজুরিতে । মুখোশ যেন মহাকালের রথ , রথের ঘোড়া , আমাদের চাবুক ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সৌভাগ্যের দিকে ।

আমাদের বয়েস বাড়ছে ক্রমশ । আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মুখোশের সংখ্যা । এখন আর মুখোশ কেনার জন্যে রাস মেলার অপেক্ষা করতে হয়না । কিনতেও হয়না দোকান বাজার থেকে । মনে মনেই মুখোশ বানাও । আর বানিয়ে ফেলো , কান্নার মুখোশ হাসির মুখোশ । প্রেমের মুখোশ তো আরও সহজলভ্য । গুণের গুণিতকে বেড়ে ওঠে মুখোশের কারখানা । মুখোশভোর হয় আমাদের । মুখোশের সূর্য রোদ ডাকে । আমরা মুখোশের গ্রীষ্মে বিরক্ত হই । ঘাম বেজে ওঠে মুখোশের আড়ালে । আমরা তখন মুখ বোঝাই করি শীতমাফলারে । যেন কোথাও কোনো বেদনা নেই আমাদের । ভালবাসা ভেঙে যায়নি আমাদের । তারপর মুখোশের অভিঘাত , প্রত্যহ রাত । মুখোশের দরদামে ক্লান্ত মুখোশ ।

বাদলাবিষণ্ণ মুখোশের হেরাফেরি । মুখোশও তবে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের সাথে ? নাকি আমরাই মুখোশের নিঃশ্বাসে শ্বাস নিতে পারি না আর । দম বন্ধ হয়ে আসে । আকাশ বাতাস জুড়ে অনন্ত হাহাকার । মৃত্যুই পারে বুঝি একমাত্র মুখোশ ঝেড়ে ফেলতে । বেঁচে থাকার মত প্রখর সুদকষা আর কি আছে ? বোহেমিয়ান জীবনের যত ছল আর চাতুরি , মুখোশ সেই আয়না , যাকে চিনেও চিনে উঠতে পারি না । হিসেব গোলমাল হয়ে যায় । যত দিন গড়ায় বুঝতে পারি ট্যালকম ঝরে ঝরে গেছে , সাদা মনের মাধুরী নষ্ট হয়ে গিয়েছে । আর তার বদলে জাঁকিয়ে বসেছে মুখোশের বাঁয়া তবলা আর প্রখর নউটঙ্কি । মুখোশের যাপনটি আসলে একটি কার্নিভাল । বলা চলে রিয়েল ফুয়েল । এই জলাশয় সমগ্র জীবনকে উৎসবের মত সাজিয়ে রাখতে , ঘরের ভিত্তি মজবুত রাখতে , সামাজিক দেখন্দারির পাল্লা ভারি করতে মুখোশের জুড়ি নেই । ছোটবেলার সেই সব আনন্দমুখোশ আর কাজে লাগে না আমাদের । তার বদলে আমাদের হাতে এসে গেছে অসংখ্য তেলরঙের ক্যানভাস , নিজস্ব প্রয়োজন মত আমরা এদের প্রজননে সামিল হয়েছি । কোন মুখোশ টেরাকোটার । কোনটি রামধনুর ভিবজিওর । কোনটি কেলাসিত গগনঠাকুর । কোনটি আগ্নেয়শিলা কোনটি জিতহাসিল । কোনটি মন্বন্তর । নির্বাসন দিয়েছি মাটির মুখটিকে । ময়ূখজলে ভেসে গেছে আসল হাসি কান্না মাদল আদলের ভুরুপনা । মুখোশের গন্ধ ভেসে আসে চোখ থেকে , চুল থেকে ... ভুলসরবতের গন্ধ ম ম জীবন ...

মুখোশ আমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দ্যায় ধাক্কাপাড়ের রেলসরণিতে ... দ্যাখো , কোথায় ছিলে আর কোথায় পৌঁছেছ ... নিজেকে চিনতে পারো কি আর ? নাকি আমাকেই নিজের মুখ ভেবে নিয়েছ । আকাশ খোলো , বাতাস হও । গান দিয়ে সঙ্গীত ধুয়ে রাখো । চিনতে পারো ... অই যে কপালের পয়ার ভেঙে আগিয়ে আসছে চিরহরিৎ কুসুমযান ... অই ভ্রমণে নিজেকে যুক্ত কর । হাতের পর্দা ঝেড়ে ফেল । নিজের কাণ্ডারি তুমি নিজেকে । নিজেকে শোনাও নিজেরই ব্রহ্মাণ্ড , অবুঝ সনাতন বানী ... মুখোশের দরকারটাই বা কী ? মুখোশ খেলা বই তো নয় । মুখোশ আসলে মুখ বদলাবার ব্রজভূমি ... স্পর্শ কর নিজের আত্মাকে । শ্যামলকিশোরের প্রেয়সীনি হও । ওগো মানুষ , হেলায় হারিও না অই সুগন্ধ গিরিরাজের স্বর্ণপ্রতিমা ...
মানুষউৎসবের কাছে বরং গাছ হয়ে ফোটো । গাছেদের কখনো মুখোশ লাগে না । যত মুখোশ মানুষের । গাছেরা মুখোশের বদলে সবুজ পরে , ক্লোরোফিল পরে । আরও সবুজ হয় । আরও ধনী হয় । এমন জহরতে আবীর গুলালে রাঙা হয় ...গাছেরাও মন্দিরের রাধারানী হয় ... তারা কেউ মুখোশ পরে না ... গাছেদের প্রতিদিনি রাজস্থলীর হোলি , ফুল ফুটুক আর নাই বা ফুটুক ... ঘাঘ্রার বেরাদরিতে পিচকারির অভাব হয় না ... মুখোশহীন ললিতা বিশাখা এগিয়ে আসে , রসমঞ্জুরির ফাগুনশিখায় নব কলেবর ধারণ করে তবু কোন গাছ কোনদিন মুখোশ পরে না ... কানু বিনা আর কোন মুখ নাই তাহাদের ...
নিজস্ব মুখের রোজনামচা লেখো । যা তোমার মুখ তাই অন্যের আহ্লাদ ... সেই জোয়ারে ভাসো ... ভেসে যাও ... মুখোশ পরে তো বাঁচলে অনেক । এখন নিজের মুখেই নিজের শ্বাস নাও । মধুবন , তালবন , কুমুদবন ... সমস্ত বৃন্দাবনী সারং ... মুখোশের কাছে নিজেকে বেঁচো না । কান্না করো । কান্নার চাইতে বৃহৎ প্রার্থনা আর কোথায় ... মুখোশের ভার আর বইতে পারছ না , কেন্নোর চাইতেও কৃশকায় হয়ে গেছ বুঝি ? টলতে টলতে পথ চলেছ । মদ্যমাতাল যেন , পৃথিবীর আঁতলামির সাথে আর মানিয়ে নিতে পারছ না ? গলদঘর্ম হয়ে নিজের মুখটিকেই বিসর্জন দিতেছ মাইক্রোফোনের উল্লাসধ্বনি । মুখ তো দূর , নিজের কণ্ঠটিকেও আর চিনতে পারছ না ... দেখতে পারছ না নিজেকেও ... সন্ধিপুজোর বিচ্ছেদটুকু নিয়ে ফিরে আসছ ঘরে , ওগো ঘর তুমি আমারি মুখোশ পরা বাড়ি ... তুমি আমার গেরস্থ প্রবাস ... তোমার দূর্বাঘাসে উচ্চারণের মন্ত্রপাঠ ...

যদি মুখোশ খুলতে পারো কোনদিন , কোনদিন যদি আকাশের হাতে মাথা রাখো , চুমু খাও বৃষ্টির পায়ে , অজাতশত্রু নদীটিকে ভাই বলে বুকে নিতে পারো , যদি আড়াই দশক পরে , প্রেমিকার বুকে দুধের সন্ধান পাও , যদি তোমার সমস্ত ধানসিঁড়ি , কেদুলি ফুলের মালা হার মানে নিহত লজ্জার কাছে , যদি কখনো জলে নামো , স্নান করো ... নক্ষত্রের গামছায় গা মুছে নাও ... আয়নার সামনে দাঁড়াও ...নিজের নাম ধরে ডাকো ... সর্বনামের তিথিতে ভেজাও নিজেকে ...
সেদিন ঝরে যাবে তোমার অহংমুখোশ ... অক্ষরেখা জানবে সেদিন ... চিনবে নিজেকে নিজের দ্রাঘিমায় ছায়াপথ দেখাবে পথ ... মুখোশের জন্যে নয় । নিজের অধিবাসে বিবাহ হও । বাঁচো ... হাওয়া বাতাস লাগুক সত্যিকারের প্রাণে ... মার্বেল পাথরের সিঁড়ি ... রাজবাড়ির প্রহরা ... আলোকসিন্দুক , সূর্যরাশির শূন্যতাপ্রিয় পাখিরা ... তুমি এদের কেউ নও ... এখনো বড়টি নও , ছিলে না কোনোদিনও ... সাত সমুদ্র সাতাশের ছোট্ট শিশুটি হয়ে আছ ... মনে রেখো , তোমার মুখই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শস্যকণা ... তোমার মুখেই শ্রেষ্ঠ কৃষক , কৃষিকাজের সিংদরওয়াজা তোমারি দৃষ্টি ... মনে রেখো ... সুধান্য কলস কোন মুখোশ পরে না ...

1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র