রৌপ্য রায় - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

রৌপ্য রায়

এই প্রথমবার মায়াজম ব্লগে শুরু হচ্ছে ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস  



 সোমবারের বিজ্ঞাপন 





১- 

মিল্কি তার ইজি চেয়ারে দোল খাচ্ছে দেখেই বুঝেছি নিশ্চয় কোন গভীর চিন্তায় ডুবে আছে । যেকোন মুহূর্তে বিতর্কের ঝড় উঠতে পারে । আমার সার্পোটার দরকার । দোতলায় উঠে ক্যাপ্টেনকে ডাকে আনলুম । আজ বেশ গরম পড়েছে । বাইরে যাবার ও তেমন ইচ্ছে কারোর নেই । মিল্কি আচমকা দোল খাওয়া চেয়ার থামিয়ে বলল - - ' ক্যাপ্টেন দৈনন্দিন বৈকালের পেপারটা দাও তো । ' - ক্যাপ্টেন সদ্য দিয়ে যাওয়া পেপারটা তুলে এনে মিল্কির হাতে দিল । মিল্কি পেপারটা হাতে নিয়ে আবার চেয়ারে গা এলিয়ে দোল খেতে লাগল । আমি কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললুম - - ' ভগবান আজ তাহলে বাঁচা গেল । ' ক্যাপ্টেন গুটিগুটি পায়ে দোতলায় চলে গেল । আমি আর কি করি , হাতের সামনে পড়ে থাকা সকালের পেপার টা নিয়ে মুখের সামনে সবে মেলে ধরবো অমনি মিল্কি কটাক্ষ করে বলল - ' কি পড়ছ দা ? ধর্ষণ না রাজনীতি ! '
আমি বললুম - ' কিছু না । '
' তাহলে নিশ্চয় -পাত্র পাত্রী বিজ্ঞাপন । '
' পাত্র পাত্রী বিজ্ঞাপন পড়তে যাব কেন শুনি ? '
' তোমার যে এখন ও বিয়ে হয়নি তাই হয়ত মেয়ে পছন্দ করছ , বলা তো যায় না । ' - বলে মিল্কি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একটা মুচকি হাসল । আমি সকালের পেপারটা টেবিলে ছুড়ে দিলুম ।
অমনি মিল্কি বলল - ' কি রাগ হচ্ছে বুঝি ? '
' রাগ হবে না কেন ? '
' আরে সকালের খবরের পাতায় কি আর থাকে ? দু'চারটে ধর্ষণ, খুন, রাজনীতি , আর পাতায় ভরা পাত্র চাই আর পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন । '
' হুম কি যে বলিস । '
' হ্যাঁ রে দা , যদি ও আরো কটা বিজ্ঞাপন থাকে সে ও কোন কাজের না । যদি কোন ভালো খবর ও বিজ্ঞাপন থাকে সে পাবে বৈকালের খবরে । '
আমি ও অতি সহজে ছাড়ার পাত্র নই তাই আমি ও কটাক্ষ করে বললুম - ' তুই কি বিজ্ঞাপন নিয়ে ধুয়ে খাবি না গায়ে মাখবি শুনি? '
' আরে খাবো ও না গায়ে মাখবো ও না তবে পড়ে তো একটু মজা পাওয়া যায় নাকি ! এই দেখ না , এই একটা বিজ্ঞাপন । '' -- বলে দৈনন্দিন বৈকালিক পেপার আমার দিকে এগিয়ে দিল । আমি পেপারটা নিয়ে পড়তে লাগলুম । বিজ্ঞাপন টা ঠিক এইরকম ...

" পরামর্শ চাই "

" পরামর্শ চাই । জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তি যোগাযোগ করুন । সঠিক পরামর্শ দাতাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হবে ।
যোগাযোগ -ভিন্ন ব্যানার্জী
গ্রাম -ব্যানার্জী পাড়া
পোষ্ট ও থানা - জয়নগর "

বিজ্ঞাপন পড়ে একটু হাসি পেল । আজকাল কেউ পরামর্শর জন্য বিজ্ঞাপন দেয় নাকি ?
মিল্কি বলল - ' বিজ্ঞাপন দেয় না ঠিকই । তবে নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য আছে , না হলে কেউ গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে প্রতি সোমবার দৈনন্দিন বৈকালে ইচ্ছে এমন বিজ্ঞাপন দেয় । '
' তা নই বুঝলুম কিন্তু ব্যপারটা কী ? '
' তা জেনে আমাদের কোন লাভ নেই দা '
' কেন রে ? '
' আমরা তো জ্ঞানী ও পণ্ডিত নই তাই '
' কে এ এ . . . '
কথাটা আর শেষ হল না সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দ । ঘাড় বাঁকিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন নামছে । নেমেই সটান করে সোফায় বেসে একটা কবিতা বলে ফেলল --
" পূবের কোণ আঁধার জাগে ,
সূর্য্যি গেছে পটে ।
এবার চলো হাওয়া খেতে ,
ছোট নদীর ঘাটে । "
সত্যি , সময় হয়েছে । সূর্য এবার নিদ্রায় যাবে । জানালার পাশে দাঁড়াতে হালকা ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা গেল । আজ মন না চাইলে ও নদীঘাটে হাওয়া খেতে যেতে হবে । ক্যাপ্টেনের মর্জি বলে কথা । মিল্কি চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল - ' চলো , তাহলে ওঠা যাক । '
আমি আর ক্যাপ্টেন সম্মতি দিলুম । মিল্কি টেবিল থেকে তার থলে কাঁধে নিতে আমরা রওনা হলুম ।।
৮৮
সন্ধ্যার মন-মুগ্ধ হাওয়ায় যখন তেলে ভাজা খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে তখন গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে আটটার ঘণ্টা পড়ল । মিনিট দুই পরে সুমধুর কণ্ঠে মসজিদের আজান শোনা গেল । মিনিট পাঁচেক পরে আমরা বাড়ি ফিরলাম ।বাড়ি ফিরে দেখি সোফায় এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি বসে আছেন । গায়ে সাদা ফুলহাতা সার্ট তার উপরে ব্ল্যাক কোট , গলায় ব্ল্যাক টাই , আর ব্ল্যাক প্যান্ট ।লম্বা ছয় ফিটের কাছাকাছি গায়ের রং গোরা । দেখে মনে হচ্ছে অফিস থেকে সোজা এখানে এসেছেন । আমাদের দেখে মধ্যবয়সী ব্যক্তিটি উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানিয়ে বললেন - - ' আমি ভিন্ন ব্যানার্জী । আপনাদের মধ্যে একলব্য সিংহ রায় কে যদি ব-লে-ন ?
আমি মিল্কির দিকে আঙ্গুল তুলে বললুম - ইনি হলেন একলব্য সিংহ রায়
ভিন্ন ব্যানার্জী মিল্কির দিকে তাকিয়ে আপদ মস্তক দেখলেন ' ৫ ফুট লম্বা পরনে সাদা পাঞ্জাবী, টাওজার আর কাঁধে থলে। ভিন্ন বাবু দেখে বোধয় একটু ইতস্তত বোধ করছিল । এত সর্ট হাইটের ব্যক্তি গোয়েন্দা । মিল্কি তার রহস্যময় চোখে ভিন্নবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল -
হ্যাঁ ! কি ব্যাপার বলুন ?
পাশের ঘর থেকে পচা চার পেয়ালা চা আর বিস্কুট নিয়ে এল । চায়ের টেবিলে রেখে পচা বলল - দাদাবাবু ! - ইনি আপনাকে খুঁজছিলেন । আমি ওনাকে . . .
মিল্কি বলল - থাক ! আর বলতে হবে না বুঝে গেছি , হ্যাঁ ভিন্ন বাবু !
পেপারে বিজ্ঞাপন দিতে দিতে স্বয়ং আমার বাড়িতে পদার্পণ ! আমি তো তেমন জ্ঞানীগুণী ব্যাক্তি নই ।
ভিন্ন বাবু লজ্জিত ভাবে বললেন - প্লিজ ! আপনি এভাবে বলবেন না । আপনি স্বনামধন্য গোয়েন্দা আপনার বুদ্ধি যথেষ্ট তীক্ষ্ণ । যাইহোক বিজ্ঞাপনটা তাহলে আপনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে ।
- অবশ্য ! একটু খোলসা করে বলবেন ব্যপার টা . . . । '
বিজ্ঞাপন নিয়ে বেশ কিছু দিন কেটেছে তেমন কোন আশানুরূপ ফল পাইনি ।কিন্তু আজ বৈকালে বিজ্ঞাপনের দরুন বিশেষ একজন জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে দেখা হয়েছিল , নাম প্রফেসার সুবীরেশ ভট্টাচার্য । কোন কলেজের
প্রফেসার ঠিক মনে পড়ছে না । দেখতে যেমন ফরসা তেমন লম্বা , সুশ্রী মুখমণ্ডল । চমৎকার কথা বলেন । সত্যি বলতে একেবারে মাটির মানুষ । যাইহোক উনি তার মতামতে বললেন -এ বিষয়ে এমন ভাবে ডিসকাস করা উচিত নয় । পরে আপনাদের ক্ষতি হতে পারে।
সুবীরেশ বাবু উনিশবিশ ভেবে শেষমেশ আপনার ঠিকানা দিয়ে বললেন আপনি এখন ডায়মন্ড হারবারে আছেন । আপনি আমার শেষ অবলম্বন বলে ভিন্ন বাবু তার চোখ থেকে চশমা নামিয়ে মুছতে লাগলেন ।
' আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবো । কিন্তু তবে আপনি কোন বিষয়ে- '' পরামর্শ চাই " বলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলেন এবং কেন ? '
ভিন্নবাবু একটু হতাশ হয়ে বললেন - সেটা বলার জন্য তো আমার এতদূর আসা ।
আমরা ওনার কথা সম্মতি জানালাম । মিল্কি তার ভুল এড়িয়ে ছল করে বলল -
হ্যাঁ. . . ! সে তো অবশ্যই । দয়া করে য-দি এবার বিজ্ঞাপনের কারণ টা বলেন!
ভিন্নবাবু চায়ে কাপে চুমুক দিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন - আমার পিতামহ শ্রীজ্ঞানেন্দ্র ব্যানাজী । নামে যেমন জ্ঞান কাজকর্মে তেমন জ্ঞান । বিশ্বের সবচেয়ে নিখুঁত কৃপণ যাকে বলে উনি ঠিক তাই ছিলেন । খিটখিটে বদ মেজাজি তবে চরিত্রের কোন ত্রুটি ছিল না । আমার পিতামহীর কথা শুনে মাঝে মধ্যে মনে হয় স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্র মহাশয় কূটনীতি বিদ্যায় পি.এইচ .ডি করে ছিলেন! পিতামহীর কাছে যেটুকু শুনেছি । পিতামহের চরিত্রের এমন বিশেষত্বে খুশি হয়ে জমিদার হরিনারায়ণ ওনাকে খাজনাদার পদে নিযূক্ত করেন । কেমন কায়দায় অতি সহজে খাজনা আদায় করা যায় পিতাময় তা ভালো করে জানতেন ।তবে পিতামহ গ্রামবাসীদের কোন অনিষ্ট করেন নি । মহাশয়ের কাজে খুশি হয়ে জমিদার প্রায় সময় উপহার দিতেন । এমন ভাবেই কিছু দিনের মধ্যে জ্ঞানেন্দ্র ব্যানার্জী সমাজে বেশ ধনী ব্যক্তিতে তে পরিণত হন । পিতামহ একদিকে যেমন জটিল প্রকৃতির তেমন অপর দিকে ধার্মিক । দিনে অন্তত ঘন্টাদুয়েক পূজা করতেন । তবে কথায় আছে সবার কপালে সুখ সহ্য হয় না ।
আমি কথা টা শুনে আতঁকে উঠে বললাম - মানে ?
ভিন্নবাবু বললেন - একটু স্থির হন ! মানে আমি বলছি ।
' আচ্ছা বলুন । '
' সব ঠিকঠাক চলছিল । হঠাত্‍ দেশের সর্বত্র কৃষক আন্দলোন শুরু হোল । তাতে জমিদার হরিনারায়ণ ও বাদ পড়লেন না । পিতামহ প্রচন্ড ধূর্ত । তিনি আগেভাগে ব্যপারটা আচঁ করতে পেরে ছিলেন । তাই তিনি নিজের উপর যে কোন মুহূর্তে আক্রমণ হতে পারে ভেবে সমস্ত সম্পতি সিন্দুকে রেখে তালা বন্দি করে রাতারাতি লুকিয়ে রাখেন । সেই দিনই রাতে বাড়িতে ডাকাত পড়ে । ডাকাতের হাতে তিনি মারা পড়েন কিন্তু সম্পত্তি বিষয়ে মুখ খোলেন নি । সেই সম্পত্তি আমাদের কাছে আজ ও অজানা । বাবার বয়স এখন আশি ছোঁয় ছোঁয় । বাবা পৈত্রিক সম্পত্তি অনেক খুঁজেছেন এমন কি গোয়েন্দা ডেকে খুঁজিয়েছেন ।কিন্তু কোন
হদিশ পান নি । শেষমেশ বাবা সম্পতির আশা ছেড়ে দেন । এরপর বাড়ি ভেঙে বাড়ি হয়েছে । বিশাল এলাকা জুড়ে পুকুর কাটানো হয়েছে । বাড়ির পিছনাংশে চাষবাস করা হয় কিন্তু কখন কারোর চোখে তেমন সন্দেহ জনক কিছু পড়েনি ।বাবা সম্পত্তি বিষয়ক কখনও কিছু বলেন নি। পিতামহীর মৃত্যুর মাস চারেক আগে পিতামহের সম্পত্তির বিষয় আমাকে সমস্ত কিছু বলে যান ।শেষে আমি চেষ্টা করি যদি হদিশ পাওয়া যায় । আমার বোধগম্যের বাইরে ভেবে আমি তাই প্রতি সোমবার ' দৈনন্দিন বৈকাল ' পেপার বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করি । এরপর বাকীটা তো আপনারা জানেন । '
মিল্কি তাই ইজি চেয়ারে দোল খেতে খেতে সমস্ত ব্যপার টা এক মনে শুনলো ।হঠাত্‍ দোল থামিয়ে বলল - আপনার ফোন নম্বটা দিয়ে যান । আগামী কাল সকালে ফোন করলে স্টশানে নিতে আসবেন ।
ভিন্ন বাবু ঘার নেড়ে আচ্ছা বলে পেপারের উপরে সাদা জায়গায় ওনার ফোন নম্বর লিখে বললেন - নমস্কার ! আজ তাহলে উঠি ।
মিল্কি ও নমস্কার জানিয়ে বিদায় দিলো । ভিন্ন বাবু যাওয়ার পথে হঠাত্‍
দাঁড়িয়ে বলল - ও হ্যাঁ আপনার পারিশ্রমিক !
মিল্কি বলল - সমাধান হলে পারিশ্রমিক লাগে না হলে নয় ।

চলে গেলেন । মিল্কি পচাকে ডাক দিলো - পচা ! ও পচা . . . । পচা আসতে বলল-এক কাপ চা দিলে ভালো হয় ।পচা আজ্ঞে বলে চলে গেল ।আমি আর ক্যাপ্টেন মুখ চাওয়াচায়ি করে বললাম - মিল্কি ব্যাপর টা কিছু বুঝলি ।মিল্কি স্টেটকাট বলে দিলো - এখন না রাতে বললো । মিনিট পাঁচেক পরে পচা চা নিয়ে এলো । মিল্কি চা নিয়ে সোজা লাইব্রেরীতে চলে গেল । কিন্তু রাতে মিল্কি কিছুই বলল না ।

** ক্রমশ চলবে --- 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র