দোলনচাঁপা ধর - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

দোলনচাঁপা ধর


মুখোশের আড়ালে 







এক দূর সম্পর্কের পিসি ছিল...সোনারপুরের ওদিকে বাড়ি, নাম বিদ্যুৎ, অবশ্য সাথে একটা লতাও ছিল কিন্তু ওর স্বভাবের কারণে নামটির অঙ্গহানি ঘটেছিল। স্বভাব বলতে সে মেয়ে হলেও ছেলেদের মত ফুটবল খেলত, জামাকাপড়ের বাহার ও তেমনই আর চলনে বলনে কেমন একটা শক্তপোক্ত ভাব, এমনকি কোন এক বাল্ব তৈরির কারখানায় কাজও করত নাকি সে সময়.....মায়েরা বলত ‘মদ্দানি’। হাফ প্যান্ট আর জার্সি পরে কাদায় মাখামাখি হয়ে সে খেলা আমিও ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের পার্কে, আমাদের পাড়ার ছেলেগুলোও বেশ খেলছিল ওর সাথে যেন ও একটা ছেলেই আসলে। অনেক পরে আমি তখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ার ওর অসুস্থ বর মানে পিসেমশাইকে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়ি, পাশেই সরকারী হাসপাতালে দেখাবে বলে। ওর সেই শাড়ি, সিঁদুরের টিপ দেখে কে বলবে যে ও একদিন লোকনাথ বাবার মত বসে হাঁটু দোলাত। যাই হোক সম্পর্ক দূর বলেই আসল নাম প্রকাশের সাহস পেলাম, না হলে মুখোশে ঢেকে বলতে হত।

এ তো না হয় আদ্যিকালের কথা, হাল আমলে এই আমাদেরই পাড়ায় একটি ছেলে আছে, দিব্যি সুন্দর নাম তার --শুভম, তা সে নাম তার পছন্দ নয় তাই নিজের নাম রেখেছে- মাথা, এখন কার মাথা কিসের মাথা একথা জানি না আর এমন এক নাম তার পছন্দই বা হল কেন তাই বা কে জানে। এ নামটিও বদলালাম না কারণ এ নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই কিছু, তবে এ লেখা লেখবার আগে একটু জানতে গেছিলাম, তাতে আমায় বললে- ‘ অ কাকিমা, এসব ছাড় তো, আগে বল পোগ্রামে আসছ তো বারো তারিখ?’ ও একটা কথা বলা হয় নি শুভম নৃত্যশিল্পী, সেই সুবাদেই কিনা জানি না ও কেমন দুলে দুলে চলে, কাঁধ পর্যন্ত চুল, পরনে হাফ প্যান্ট থাকলেও অঙ্গে অন্তত একটি গামছা ওর থাকবেই। সারা পাড়ার ছেলেরা যখন গরমে দাপিয়ে পুকুর দই করে ফেলে ও পাড়ে বসে অপেক্ষা করে ওদের ওঠার, না হলে ওর গামছা ধরে টান দেবে, ছেলেরা বলে ওকে ‘মন্দাকিনী’আর ও বলে ... ‘যাহ্‌’।উপকারী এই ছেলেটিকে সকলে বলে মেয়েলী, আমি কিন্তু কোন মেয়েকে এমন করে মেয়ের মুখোশ পরতে দেখি নি, ওর মেয়ে হবার ইচ্ছেটাই হয়ত এভাবে মেটায় মেয়ের মুখোশে।
প্রসঙ্গ যেদিকে যাচ্ছে তাতে মনে হতে পারে আমি বুঝি আজ এই বিতর্কিত বিষয় নিয়েই লিখতে বসেছি, একেবারেই তা নয়, আমি জানি আমার বিষয় ‘মুখোশ’ তবে হাতের কাছে এমন উদাহরণ দেবার লোভ সামলানো গেল না। যা লিখছি সবই অভিজ্ঞতা, কল্পনা নেই কোন, থাকলে হয়ত রসাস্বাদন আরও বেশী হত তবে আজ মুখোশে ঢাকব না কিছুই, এমনি ভেবে রেখেছি।

সম্প্রতি আমার এক নিকটাত্মীয়ের দেহান্ত ঘটেছে, এসব ক্ষেত্রে অকুস্থানে আমি যেতে চাই না কারণ চোখ আমার আছে যদিও তাতে জলের পরিমাণ কিছু কম, আর এসব ক্ষেত্রে তার কিছুটা খরচ করতেই হয়, তাই আমি এ ব্যাপারটায় আমার স্বামীর ওপরই বেশী ভরসা করি, তার মানে এই নয় উনি চাইলেই কেঁদে ভাসাতে পারেন, আসল কারণ ছেলেদের তত না কাঁদলেও চলে।এবার কিন্তু আমি বেশ বিপদেই পড়লাম কারণ আত্মীয় যিনি তিনি আমারই বেশী নিকট ছিলেন, নাম নিতে পারছি না কারণ তাঁরা সকলেই আমার লিস্টের শোভা বাড়াচ্ছেন, অবশ্য নামে কি আসে যায়? খবর পেয়ে যেতেই দেখি বাড়ি পাগলাগারদে পরিণত, ওনার স্ত্রী কাটা পাঁঠার মত ক’বার আছাড় খেয়ে অবিকল বাংলা সিরিয়ালের অনুকরণে মেয়েকে বলতে লাগলেন ‘ তোমার বাবা নেই নেই...’ বিবাহিত বড় মেয়েটি কপাল ঠুকে যে দাগ করেছে নামাজী মানুষও তা দেখে লজ্জা পাবেন, জীবিত মৃত এবং বাকী সকলের ওপর এই মৃত্যুর দায়িত্ব দিয়ে সে কিছুক্ষণের জন্য অচেতন হল, প্রসঙ্গত মৃত ব্যক্তি বিগত তিন বছর ধরে জটিল রোগে ভুগছিলেন এবং ডাক্তারের কথা অনুযায়ী গত ছয়মাসের মধ্যে যেকোনো দিন ওনার মৃত্যু হতে পারত। তবু প্রিয়জন যখনি চলে যায় তখনি স্মৃতির বইয়ের আয়তন বেড়ে বেদনার ভার বাড়ে, এ চিরসত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজীব গান্ধীর দেহ শনাক্ত করতে তার পরিবার এসেছিলেন কালো রোদচশমার আড়ালে চোখ ঢেকে, বহুলোক বলেছিল ‘সাদা চামড়ায় চোখের জল পড়ে না’। এখন বাঙালীর সবরকম অনুভূতি, অভিব্যক্তি জুড়ে সিরিয়ালের দাপট, সেখানে চোখের জলও কিছু বেশী ফেলতে হয় শোকে, না হলে টি আর পি বাড়ে না, আসল অনুভূতি থেকে যায় মুখোশের আড়ালে। এত কথার কারণ এই যে যখন চার দিন পর আবার ঐ বাড়িতে গেলাম দেখি পারলৌকিক কাজের জন্য পুরোহিত এসেছেন, সেই অচেতন হয়ে যাওয়া মেয়েটি ফোনে কার সঙ্গে অনুষ্ঠান বাড়ি ভাড়া নিয়ে দরাদরি করছে, জামাই কেটারিং এর লোকের সাথে ব্যস্ত, আর গৃহিণী মন দিয়ে টুকে নিচ্ছেন ষোড়শ দানের ফর্দ। ফল কেটে শরবত দিয়ে অতিথি আপ্যায়নেরও ত্রুটি নেই কোন, আজ যা নেই তা হল চোখের জল, থাকার কথাও নয় শোক কেউ চিরকাল চোখে নিয়ে বেড়াতে পারে না।

আর একটি ঘটনা বলে আজ শেষ করব, আমাদের পাড়ায় এক সামাজিক সংস্থা আছে যার আমি সভ্য, তারা একটি পত্রিকা বার করবে ঠিক করেছে, বিষয় ‘রবীন্দ্রনাথ’। শুভ উদ্যোগ সন্দেহ নেই,সকলে লেখা দিচ্ছে, আমি লিখতে পারি না তাই বাছাই করার কাজ আমার ওপর (আমি আমার কাগুজে নামে লিখি না এক বাঁচোয়া, তারা কেউ এই হাবিজাবি লেখার কথা জানে না)কারণ আমার বাড়িতে প্রচুর বই, যেগুলো নিশ্চয়ই আমি পড়ে থাকি তাই ভালো মন্দ লেখার কিছু অবশ্যই বুঝি( এ সবই তাদের মত)। সঙ্গীতা দি স্বাস্থ্যকর্মী, তিনতলা বাড়ি,এক কবিতা দিয়েছেন বারো লাইনের, রক্তদানের ওপর, উনি ওনার স্বামী ও নিউটন ওনার ছেলে কে ক’বার রক্ত দিয়েছেন তার হিসেব। বলা বাহুল্য ছাপা যাবে না, সে কথা জানতে পেরে মহা হইচই, ই সি মেম্বারের লেখা প্রাধিকার পাবে না কেন? অগত্যা তাকে অলঙ্কার পরানোর দায় নিলেন সম্পাদক এবং সাথে সাথেই চালান দিলেন আমার কাছে, পাঁচ সাতটা বই দেখে যেভাবে হোক মিলিয়ে গুলিয়ে দাঁড় করাতে হবে। যখন দাঁড়ালো তখন সেটি আর ওনার লেখা রইল না,সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মহাদান মায় রাখীবন্ধন দিয়ে ঢুকে কবিগুরুকেও একটু ছুঁইয়ে আনা গেল, কিন্তু তা দেখাতেই একগাল হেসে স্বীকার করলেন এইটিই বলতে চেয়েছিলেন আদতে, সম্পাদকের মুখও উজ্জ্বল...... দেখলাম মুখোশ মন্দ নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র