সন্দীপ কুমার মণ্ডল - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

সন্দীপ কুমার মণ্ডল



এ তুমি কেমন তুমি 







মনস্থির করেই নিয়েছিলাম আজ ঘুম থেকে যখন ইচ্ছে হবে তখন উঠবো। সপ্তাহান্তে একটা ছুটি, যদি একটু বেলা পর্যন্ত না ঘুমলাম তো করলাম কি! এদিকে এলার্মটা অফ করতে ভুলে গেছি কাল রাতে। যথারীতি উনি ওনার কাজ করেছেন। চোখটা খুলতেই মনে পড়ে গেল হারামি বসে’র মুখটা। শালা সারাদিন যেন কাজ খুঁজে খুঁজে বের করে। নিজের তো কিছু কাজ থাকেই থাকে। তারপরও ওনার ফাই-ফরমাস খাটতে খাটতে অর্ধেক বেলা পেরিয়ে যায়। তারপরেও মুখ ঝামটা। আবার যদি একবার ডাক পাই মনে মনে বলি, “শালা আবার কেন ডাকছে কে জানে...” আর সামনে গিয়ে “হ্যাঁ স্যার, না স্যার, ইয়েস স্যার, ওকে স্যার” শাল্লা যেন ওয়াগন খুলে বন্যাত্রানে “স্যার” বিলি করছে... মাঝে মাঝে নিজেকে ভেবেই অবাক লাগে। মুখে এক মনে এক... আর পাঁচ জনের মতো আমিও মুখোশধারী। আর ইনক্রিমেন্টের সময় পারলে তো স্যারের পিঠটাও চুলকে দিই আরকি। যাই হোক এলার্মটা বন্ধ করে দিয়ে আবার পাশ ফিরে শুলাম। আর এক চটকা যদি হয়ে যায় তো হয়ে যাক। ওমা... ঘুমবো কোথায়! কোথাও কিছু নেই... কানের কাছে গদাম গদাম করে ঢাক বাজতে শুরু করেছে। আজ আবার কিসের পুজো!
ঘুমটাও যখন হলো না, একবার গ্রামটা চক্কর কেটে আসি বলে বেড়িয়ে পড়লাম সেই ঢাকের শব্দ অনুসরণ করে। একদল মহিলা দেখি গলবস্ত্র হয়ে হাত জোড় করে বসে আছে। ঠাকুরের ঘটের উপরে কচি ডাব চাপিয়ে, গামছা চাপিয়ে তার উপর একটা আধফোটা পদ্মফুল রেখে বামুনঠাকুর তার পৈতেটা অদ্ভুত কায়দায় আঙুলে জডিয়ে হাত পেতে বসে আছে। বিড়বিড় করে কিসব বলছে। বোধহয় মন্ত্র টন্ত্র। আর ঢাকি ঊর্ধ্বশ্বাসে ঢাকের চামড়া তুলছে। ঠাকুর নাকি ফুল দেবে। ওই ফুল নাকি ঘট থেকে নড়ে নড়ে এমনি বামুন ঠাকুরের হাতে এসে পড়বে। আর যদি পড়ে, যজমান সৌভাগ্যবান। তার নাকি ফুলে ফলে ভরে উঠবে সব। শাল্লা... যত্তসব বুজরুকি... আসলে এটাও মুখোশ। স্বয়ং ঈশ্বরের মুখোশে কিছু বোকা মানুষের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দক্ষিণা, আহারাদি আর বিশ্বাস লুটে নেওয়া যায়। এখানে বেশীক্ষণ থাকলে আমার মেজাজ হারানোটা খুব একটা কঠিন হবে না। মানে মানে কেটে পরাই ভালো
ওই দেখ, ওই দেখ। হারামজাদারা ছুটির দিন পেলেই হলো। মাইক বাজিয়ে নেমে পরেছেন দেশোদ্ধারে। বাজারে ঢোকাও এখন দুষ্কর। সব শালা মুখোশধারীর দল । হেন কারেঙ্গে, তেন করেঙ্গে, সোনা বান্ধায়েঙ্গে। বাবা সোনা চাই না। পিচও চাইনা। রাস্তাগুলোয় মোরাম তো ঢাল। রাস্তায় চলতে গিয়ে তো পারলে পা গুলো মাথায় তুলে হাঁটি। আর একটা হোঁচট খেলেই ডাক্তারের পোয়া বারো। শাল্লা উড়ে গেল বুড়ো আঙুলের নখ। প্রেসক্রিপশনে লিখে দেবে সিটি স্ক্যান। কমিশন টা তো পেতে হবে। এই এক হয়েছে বিখ্যাত মুখোশ বাজার। ডাক্তার থেকে ল্যাবরেটরি থেকে রিক্সাওয়ালা পর্যন্ত এত্ত বড় বড় মুখোশ এঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেনে বুঝেও কিছু করার নেই। আমাদের সেই যেতেও হবে। এদেরই বা দোষ কি? গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে দিল্লী, মুম্বাই গিয়ে ডিগ্রী নিয়ে এসেছে। অজুহাত???? “সারা দেশে কটাই বা সরকারী মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে, ছেলেগুলোকে শিক্ষিত না করলে দেশের উন্নতি হবে কি করে!” এখানেও সেই শিক্ষার নাম করে মুখোশধারী ব্যবসায়ীর দল। পাঁচ বছর ধরে ছেলেমেয়ে গুলো মদ আর গাঁজা খেয়ে কাটিয়ে এসে শহরে ফ্লাইওভার বানাচ্ছে। সে যে তাদের মতোই টলমল হবে তার আর ব্যতিক্রম কি!
যা হচ্ছে হোক, আমার তাতে কি! অতশতয় চোখ কান না দিলেই হলো। গুটি গুটি পায়ে বাড়ি যাই বাপু। বাড়ি ফিরে দৃশ্য দেখে আমি অবাক। আমার বৌ দেখি মায়ের পিছু পিছু মা মা করে ঘুরছে। একসাথে রান্না করছে। মা ও দেখি বৌকে মেয়ের মতো এটা সেটা হুকুম করছে, বৌও অম্লান বদনে সে কাজ করছে। দুজনে খুনসুটিও করছে। কত পি এন পি সি গল্পও হচ্ছে। আমি রাত্রে আমার বিছানার বৌয়ের সাথে এই মেয়েটাকে মেলাতে পারছি না। বুকের উপর মাথা রেখে মায়ের বিরুদ্ধে কত্ত কত্ত অভিযোগ। বৌয়ের অবর্তমানে মায়ের মুখেও শুনি তোর বৌ এই... তোর বৌ সেই... তাহলে ? আর আমার হয়েছে শাঁখের করাতের মতো অবস্থা। কাউকেই কিছু বলতে পারিনা। যদিও ঠিক ভুলটা বুঝতে পারি। কিন্তু মুখে একটি কথা বলিনা। মুখের উপর “বোবা কালার শত্রু নাই” এমন একটা মুখোশ চাপিয়ে দুপক্ষের কথা শুনে যাই। কিন্তু এদের কোনটা আসল মুখ আর কোনটা মুখোশ?
খেয়ে দেয়ে উপরে উঠে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, ফোন এলো। বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ। আমার লেখা তো আর কেউ পড়ে না, তবু এইসব অনুষ্ঠান গুলোতে ডাক পাই। দু একটা কবিতা বলার সুযোগও পাই। শুনেছিলাম দু একটা পরকীয়া না করলে নাকি কবি হওয়া যায়না। কবিতার মাঝে ওই সব রস টস না পেলে লোকে কবিতা পড়বে কেন গাছ ফুল পাখির কবিতা। আর যদি সেই পরকীয়ার কথা ফাঁস হয়ে গিয়ে একটু বদনাম কুড়ানো যায় তাহলে আর কথাই নেই। যদি বদনামী মহিলা কবি হন তাহলে তো তাঁর বই নয়, যেন হট কেক। বাজারে পরবার অপেক্ষা শুধু। কোনো ভাবে তারিফ পে তারিফ করে করে পাঠকের চাহিদার গল্প শুনিয়ে যদি সেই কবিকে কবিতা সংকলনের ব্যাপারে রাজি করানো যায় তাহলে তাঁর বদনাম বিক্রির সব দায়িত্ব ওই প্রকাশক মহাশয়ই নেবেন সন্দেহ নেই। কবি ভাবলেন আমার কত বড় গুণগ্রাহী রে আসলে প্রকাশকের মুখোশের আড়ালে আর এক ব্যবসায়ী। ব্যতিক্রমী কবি কি নেই! তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই তাঁদের এই লিস্ট থেকে বাদ রেখেছি।
আমার অত কথায় কাজ কি! আমন্ত্রণ করেছেন, অম্লান বদনে যাবো চা-শিঙারা খাবো। আপাতত গ্রীষ্মের বিকেলে একটু নদীর ধার থেকে ঘুরে আসা ভালো। সেই ছেলেটা আজ আবার একটা অন্য মেয়ের সাথে কাশবনের আড়াল দিয়ে গেল। পাশের গ্রামের হাইস্কুলের টিচার। এলাকায় টিউশন মাস্টার হিসাবে নাম করেছে। অনেক ছাত্র ছাত্রী। আগেও বেশ কয়েকবার অন্য মেয়েদের সাথে এই পথে যেতে দেখেছি। পকেট খুঁজলে দু একটা সতর্কতার প্যাকেট নিশ্চয় পাওয়া যাবে। আবার একটা নতুন মুরগি ফাঁসিয়েছে রে। মুখের উপর মাস্টারমশাই সমাজের ভিত গড়ার কারিগরের মুখোশ লাগিয়ে একের পর এক প্রেমিকা বদলে যাচ্ছে।
যত না দেখা যায় ততই ভালো। নিজেকে নিয়ে থাকতে শিখেছি। লোকের ব্যাপারে অত মাথাব্যথা না করলেও চলে। কিন্তু কি করবো চোখে পড়ে যে।
রাত্রে খাওয়া দাওয়া করে বিছানা এসে শুয়েছি। বোন জলের বোতলটা দিয়ে গেল। কাল সকালে আবার ওর ব্লাড টেস্ট আছে। মেয়েটাকে দেখলে কেমন মায়া হয়। কিভাবে দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। লোকের মুখোশ নিয়ে নানা কথা বললাম অথচ নিজেও তো মুখের উপর এত্ত বড় একটা মুখোশ টেনে বসে আছি সে কথা কে বলবে! বোনকে তো মুখের উপর বলতে পারি না, আমি জানি তুই দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছিস কেন! আমি জানি তোর প্রতি রাতে কেন জ্বর আসে। কেন অল্পতেই হাফিয়ে যায়। পরীক্ষার জন্য সপ্তাহে সপ্তাহে রক্ত দিয়ে তোর হাতটা যে বেঁকে গেল। একবার ব্লাড রিপোর্টে “লিউকেমিয়া” লেখা দেখে জানতে চেয়েছিলি ওটার মানে কি, তারপর থেকে যত রিপোর্ট তোর চোখের সামনে থেকে লুকিয়ে রাখি। মেডিকেল টার্মটা তুই না জানলেও আমি তো জানি লিউকেমিয়া মানে ব্লাড ক্যন্সার।

২টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র