জপমালা ঘোষরায় - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

জপমালা ঘোষরায়



মুখোশের এমুখ ওমুখ





সে বছর পয়লা বোশেখ সুদপুর গ্রামের আমবাগানের সান্ধ্য পিকনিকের দিন রান্নাবান্না সব হয়ে গেছে। আমরা অন্তত জনা ৪০ মানুষ একটা চাঁদোয়ার নীচে বনভোজনে বসব। এদিকে ওদিকে ডাইনে বাঁয়ে যখন তখন টুপটাপ আম পড়ছে ঝিরঝিরে হাওয়ায়। স্বাভাবিক আমধর্মেই আম্রপতন। আমি কিশোরীর মতো আম কুড়চ্ছি। অনেকেই যে যার মতো নস্টালজিয়া থেকে আমায়ন গাইছেন। হঠাৎ সবচেয়ে মিতবাক ও গম্ভীর মানুষটি, সত্তরের কবি দীপক সাহা একটা হনুমানের মুখোশ পরে জোড়া পায়ে হুপ হুপ লাফিয়ে পড়লেন এর ওর ঘাড়ের কাছে। আমি তো আঁতকে উঠেছি প্রায়। দীপক দা মুখোশ পরে লাফাচ্ছেন!! এটা কি মিরাকল হল!!! রূপক তাপসদের জিজ্ঞেস করতে ওরা হাসতে হাসতে বলল দীপকদা ইমেজ বদলাচ্ছে। মানে দীপকদার যে ভাবেবিভোর অনবরত পুঁথিপোড়ো ভাবান্বয়ী ভাবুকতা ছিল তার থেকে উনি বেরিয়ে আসতে চাইছেন? কিছুটা লঘু রসের কারবারি হতে চাইছেন? মুখোশ কি এই সূচনাটা করল? তাহলে কি ইমেজ বদলাতে মুখোশ ইতিবাচক ভূমিকায় আত্মবোধকে প্রাণিত করে?

‪আশির ‬ দশকের গোঁড়ায় যখন আমি স্কুল থেকে ফিরতাম, দেখতাম গোঁফদাড়ি সমন্বিত দীপকদা একটা ছোট্ট প্রেসঘরের খটাংখটাং হরফিয়ানার মধ্য বসে আছেন। আর চারিদিকে অজস্র কাগজকুচি ছড়ানো। শুনেছিলাম উনি কবিতা লেখেন আর ছিঁড়ে ফেলেন। একদিন দেখলাম কাগজকুচির মধ্যে একটা মুখোশ ছেঁড়া পড়ে আছে। সেদিন কিশোরীচোখে জরিপ করার চেষ্টা করেছি কবির আয়নামহল। পারিনি। আজ মনে হচ্ছে। কবিতায় কি কবির মুখের প্রতিফলন হয়? না কি কবিতা কবিকে ঢাকা দেওয়ার একটা মুখোশ? দীপক দা কী ছিঁড়ে ফেলতেন মুখ না মুখোশ? এখন কি উনি সব পাজল সাজিয়ে ফেলেছেন ?

মুখোশ বলতেই নেগেটিভ ধরে নেওয়ার কোন কারণ নেই। মুখোশের আয়োজনে অনেক আঞ্চলিক তিথপরবের আনন্দবার্তা থাকে। প্রায় সব আদি সভ্যতাতেই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দোৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে মুখোশের প্রচলন ছিল এটাই ঐতিহাসিক সত্য। মাটি ধাতবপাত অথবা বিশেষ একপ্রকার ঘাসের মন্ড দিয়েই মুখোশ বানানো হত। মুখোশ তাই এক ইতিবাচক মজার সাজ। যা সাময়িক ভাবে এক মুখকে অন্য মুখে রূপান্তরিত করে।
রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে ত্রিগুণাতীত অনাদি দেবতা শিব উপস্থাপিত হয়েছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন নিষ্কর্মা, খামখেয়ালি উচ্ছৃঙ্খল সঙ্গীদের সঙ্গে নেশা-ভাঙ এ অভ্যস্ত বহুরূপী রূপে। তিনি মুখোশ পরে সং সেজে ভিক্ষা করতেন। হরগৌরীর কোন্দল অংশে ভিখারী মুখোশধারী শিবের ভিক্ষাবৃত্তির বর্ণনা ও জনসাধারণ এর হেনস্থার মধ্যে আমি কোন হিউমার পাইনি। বরং করুণা হয়েছে। একটু উদ্ধৃতি দিলাম।

‪‎দূর‬ হৈতে শোনা যায় মহেশের সিঙ্গা।
শিব এল বলে ধায় যত রঙ্গচিঙ্গা।।
কেহ বলে ওই এল শিব বুড়া কাপ।
কেহ বলে বুড়াটি খেলাও দেখি সাপ।।
কেহ বলে জটা হৈতে বার কর জল।
কেহ বলে জ্বালো দেখি কপালে অনল
কেহ বলে নাচ দেখি গাল বাজাইয়া।
কেহ দেয় ছাই মাটি গায়ে ফেলাইয়া।।

এহল মুখোশধারী ভিখারীর দুর্গতি। আবার আপনি ইতিবাচক ধারক ও হতে পারেন। মনে করুন আপনার নিজেকে খুব ভারী ডানার উটপাখি মনে হচ্ছে। উড়ুক্কু উড়ানবাসনাকে ফর্মালিনে ডুবিয়ে দিয়ে ফাটা ডিমে তা দিচ্ছেন। মনস্তাপেও আর জোড়া লাগছে না তখন আয়নার সামনে মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে একবার বলুন - " জিংগা লা লা হুউউউ......" দেখুন নিজেকে হালকা মনে হবে। সুতরাং মুখ যতদিন থাকবে মুখোশ ও থাকবে।
যতক্ষণ মুখোশ মানে শুধুই মজারু মুখাবরণ ততক্ষণ কোন সমস্যা নেই। কিন্তু যখন ই মুখোশ নিজস্ব প্রতীকধর্মীতায় এ আমির নেতিবাচক আবরণ হয়ে উঠল সমস্যাটা তখন থেকে শুরু হল। মুখ মানে একটি মুখ একটি নাক দুটি চোখ কপোল-কপাল চিবুক নয়। মুখ মানে মানুষের আচরণ। শিষ্ট ও সামাজিক মানুষ সবসময় সব আকরিক আচরণ প্রকাশ করে না বা করতে পারে না। তার মুখ বা আচরণের ওপর একটা আবরণ রাখে। অর্থাৎ শিষ্ট মানুষের ঘরে মুখ, বাইরে মুখোশ থাকেই। এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু এই প্রতীকী মুখোশের ও নেতিবাচক দিক আছে। যাদের আসল মুখ বা আচরণ শয়তানের এবং বাইরের পোশাক টা সাদা এমন কি জুতোটাও সাদা। পরিবর্তিত অর্থে আমরা তাকেই মুখোশধারী মানুষ বলি এখন। এদের মুখোশের তলার মুখে দগদগে ঘা। কখনো২ মুখোশের নাসাছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসে উন্মত্ত বিষ নিঃশ্বাস। শোষক বুঝতে ই পারে না কখন তার মুখোশ ছিঁড়ে তাকে বীয়রউল্ফ এর মতো লাগে।

 মুখোশ ব্যাপারটা অন্য এক মাত্রায় ধরা দিল, যেদিন বাবাকেও দেখলাম মুখোশ পরা। আমার ছোট্ট মেয়ে বারবার জিজ্ঞেস করছিল ওটা কি পরানো আছে। ICU এর ভিতর বাবার যীশুমুখে মুখোশ পরানো। আমরা অনেক দূর থেকে দেখছি। মনে হল বাবা কিছু বলতে চাইছেন।বাবার চওড়া কাঁধের ওপর সবসময় একটা উত্তরীয় থাকত। সেটা এখন নেই। একটু পরই সেই উত্তরীয় লম্বা হতে হতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নেমে মেঘের মতো ছেয়ে ফেলল হাসপাতাল চত্বর। এক প্রকাণ্ড মুখ যেন ঢেকে দিল অজস্র ছোট ছোট মুখোশ। বাবা চলে গেলেন। এই চলে যাওয়া কি মুখ রেখে মুখোশের চলে যাওয়া না কি মুখোশ রেখে মুখের চলে যাওয়া সে অনুভব যার যার তার তার। বাবা ছোটবেলায় আমাদের তিন ভাইবোনকে জোকার এর মুখোশ কিনে দিয়েছিলেন। মনে আছে আমরা সারাদিন 'মেরা নাম জোকার' এর গান গেয়ে বেরিয়ে হয়রান হয়ে গেছিলাম।

চেতনার খাদ্যকণায় ঘাই মারছে আধা হকিকত আধা ফসানা অর্ধেক মুখ অর্ধেক মুখোশ। এবার চিনে নিতেই হবে নিজের সঙ্গে সকলকে। কংকালের মুখোশ খুলে মানুষের ২০৬ অস্থি গুণে নিচ্ছি। কিন্তু মানুষের অস্তি কতগুলো গুনেছি কি? কত ধানে কত চাল কত মুখে কত মুখোশ এ সব সমীক্ষার বিষয়। জোকারের তলায় আর কোন জোক নেই যখন, বাঘের তলায় বাঘ নাও থাকতে পারে এই ভিন্নমুখী প্রত্যয়ে আমি যখন সার্চ এ ক্লিক করলাম তখন দেখলাম মুখ ও নেই মুখোশ ও নেই। কবন্ধ বিগ্রহ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র