রিয়া চক্রবর্তী - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

রিয়া চক্রবর্তী

 


আমাদের মুখোশ বা মুখোশের আমরা 






মুখোশের কথা মনে পড়তেই আমার সব থেকে আগে যেটা মনে পড়ে তা হল একটি ইংরেজি সিনেমা “ V for Vandetta”। আরে না না এর জন্য ভাববেন না আমি সিনেমাটার গল্প শোনাতে বসেছি। মুখোশ নিয়ে লিখতে বসেছি আজ।ওই ইংরেজিতে যাকে বলে Mask.সেই কারণেই ওই সিনেমার কথা মনে হল।

বাংলায় মুখোশ শব্দটির বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় মুখাবরণ, নকল মুখ, কৃত্রিম মুখ বা কপটতা। সত্যিকারের চেহারা অদৃশ্য করে নানানরূপে নিজেকে মেলে ধরার জন্য যে সব উপাদান ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট রূপ ফোটানো হয়, তাই মুখোশ। মুখোশের আড়াল বলতে সাধারণত অস্বাভাবিক কোন আবরণের মাধ্যমে সত্যিকারের চেহারাটা লুকিয়ে ফেলা বোঝায়। সোজা কথায় মুখোশ বললেই যেটা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে তা হল মুখের সামনে মুখের আদলে গড়া কিছু, যা পড়লে মুখকে আড়াল করে মুখোশকে নিজের প্রধান চেহারারূপে সবার সামনে তুলে ধরা যায়। মুখের মতোই তার নাক, চোখ, কান ও ঠোঁট থাকে।
নানা রকমের ডিজাইনের মুখোশ হতে পারে, যেমন মানুষের মুখের পাশাপাশি পশুপাখি কিংবা কোনো পৌরাণিক, কাল্পনিক চরিত্রের রূপও নিতে পারে। আপনারা যারা ওই সিনেমা দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন পুরো সিনেমাটাই নায়ক মুখোশ পড়ে অভিনয় করে গেছেন।

পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশসহ আমাদের দেশেও লোকসংস্কৃতিতে মুখোশের এক অসামান্য ভূমিকা আছে। দক্ষিণ ভারতের কথাকলি নাচ যারা দেখেছেন তাঁরা বুঝবেন, ৩০০ বছরের প্রাচীন শাস্ত্রীয় নৃত্য কথাকলি যা ব্যালে, গীতিনাট্য, মুখোশ এবং মূকাভিনয়ের বিভিন্ন দিকগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে। নাচের ধারাগুলি হল- কুদিয়াট্টম, কৃষ্ণনাট্যম এবং কলারিপ্পায়াত্তু। কথাকলি নৃত্যের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের মহাকাব্য ও পুরাণের গাথাগুলির বর্ণনা করা হয়। কথাকলি নৃত্যের আড়ম্বর ও জাঁকজমকের অন্যতম কারণ হচ্ছে এর সাজ-সজ্জা, যার অঙ্গ হিসেবে থাকে কিরীটম বা বিশালাকার মস্তকাবরণী এবং কাঞ্চুকম বা অতি ঢিলাঢালা জামা এবং লম্বা ঘাঘরা যার নিচে থাকে তুলো গোঁজা মোটা গদি। চরিত্রটিকে এইভাবে সম্পূর্ণ রূপ দেবার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তব জীবনকে ছাপিয়ে একটি অতিমানবীয় রূপ দান করা।

বিভিন্ন রঙে রাঙানো মুখমণ্ডল-সহ কথাকলির পরিচ্ছদ অতি বিস্তৃত। বেশম বা মেক-আপের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়, যা মূলত পাঁচ রকমের – পাচা, কাথি, থাড়ি, কারি এবং মিনুক্কু। পাচা বা সবুজ মেক-আপ মহৎ চরিত্রকে চিত্রিত করে।কাথি মেকআপ ভিলেন চরিত্রকে চিত্রিত করে।দাড়িযুক্ত চরিত্রের জন্য মেকআপের তিনটি ধরন হয়।“ভেল্লা থাড়ি” বা সাদা দাড়ি, যা মহাবীর হনুমানের মতো অতি মানবীয় চরিত্রের জন্য।“চুভান্না থাড়ি” বা লাল দাড়ি, যা দুষ্ট চরিত্রের জন্য এবং “কারুথা থাড়ি” বা কালো দাড়ি, যা শিকারি চরিত্রের জন্য। কারি মেক-আপ রাক্ষসীর চরিত্র চিত্রিত করে।“মিনুক্কু মেকআপ” মহিলা ও ঋষিদের চরিত্রগুলির জন্য।অর্থাৎ এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কৃত্রিম রং দিয়ে মুখকে রাঙিয়ে মুখোশ এর সাহায্যে ভারতের একটি প্রাচীন ও বিখ্যাত নৃত্যের অন্যতম প্রধান শৈলী। আপনারা যারা এই নাচ দেখেছেন তারা নিশ্চয় মনে করতে পারছেন। আর তার সাথে অপূর্ব মুদ্রার ব্যাবহার।

আচ্ছা আপনারা ছৌ নাচ দেখেছেন? আজকাল সবার বাড়ীতে বসার ঘরে ছৌ নাচের একটি মুখোশ থাকা বোধহয় হাল ফ্যাশনের মধ্যেই পড়ে।মনকাড়া, আকর্ষণীয় বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র অনুসরণে তৈরি হয় ছৌ মুখোশ। কাগজের মণ্ড দিয়ে ছাঁচে ঢেলে মুখের আদল দেয়া হয়।তারপর মুকুট, চুমকি বসিয়ে সেটাকে উজ্জ্বল রূপ দেয়া। শাস্ত্রীয় ও লোকনৃত্যের ভাব গড়ে ওঠে এক অপূর্ব নৃত্য শৈলী আজ যা দেশে বিদেশে সমাদৃত । ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা, উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ ,এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলাই পীঠস্থান এই নাচের। যদিও সরাইকেলাকে ছৌ নাচের জন্মভূমি ধরা হয়।

সরাইকেলা,ময়ূরভঞ্জ,পুরুলিয়া কে ঘিরেই ছৌ নাচের জন্ম,ও বেড়ে ওঠা। ছৌ শব্দটির উৎস নিয়েও বিভিন্ন রকম মতভেদ আছে।তবু ও ধরা হয় ছৌ অর্থ ছায়া বা মুখোশ। কারও মতে ছাউনি। অনেকে আবার মনে করেন সৈন্যদের ছাউনি থেকে ছৌ শব্দের উৎপত্তি। তাছাড়া ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানে শিবের প্রার্থনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে মুখোশের ব্যবহার বর্ণনা করেছেন। কালীনৃত্যে কালো অবয়বে রক্ত-লালের জিহ্বা বানিয়ে, শিবের গাজন গাইতে বিভিন্ন দেব-দেবীর চেহারা অঙ্কিত করে মুখোশ বানিয়ে নাচ গান, খেমটা নাচ ইত্যাদিতে মুখোশের ব্যবহার দেখতে পাই আমরা। যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কল্পনা ও সৃজনশীলতার বিচিত্র প্রয়োগ। কখনও আবার প্রাচীনকালে শিকারের সময় অথবা বিবিধ ধর্ম বিশ্বাসের আচার-অনুষ্ঠানে চেহারায় আঁকিবুঁকি করার প্রচলনও মুখোশে মধ্যেই পড়ে। অর্থাৎ বিভিন্ন বই পড়ে আমরা জানতে পারি যে প্রাচীনকালেও দেশে,বিদেশে বিভিন্নভাবে মুখোশের ব্যবহার হতো, শিকারকে বশ করার জন্য, রণাঙ্গনে, কখনও পূজা-অর্চনায় ও ধর্মীয় কারণে, খেলায় আর উৎসবে।

আবার মুখোশ বললেই আরও একটা জিনিষ চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছবির মতো, তা হল মমি। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন কার্টুন আর সিনেমার দৌলতে আমরা সবাই ‘মমি’ শব্দটির সাথে পরিচিত।সম্প্রতি মমি নামে তিনটি ইংরেজি বিখ্যাত সিনেমার কথা আমরা অনেকেই জানি। আসলে মমি আমাদের মাথায় এমনভাবে গেঁথে গেছে যে মুখোশের নাম শুনলেই আগে মনে পড়ে মমি আর তার সাথে পিরামিড।

কোন ফারাও মারা গেলে সেই মৃতদেহ নানা প্রক্রিয়ায় শুদ্ধি করনের পরে দেহটিকে ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো শেষ হলে শরীরের বিভিন্ন অংশে শক্ত খাঁচা আর মাথার অংশে একটি মুখোশ পড়িয়ে দেওয়া হতো। মুখোশটি দেখতে হয় মৃতের মুখের মতো অথবা কোনো মিশরীয় দেবতার মুখের মতো হতো। অতএব এখানেও সেই মুখোশ।

পৃথিবীর প্রায় সব জাতির মধ্যেই মুখোশের প্রচলন থাকলেও তা কবে থেকে শুরু হয়েছিলো এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন নি। গ্রীসের জাতীয় পুরাতত্ত্ব জাদুঘরে রক্ষিত আছে ৩৭০০ বছরের পুরনো সোনার মুখোশ। মুখোশটির আবিষ্কর্তা হাইনরিখ সস্নিম্যান (১৮৭৬ সালে) মনে করেছিলেন, এটি বিখ্যাত গ্রীক রাজা আগামেনানের ডেথ মাস্ক বা মৃত্যু মুখোশ। কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা যায়, মুখোশটি আসলে আগামেনানের নয়। প্রায় ৪০০০ বছর আগেও মুখোশের প্রচলন ছিলো বলে কেউ কেউ দাবি করেন। তাদের মতে, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মেক্সিকো এসব এলাকার আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাদু ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মুখোশের ব্যবহার ছিলো।

এইবার আসি ভার্চুয়াল জগতে। আমরা যারা চ্যাটিং করি, ওপাশে যিনি আছেন তাকে দেখা যায় না, মোটামুটি ভৌতিক আলাপচারিতা বলাই যায়। যার সাথে কথা হচ্ছে তিনি পরিচিত কি আদৌ? না পরিচিত সবাই হয় না। যতটুকু পরিচয় তা এই ছদ্ম বা ফেসবুকিয় নামের সাথে। কত কথাই তো হয় সারাদিনে, আমরা কি আমাদের সব কথা বলি? তাহলে এটাকে আমরা আমাদের মুখোশ বলতেই পারি। এই ইন্টারনেট প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য গতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা ধীরে ধীরে একটা ভার্চুয়াল মুখোশে পরিণত হয়ে যাচ্ছি।

এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এর আগে কি আমরা মুখোশধারী ছিলাম না? তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এই সভ্য, ধোপদুরস্ত সমাজে আমরা কোন কালেই কি মুখোশহীন ছিলাম? যদি আমরা আমাদের বিবেকের কাছে সৎ থাকি তাহলে বলতেই হবে আমরা কোনোদিনই মুখোশ ছাড়া ছিলাম না। কোন কিছুকে ঢেকে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় আবরণের। সে আমাদের দেহের হোক বা মনের। এবং সমাজের সবার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের আশ্রয় নিতে হয় মিথ্যের। আর এই মিথ্যের মুখোশের আড়ালে আমরা লুকিয়ে রাখি আমাদের মুখকে। আমাদের এই মুখোশের আড়ালে মুখকে হয়তো একদিন আয়নাও চিনতে ভুল করবে আর সেইদিন আমরা সত্যই মুখোশ মানুষ হয়ে উঠবো। বিবেক হীন, হৃদয় হীন এক মুখোশ।


আসলে আমরা কোন অলীক মানুষ নই। জীবন একটাই, তাই যতটুকু পথ আমরা এই এক জীবনে পার হয়ে যেতে পারব, অন্তত সেই পথটুকু আমরা আত্মসম্মানের সাথে আত্মবিশ্বাসের সাথে দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখে এগিয়ে যেতে কি পারবো না? নিশ্চয় পারবো। অন্তত চেষ্টা তো করতেই পারি আমরা। সেই চলার পথে ভুল হোক না আমাদের। তবুও তো আমরা চিৎকার করে বলতে পারবো এই হলাম “আমার আমি” ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র