পিয়াল রায় - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

পিয়াল রায়




মুখোশের খেলা





শুয়ে শুয়ে মোবাইলটা নিয়ে ভাবছিল পাপিয়া কাকে ফোন করা যায় । সুমন্তকে করবে একবার ? না থাক , ও হয়ত কাজে ভীষণ ব্যস্ত এখন । হয়ত কোন জরুরি ক্লায়েন্ট মিটিঙে আছে । ঝাঁঝিয়ে উঠবে সবার সামনেই । যেন পাপিয়া ওর বউ নয় । ভয়ানক গরম পড়েছে । ছেলের স্কুল থেকে ফিরতে এখনও অনেক দেরি । এই ভরন্ত দুপুরটা পাপিয়ার একেবারেই নিজস্ব । এ সি চালানোটা একেবারেই পছন্দ করে না বলে জানলাটা খুলে দিল । ছোটবেলায় গলি দিয়ে কত ফেরিওয়ালা চলে যেত । মা , মাসিরা ডেকে নিয়ে দরদাম করে কিনে নিত গেরস্থালী জিনিশ । দুপুরগুলো চমৎকার গড়িয়ে যেত । আজকাল আর তেমনটা চোখেই পরে না । দিদিকে একবার ফোন করলে হয় অথবা মা কে । কতদিন মায়ের সাথে কথা হয় না । ভাগলপুরের বাড়িটায় চলে যাওয়ার পর যোগাযোগটাই যেন কমে এসেছে । ভাবতে ভাবতে রিং করে ফেলল যুগলকে । ছোটবেলার বন্ধুকেই বোধহয় এভাবে যখনতখন জ্বালাতন করা চলে ভেবে এক চিলতে হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোণে। ফোনের ওপাশে যুগল ," কিরে সুন্দরী এই ভরদুপুরে মনে পড়ল আমাকে তোর ? বর নিশ্চয়ই বাড়িতে নেই ? সাতদিন ধরে তোর আদর খাওয়াও হয় নি । আমার কথা সাতদিন পরে মনে পড়ল ? হায় রে পোড়া কপাল আমার " বলে তুমুল হাসতে থাকল । এই হল যুগল । মন ভাল করে দেওয়ার সব রকম দাওয়াই ওর কাছে চব্বিশ ঘণ্টাই মজুত । " বাজে বকিস না , ডাকলেই যেন কত এসে জুটবিরে ? অরুণিমার ভয়েই তো মরলি । বাববাহ বউ কে কেউ এত ভয় পায় তোকে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না ।" ' ডেকেই দেখনা একবার জানেমন , জান হাজির করে দেব । শুধু তোর খচরা বরটাকে একটু সামলে রাখিস তাহলেই হবে । " " এই এই এমন মার খাবি না । আমার বর একটুও খারাপ না । " খুনসুটি চলতে থাকে । মন খারাপের গুমোট কাটতে থাকে দুই বাল্যবন্ধুর হাসির ফোয়ারায় । " এই একবার দেখা করবি যুগল দুজনে ? ভাল্লাগছে না ঘরে থাকতে । হাত ধরে ঘুরব নাম না জানা দুপুরের রাস্তায় রাস্তায় ।" ভাবা যায়নি যুগল প্রস্তাবটা লুফে নেবে । দুপুরের রোদটাও যেন একপাক নেচে নিল পাপিয়ার খুশিতে ।

অনেকদিন পর কালরাতে একটু বৃষ্টি নেমেছিল । তাতে গরম আরও খানিকটা বেড়ে গেছে । অসহ্য গরমে গায়ে ফোস্কা পড়ে যাওয়ার জোগাড় । শাশুড়ির শরীরটা ভাল নেই । আবির বারবার ডাকছে । বউদি একবার অন্তত এস । এই সময়ে এত রাগ পুষে রেখ না । পাপিয়া ঠিক করেই রেখেছিল আজ যাবে একবার শাশুরিকে কে দেখতে । সেই মত সুমন্তকে বলেছিল গাড়িটা পাঠিয়ে দিতে । যথারীতি ভুলে গেছে । ট্যাক্সি নিয়ে নিলে তিরিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবে ভেবে রাস্তায় নামলো পাপিয়া । এত থইথই রোদ । পৃথিবীতে মানুষ বলে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হচ্ছে না । একটাও ট্যাক্সি চোখে পরছে না । উফ কি যে করে এখন ও । এই শাশুড়িই তাকে ঘর থেকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন । ছেলের আবার বিয়ে দিতে চান তিনি । এভাবে আত্মীয়স্বজন কে না জানিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়েকে মান্যতা দিতে রাজি ছিলেন না ভদ্রমহিলা । অশান্তির জেরে একসময় ঘর ছাড়তে হয়েছিল ওদের । দীর্ঘদিন কোন যোগাযোগ ছিল না । সুমন্তও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি ব্যাপারটা । আজ এতদিন পর আবার আবিরের ফোন । সুমন্ত যাবে না বলে দিয়েছে । একগুঁয়ে মানুষটাকে রাজি করানো যাবে না জেনেই আবির তাকে নিয়ে পড়েছে । যত জ্বালা পাপিয়ার । " তুমি এসেছ বউদি । জানতাম তুমি আসবেই । সব ভুলে যাও বউদি । ওসব আর মনে রেখ না । " ঘরে ঢুকে চমকে উঠলো পাপিয়া । খাটে যে মানুষটা শুয়ে আছে তাকে চেনা যাচ্ছে না কেন ? সেই ডাকসাইটে মহিলার একি দশা ? হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে যিনি বলতেন বউ তো নয় অলক্ষ্মী ঢুকেছে ঘরে এবং কাক চিল বসতে পারতো না ধারেকাছে সেই তিনিই মিশে রয়েছেন বিছানার সাথে ! বৃদ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে পাপিয়া ডাকল " মা শুনতে পাচ্ছেন ? এখন কেমন আছেন ? " শুকনো ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল অল্প । " কিছু বলবেন ? " দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখের কোনায় । " ডাক্তারের কি ব্যবস্থা করেছ আবির ? কে দেখছেন এখন ?" " আমার ক্ষমতা তো তুমি জানোই বউদি । পাড়ার জীবন ডাক্তার দেখছেন ।"
অহনাকে ফোন করে শাশুড়িকে রুবি তে ব্যাবস্থা করে দিয়ে , টাকাপয়সা সব সামলেসুমলে পাপিয়া রাস্তায় নেমে এল । আবির এল পেছন পেছন । " বউদি জানি দাদা মেনে নেবে না তবু একবার দাদাকে বোলো মা কে যেন দেখে যায় । হয়ত এই শেষ দেখা । " " এভাবে বলছ কেন ? আমরা চেষ্টা তো করছিই "
" তোমরা এভাবে চলে যাবে মা বোধহয় ভাবতেও পারে নি । দাদাকে ভালবাসতো তো খুব । কতবার বলেছি চল দাদার বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি । কিছুতেই রাজি হয় নি । সারা জীবন কষ্ট পেল । এই যে এমন অবস্থায় পর্যন্ত তোমাদের খবর দিতে দিচ্ছিল না । আমিই জোর করে ..." " খুব ভাল করেছ । আমি সুমন্তকে বলে দেখব । যদি আসে । তুমি তো তোমার দাদাকে চেনই ...কতদুর কি করতে পারব জানি না " " চল তোমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দি " ।

দুপুর রোদে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে সেদিন দুজনে অনেক কাছাকাছি যেন চলে এসেছিল । যুগল ওর হাতদুটো ধরে বলেছিল " তুই জানিস না পিয়া কত যন্ত্রণা লুকিয়ে হাসি সারাক্ষণ । অরুণিমা আমাদের সম্পর্কটাকে আর টিকিয়ে রাখতে চায় না । কি যে ওর চাওয়া আজ অব্দিও বুঝলাম না " ছেলেবেলার বন্ধুর কষ্টে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল পাপিয়ার । মনে পড়ছিল যেদিন সুমন্তর পার্স থেকে বেড়িয়ে ছিল পারমিতার ছবিটা ঠিক এমনিভাবেই ভেঙ্গে পড়েছিল সে । কাউকে বলতে পারেনি । যদি ঝড়ে খড়কুটো সুদ্ধ উড়ে যায় তুকাইকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবে সে ? অরুণিমা চাকরি করে । নতুন করে প্রেমে পড়ার সাহস রাখে , তার তেমন সঙ্গতি কই ? ভেঙ্গে পড়তে পড়তে যুগল আশ্রয় চেয়েছিল তার কাছে । যে নিজেই আশ্রয়ের খোঁজে ব্যাকুল সে কাউকে কাছে টানবে কোন ভরসায় ? দুদিন পরেই পাপিয়া দেখেছিল যুগল আর অরুনিমাকে নাম করা শপিং মল থেকে অনেক কেনাকাটা করে বেরিয়ে আসতে । অরুনিমার মুখে হাজার ওয়াটের আলোর ঝলমলানি । শাশুড়ি , সুমন্ত , যুগল , অরুনিমা , পারমিতা সবাই একটা করে রঙিন মুখোশ এঁটে রেখেছে । পাপিয়ার মনে হচ্ছিল শহরটা ক্রমশ মুখশের শহর হয়ে উঠছে । বাড়িঘর , সংসার , টুকিটাকি , রোদ , জল ,হাওয়া সবাই মুখোশে ঢেকে নিচ্ছে মুখ যার যেমন ক্ষমতা মাপ মত । তারও একটা মুখোশ চাই । ছেলের জন্যও নিতে হবে একটা ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকে পাপিয়া । প্রবল বৃষ্টিতে তখন শহর ভাসাতে থাকে আকাশ - কোন মুখোশ ছাড়াই ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র