জুবিন ঘোষ - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

জুবিন ঘোষ



অল রোডস্‌ লিড টু রোম







একদল পিঁপড়েরও নিজস্ব চলার পথ থাকে। বন্য জন্তুদের চলাচলের জন্য হাতি, বাঘ ইত্যাদির পথ সুপ্রসিদ্ধ। মানুষের সভ্যতার বিকাশও সেই পথ ধরেই হয়েছিল, তাই হয়তো আগুন আবিষ্কারের মতোই মানব সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানের অগ্রগতির পুরোধা হয়ে ওঠে চাকার আবিষ্কার। বিজ্ঞান মনে করে, পথ হল সময়-নাশক --- যত দ্রুত পথকে অতিক্রম করতে পারবে ততই দ্রুত উন্নতির পথ মসৃণ হবে। অথচ আদিমকাল থেকে পথই ছিল জীবন জীবিকার একমাত্র উপায়। আজও পথকে সম্বল করে পাথেয়-এর ওপর বেঁচে থাকে কত জীবিকা। কার কত গুরুত্বপূর্ণ পথ তার উপর নির্ভর করে থাকে উপার্জনের মাত্রা। তাই হয়তো বাস, অটো, ভ্যানের মালিক ও চালকেরা রুট পারমিটের জন্য হা-হুতাস। আজও কোথাও কোথাও পুরোনো যাযাবরদের উত্তরপুরুষ জিপসিরা পথের উপরেই তাদের ঘর সংসার পেতে বসে। আমাদের ভারতবর্ষের আধুনিকিকরণও সেই পথ ধরেই ধটেছিল। তবে সেটা জলপথ। নগরায়ণের ধারাটিও পথকে কেন্দ্র করেই বারবার গড়তে ও ভাঙতে দেখা যায়। খাইবার গিরিপথ না থাকলে কি আদৌ ভারতবর্ষ এত বৈচিত্র্যময় জাতি হয়ে উঠত !

আধুনিক বাংলা গানে সুচিত্রা আর উত্তমকুমারের দৃশ্যটা ছাড়া বোধহয় পথ নিয়ে কোনও কথাই শুরু হতে পারে না। পথের সব চেয়ে বড় ব্যান্ড ভ্যালুটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা মুখার্জী করে গেছেন সপ্তপদী চলচ্চিত্রে “এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো ?” বাঙালি খুব সম্ভব পথ শব্দটা বললে এই গানটাই আগে মনে পড়বে। অবশ্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পথের দাবী উপন্যাসে আগেই পথ শব্দটা বাঙালির বইয়ের তাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। প্রাচীন সাহিত্যকাল থেকেই সাহিত্যে পথ বা রাস্তার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। মহাভারত ও রামায়ণের বিভিন্ন শ্লোকে পথের বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। এমনকি আধুনিক সাহিত্যেও বিভিন্ন গ্রন্থের ও পত্রপত্রিকার নামকরণেও পথ বা রাস্তার ইঙ্গিত আমরা পাই। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’ ভ্রমণকাহিনি একসময় বঙ্গসমজের ভ্রমণপিপাশুদের খুব বরেণ্য ছিল। আধুনিক বহু পত্রিকার নামকরণেও পথের উল্লেখ পাই, যেমন ‘অতন্দ্রপথ সাহিত্যপত্র’, ‘উত্তরাপথ’ (সুইডেন থেকে প্রকাশিত), ‘কলেজস্ট্রিট’, ‘কলোনি মোড়’ (বারাসত থেকে প্রকাশিত), ‘গল্পসরণি’ (সিউড়ি), ‘ছাপাখানার গলি’ (মুর্শিদাবাদ), ‘মঙ্গলপথ’ (হাওড়া, শিবপুর), ‘সত্যপথে যাতিক’ (চন্দ্রকোনা, পশ্চিম মেদিনীপুর), ‘স্বপ্নসিঁড়ি’ (বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ), ‘সরণি’ (বারাকপুর), ‘সুইনহো স্ট্রিট’ (কলকাতা)। এই তালিকাগুলি প্রকাশের অর্থ এই নয় যে তালিকার মাধ্যমে পথের গুরুত্বকে প্রমাণ করার তাগিদ থাকছে, পথের গুরুত্ব যে কতটা তা আমরা নিজেদের জীবনযাপনেই হাড়েহাড়ে টের পাই। আমি যেখানে থাকি অর্থাৎ দক্ষিণায়নের কিছু রাস্তা পাকা হবার সুবাদে কিছুদিন বন্ধ করে দিয়েছিল উন্নয়নের খাতিরে। তখন এখানকার সমস্ত বাসিন্দাদের মতো আমারও মনে হচ্ছিল বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের পথটা কত সুকঠিন। বাড়ি-জমি কেনাবেচার সময় আগেই আমরা লক্ষ্য করি বাইরে যাবার পথ আছে তো !

আমি কবি বলেই হয়তো সব কিছুতে একটু কবিতা না ঢোকালে শান্তি পাই না। তাই পথের সারাৎসার খুঁজতে কবিতায় পথের সন্ধান করতে মন চাইল। আসলে পথ ছাড়া গত্যন্তর নাই বলেই হয়তো বাংলাসাহিত্যে খুব সম্ভব সব কবির লেখাতেই বারবার পথের বা রাস্তার কিছু না কিছু উল্লেখ পাই। শুরুর উদাহরণটা আধুনিক কাব্য থেকেই করতে করতেই না হয় যাই --- আমাদের অতি পরিচিত কিছু কবিতায়। রোমান্টিজম্‌ প্রিয় বাঙালির সবচাইতে প্রিয় কবিতা জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটাই শুরু হচ্ছে, “হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিয়াছি পৃথিবীর পথে,” --- অনাময় নিঃস্ব ভালোবাসার পথে যেখানে তিনি আভ্যন্তরীণ উপলব্ধ সত্য সুন্দরের কড়ি হাতে দাঁড়াতে চান প্রকাশ মহিমার ‘হাজার বছরের পথ চলার’ সামনে একা। একমাত্র যাত্রার অন্তে সেই পরমের খোঁজে নিবেদিত হৃদয় সম্পূর্ণ সমাহিত অবস্থায় কবি নিরন্তর খুঁজে চলেন এত পথ চলার ক্লান্তির শেষের শান্তির সেই নিভৃত স্থানটি “মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”-কে। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতাটা তো পথজীবী এক ডাকহরকরার উপরেই লিখিত, কী অপূর্ব সেখানে পথের বর্ণনা --- “তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে স’রে যায় বন, / আরো পথ, আরো পথ --- বুঝি হয় লাল ও-পূর্ব কোণ।” সুকান্তের আরও একটি বিখ্যাত কবিতা ‘আঠারো বছর বয়স’-এও যৌবনের শক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে কবি লেখেন, “আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার / পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান।” সুকান্তের একটি কবিতার নাম ‘স্বপ্নপথ’—“অবিশ্রান্ত পৃথিবীর পথে, / জলে স্থলে আকাশে পর্বতে। / একদিন পথে যেতে যেতে / উষ্ণ বক্ষ উঠেছিল মেতে।”--- কবির পথরচনা স্বপ্নের মধ্যেও দৃশ্যমান হয়ে ওঠা উদাহরণের মতো। সুকান্তের কবিতায় সড়ক পথও বাদ যায়নি, ‘সুতরাং’ কবিতায় সুকান্ত লেখেন, “এতদিন বাধা ছিল সড়ক / আজ চোখে দেখি শুধু নরক !” পথ যেন শেষই হয় না কিশোর সুকান্তের লেখনীতে, ওপর একটি প্রখ্যাত কবিতা ‘চৈত্রদিনের গান’ কবিতাতেও তাঁর কলম দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, “তোমার সোনার রথে চ’ড়ে / মুক্তি-পথের লাগাম ধ’রে / ভবিষ্যতের পানে চল আলোর গান গেয়ে।” স্বপ্নপথ থেকে মুক্তি-পথ --- পথের এই শ্রেণি বিন্যাসটা পাঠক লক্ষ্য করুন। তিরিশের দশকের আরেক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো ‘পদাতিক কবি’ নামেই পরিচিত। সুভাষবাবুর ‘মে-দিবসের কবিতা’ নাকম কবিতার সেই বিখ্যাত পঙক্তিগুলো মনে পড়ে ? “প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য / এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা, / দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য / চিনে নেবে যৌবন-আত্মা।।” কবি সুভাষের কথা বললেই অনস্বীকার্য যে কবিতার কথা মনে পড়ে যায় সেই ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ কবিতাতেও রাস্তা, ফুটপাত, গলি তিনটে শব্দই যেন ওতপ্রোতভাবে কবিতার রস ও ভাবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, “শান-বাঁধানো ফুটপাতে / পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ / কচি কচি পাতার পাঁজর ফাটিয়ে / হাসছে।” কিংবা ওই একই কবিতায় দেখুন মানুষ যাবার মতো যেন রাস্তা দিয়েও দিন বয়ে চলার কী অসাধারণ দর্শন--- “যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে / যেন না ফেরে।” এবং ঠিক যখন কবিতার কাইমেক্সের আগের দৃশ্যটা রচিত হচ্ছে সেখানেও এক গলিপথের উল্লেখে এক অসূর্যস্পর্শা তাচ্ছিল্য রচিত হচ্ছে ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ কবিতাতে, “লাল কালিতে ছাপা হল্‌দে চিঠির মতো / আকাশটাকে মাথায় নিয়ে / এ-গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে / রেলিঙে বুক চেপে ধ’রে / এই সব সাত-পাঁচ ভাবছিল” --- ‘এ-গলির’ শব্দটা ‘কালোকুচ্ছিত’ মেয়েটিকে যেন কোনও অন্ধকারে অজানায় ঠেলে দেবার জন্য রচিত। ভাবার বিষয় সে কিন্তু হাইরোডের নয়, এক অতি সাধারণ একটা মেয়ের মধ্যবিত্ততার সমার্থক যেন হয়ে ওঠে ‘এ-গলির’ শব্দটি। বুদ্ধদেব বসুর একটি গোটা কাব্যগন্থের নাম ‘পৃথিবীর পথে’। বুদ্ধদেবের যে দুটি কবিতাই মূলত জনসাধারণের ভালোলাগার অন্যতম সেই ‘ইলিশ’ ও ‘জোনাকি’ দুটি কবিতাতেও পথের উল্লেখ আমরা পাই, যেমন ‘ইলিশ’ নামক তাঁর অতিবিখ্যাত কবিতায় ‘মেঘনা’ নদীর জলপথের ধারের দৃশ্যপট ফুটে উঠেছে অতি সুন্দরভাবে। এমনকি ‘জোনাকি’ কবিতাতেও পথের উল্লেখ দুই-দু’বার --- “তোর সঙ্গী / সব পাড়াগাঁর / পথে সারা রাত / ঘন অন্ধ- / কারে জ্বলছে।” দ্বিতীয়বার কলকাতার ফুটপাথের কথা ফুটে উঠছে, “এ যে কলকা- / তার ফুটপাত, / নেই ফাঁকা মাঠ / নেই ঝোপঝাড় / নেই জঙ্গল”। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অতি বিখ্যাত একটি কবিতা ‘কলকাতার যিশু’-তে একটি ‘ভিখারি-মায়ের’ অবোধ নগ্ন শিশুর ‘ঝড়ের-বেগে-ধাববান কলকাতার হাইরোড পার হওয়ার সেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়া চিত্রকল্পটি আমাদের চোখের সামনে ভাসতে থাকে। সেখানে সেই হাইরোড পার হবার দৃশ্যে কবি বলছেন, ”স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে, / টাল্‌মাটাল পায়ে / রাস্তার এক-পার থেকে অন্য-পারে হেঁটে চলে যায় / সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি শিশু।” কবি বলে দিচ্ছেন এই পথ চলা “যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে / সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেতে চাও / হাতের মুঠোয়। যেন তাই / টাল্‌মাটাল পায়ে তুমি / পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে চলেছ।” কবিতাটি বাংলার সেরা কবিতাগুলির মধ্যে একটি সেই পথ চলার সুবাদেই, এই চিত্রকল্পেই এই ভাবনাতেই অতিনিহিত। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতাতেও পথের ধারের একটি দৃশ্য (যদিও এই দৃশ্যকল্পে রাস্তা হয়ে ওঠে সমাজ প্রতিকী) – “নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরার কবিতাগুলোর মধ্যেও পথের আলাপ পাওয়া যায় প্রবলভাবে। ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ কবিতার সূচনাতেই সুনীলদা লিখছেন, ‘বাসস্টপে দেখা হল তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল / স্বপ্নে বহুক্ষণ’ ---এখানেও সেই বাসস্টপের উল্লেখে পথের একটা অংশ ফুটে ওঠে। ‘নির্বাসন’ কবিতায় “পাপ নেই, দুঃখ নেই এমন / পায়ে চলা পথ ধরে কারা আসে ! যেন গহন বন / পেরিয়ে শিকারি এল” ভাবুন সুনীলের চিত্রকল্পটা, পথ হবে “পাপ নেই, দুঃখ নেই এমন” । কবিদের কবিতায় এইভাবেই পথ শব্দটা বহু ব্যঞ্জনায় নতুন নতুন রূপকল্প তৈরি করেছে। যাহা অতিক্রম করতে হয় তাহাই পথ। সিঁড়িও তাই পথের অংশ। সুনীলের ‘অপমান ও নীরাকে উত্তর’ কবিতায় সেই সিঁড়ি হয়ে উঠেছে উপজীব্য, “সিঁড়ি দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইল বন্ধু তিনজন।” ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’ কবিতাতেও সুনীল সিঁড়িপথের কথা বলেন, “সিঁড়ি দিয়ে নামতে মামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরি / কথাটাই বলা হয়নি”। রেস্তোরাঁর কোনও পথ হতে পারে ? ‘নীরার অসুখ’ কবিতায় সুনীল এমনই বললেন “রেস্তোরাঁয় পথে পথে মানুষের মুখ কালো, বিরক্ত মুখোশ”। সুনীলের সমসাময়িক পাঁচের দশকের আরেক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মত্ত পথাচারীর টলতে টলতে ফুটপাত বদল হওয়ার সেই অপূর্ব চিত্রকল্প ‘সে বড়ো সুখের সময় নয় সে বড়ো আনন্দের সময় নয়’ কবিতায় রাস্তার একপাশ থেকে টলতে টলতে অন্যপাশে চলে যাবার দৃশ্যে ফুটপাত বদল হবার শব্দের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়, “পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, কার্নিশে কার্নিশ, / ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে” বা “অপেক্ষা করে থাকে পাতার আড়ালে শক্ত কুঁড়ির মতন / মাকড়শার সোনালি ফাঁশ হাতে --- মালা / তোমাকে পরিয়ে দেবে --- তোমার বিবাহহ মধ্যরাতে, যখন ফুটপাত বদল হয় / --- পা থেকে মাথা টলমল করে / দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ।” জলে ভেসে যাবার পথও তো জলপথ, শক্তির ওই কবিতাটা, ‘আমি স্বেচ্ছাচারী’তে ---“তীরে কি প্রচণ্ড কলরব । ‘জলে ভেসে যায় কার শব / কোথা ছিল বাড়ি ?’ / রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়--- ‘আমি স্বেচ্ছাচারী।’” যে পথে যা চলে তাই তার পথ হলে “আকাশে মেঘ গাভির মত চরে” শক্তির এই দৃশ্যকল্প কি আমরা ভুলতে পারি? কেন ? পঞ্চাশের আরেক পুরধা কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘মত্ত অবস্থায় রচিত’ কবিতাটাকে কি আমরা ভুলে যাব ! “রাত বারোটার প কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক” এই কবিতাটা তো পুরোটাই কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেরানো চার জন অসমসাহসী যুবকের কথা। সেখানে ট্রাম চলার পথও উঠে আসে, “রাস্তার কুকুরগুলো জনহীন ট্রামলাইনে অগ্নিকণা দেখে ধন্য হয়।” এই অগ্নিকণা আসে ট্রাম লাইনের ইস্পাতের সঙ্গে ঘোড়ার খুরের তীব্র ঘর্ষণে। এই দৃশ্য আমরা দেখিনি, “তোমরা কেউ দেখনি হে এই দৃশ্য, মধ্যরাতে দেখেছে বেশ্যারা।” রাস্তাই এখানে প্রধান উপজীব্য, মধ্যরাতের স্বাধীনতা পরবর্তী কলকাতা নগরীর রাজপথ। এবার চলে আসি ষাটের দশকের সেই বিখ্যাত কবিতায়, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’। ভাস্কর চক্রবর্তী এই অসামান্য কবিতাতেও কোথায় যেন ‘রাস্তা’র কথা লুকিয়ে থেকে যায়, “...এখন / আমি মানুষের মতো না, রাস্তা / দিয়ে হাঁট্‌তে হাঁট্‌তে হঠাৎ এক লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার, / ভালোবাসার / কাছে দীর্ঘ তিনমাস আর মাথা নিচু করে বসে থাকতে ভালো লাগে না।” কবিতার কাছে রাস্তার এই সন্ধান করতে করতে একটা জায়গায় এসে অবাক হয়ে যাচ্ছি ‘অল রোডস্‌ আর লিড বাই রোমের মতো’ কি প্রত্যেকটা বিখ্যাত কবিতাতেই কি রাস্তার উল্লেখ অনিবার্য হয়ে পড়ছে ! একি তবে সেই অনিদ্রা সাধনার শীর্ষে আসীন কবির বৃহত্তর যাত্রায় অন্তিম বিন্দুতে এসে মহযাত্রিক উপাখ্যান, যা কিনা সেই যাত্রাপথের কথা না বললে অসম্পূর্ণ ! যোনিপথও একপ্রকার পথ, মলয় রায়চৌধুরীর হাংরি জেনারেশনের সেই বিতর্কীত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটার কথা ভাবুন, “আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও / দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও / বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে / কেন আমি হারিয়ে যাইনি মায়ের যোনিবর্ত্মে ?” ষাট থেকে এবার সত্তরের দশকেও একটু ঢূঁ মেরে দেখা যাক জয় গোস্বামীর কবিতায়, সেখানে তো “কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে ৷৷” ‘ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা?’ কাব্যগ্রন্থের ‘ঝাউপাতাকে রুগ্‌ণ কবির চিঠি’ কবিতায় কবি পথিকের কথা তুলে আনলেন, “ঝাউগাছের পাতা, তোমায় গান শোনাল দূরদেশী পথিক”। জয় দা’র ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘সৎকার গাথা’-তেই পথের ব্যঞ্জনা পাওয়া যাচ্ছে, “সেই রাত্রেই পালিয়েছি গ্রাম ছেড়ে / কাঁধে মা-র দেহ, উপরে জ্বলছে চাঁদ / পথে পড়েছিল বিষাক্ত জলাভূমি / পথে পড়েছিল চুন লবণের খাদ”। একই বইয়ের পরের কবিতা ‘পতন’-এ কবি প্রথম স্তবকেই লিখছেন “জল জল সূর্যপথে ওঠে নামে ঢেউ সংজ্ঞাহীন / জল জল বায়ুপথে ধাবমান কিঙ্করী হাজার”। এই পথের কি শেষ আছে ! যত খুঁজছি তত পাচ্ছি হচ্ছে অবস্থাটা। সব কবিতা পরিসরের অভাবে উল্লেখ করতে পারছি না। অবস্থাটা এমন যে এখন সেই সুচিত্রা-উত্তমের লিপে গানটা আবার মনে পরে যাচ্ছে, ‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?’ সত্যি বলতে কি এখন মনে হচ্ছে কখন শেষ হয়। এই পথের কি শেষ আছে ! যত খুঁজছি তত পাচ্ছি হচ্ছে অবস্থাটা। সব কবিতা পরিসরের অভাবে উল্লেখ করতে পারছি না। সুবোধ সরকারের ‘শাড়ি’ কবিতাটা অনেকে আবৃত্তি করেন, সেখানেও দেখা যাচ্ছে চতুর্দিক খোলা এক দৃশ্যপটের ব্যঞ্জনা বোঝাতে উঠে আসে ‘মোড়’ শব্দটা, সেও তো পথের অংশ --- “কিন্তু সেই থানও এক ঝটকায় খুলে নিল তিনজন, পাড়ার মোড়ে / একটি সদ্য নগ্ন বিধবা মেয়ে দৌড়চ্ছে আর চিৎকার করছে, বাঁচাও / পেছনে তিনজন, সেকি উল্লাস, নির্বাক পাড়ার লোকেরা। /# / বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা।” পাঠক দেখুন, পাড়ার মোড় শব্দটা একটা সংখ্যাধিক্য নির্দেশ করছে। পাড়ার গলি হলে যতটা না দেখা যায়, যতটা লোক চক্ষুর আড়ালে থাকে মোড় সেখানে ততটা প্রকাশ্য বোঝায়। এইভাবেই কবিদের লেখায় পথের হরেক রূপ হরেক ব্যঞ্জনায় ফুটে উঠছে। সুবোধ সরকার ও মল্লিকা সেনগুপ্তের একটি বইয়ের নামই তো কলকাতার একটি বিখ্যাত রাস্তার নামে, ‘সুবোধ-মল্লিক স্কোয়ার’। এবার দেখি পিনাকী ঠাকুরের আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত ‘চুম্বনের ক্ষত’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা, “আমার মন খারাপের সাহায্যে / হ’ল কলেজ স্ট্রিটে বাণিজ্য / খেলাম রিভিউয়ারের সাত চড়” কিংবা “তবু কলেজ স্ট্রিটের গলি / ট্রেনে অন্ধ শহরতলি / শোন্‌ সাধনসঙ্গিনী” --- এইভাবেই অলি, গলি , রাজপথ, বিখ্যাত রাস্তা কিংবা সাধারণ রাস্তা উঠে আসছে কবিতায়। একালেও কি আসছে না? এবার হালফিলের নব্বই দশকের শ্রীজাতের আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত বই ‘উড়ন্ত সব জোকার’ এর নামকরণ কবিতা ‘উড়ন্ত সব জোকার’ কবিতাতেও একটু ঢুঁ মেরে আসতে ইচ্ছে হতেই দেখি সেখানেও পথ শব্দটা অন্যান্য বিখ্যাত কবিতার মতো কোনও না কোনও ভাবে সমহমায় বিরাজ করছে, “জীবন তবু প্রেমদিওয়ানা। পাহাড়ি পথ...পিছু নিয়েছে পুলিশ... / এবং গাড়ি ধাক্কা খাবেই। স্বপ্ন ভাঙবে গম্ভীর আব্বুলিশ” । এই একই বইয়ে ‘প্রাইভেট টক’ কবিতার পুরো প্রেক্ষাপটটাই রচিত একটা সুযোগসন্ধানী ছেলের বান্ধবীর সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি চড়তে চড়তে। সেখানে রাস্তার খারাপ অবস্থার বর্ণনা অতি সূক্ষ্মভাবে কবিতায় মিশিয়ে দিয়েছেন শ্রীজাত, “ আবার সেই বাপন হারামজাদার দেওয়া জামাটা পড়েছ কদ্দিন না / বলেছি ওই ছোঁড়াটার সঙ্গে দ্যাখো দ্যাখো নাইস চাঁদ উঠেছে ওফ্‌ / এই কলকাতার রাস্তা তবে মিথ্যা বলব না তোমার আগেও দু’জন।” এবার কবি অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২০১৩ এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত ‘উল্কাখোর ছেলে’ কাব্যগ্রন্থের ‘২০১২’ শিরনাম্বী প্রথম কবিতাটিতেও দেখি, “সন্ধেআলোর ঘোরগলি...বাঁক...হাঁটতে থাকা... / প্রকাণ্ড সব রাস্তা যেন অনন্ত খাদ / এক পা ন’ড়ে অন্য পা-কে জড়িয়ে ধরে / কামড় বসায় পাচন-ধরা প্রাচীন বিষাদ”। কবিদেরও কবিতা প্রকাশে পথ চাই। পথের মধ্যেই যেন আত্মদর্শনের ছায়া। আমি আমার প্রথম কবিতা বইটাও নাম রেখেছিলাম সেই ভারত পথের যাত্রীক পর্যটক মেগাস্থিনিসের নামে, ‘মেগাস্থিনিসের খাতা’। শেষ বেলায় আমার একটি কবিতা দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না, সদ্য এই বছর জানুয়ারিতে বৃষ্টিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত আমার প্রথম দুটি কবিতাই পথ নিয়ে –--

অশান্ত শহর থেকে ▀ 
জুবিন ঘোষ

তুমি কি সত্যি আসতে চাইছ, বন্ধু
দুটো ভালো পথ, একটা রাস্তা অন্ধের
নেই ঠিকানা, লটবহর বা পল্টন
স্পাইক্যাম কিছু দিয়ে যাক শুভ সন্দেশ

সারা শহরে লেগে গেছে আজ কারফিউ
দাঁতের ফাঁকে ঢুকে আছে কার মাংস
ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাসস্টপে দেহ জঙ্গির
জোড়া দিয়ে দেখি এসব আমারই অংশ

তুমি কি সত্যি আসতে চাইছ, বন্ধু
এমন কোনও বকুল বেছানো ধ্বংসে ?

গদ্যেও পথ দুর্লভ নয়, তবে সে কথা বরং অন্য জায়গায় হবে। আগেই উল্লেখ করেছিলাম শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের কথা। এছাড়াও বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ ভুলে যাই কী করে, চাঁদের পাহাড়ও তো সেই যাওয়া নিয়েই। শংকরের ‘সম্রাট ও সুন্দরী’, চৌরঙ্গী, সন্দীপনের তিন মিনিটের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘এখন আমার কোনও অসুখ নেই’, খুশবন্ত সিং-এর ‘আ ট্রেন টুঁ পাকিস্থান’, রামকুমার তেওয়ারীর ‘দ্যা কামিং অফ কুতুব’, কিংবা সদ্য আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্র বই রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’।


খুঁজতে শুরু করলে এ পথের কোনও শেষ নেই। সব রাস্তাই ঠিক রোমে যায় যেমন তেমন সব সাহিত্যিক-কবি-গায়ক-চিত্রকরও সচেতনে-অবচেতনে পথের কথা তুলবেনই। বেঁচে থাকার প্রতিযোগী ইচ্ছে সকল ---- পূর্ণগ্রাসী প্রকৃতির মাঝে অকিঞ্চিৎকর উপস্থিতির জন্য কালান্তর তৃষা এই পথের ধারেই যেন শুরু হয়, এই পথের ধারেই শেষ হয়। শুধু মাঝে মাঝে সাঁকো তৈরির সময় সেই সব অপূর্ব সৃষ্টির নিদর্শন রাখতে রাখতে দিনগত অলৌকিক জীবন প্রবেশ করছেন বিলাসী পরিব্রাজকের মতো... যাত্রিক কবির পরম সত্যের সাধনার মর্মস্পর্শী মূল্য রূপে অসংখ্য অবাক চোখ লিপিবদ্ধ থাকছে পথের ধুলো

1 টি মন্তব্য:

  1. vishon enriched holam. barti paona lekhoker path.nie kobita. sudhu duto banan chokhe porlo. hoyto typo error. ব্র্যান্ড ভ্যালু ar অসূর্যস্পশ্যা।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র