রুখসানা কাজল - মায়াজম

Breaking

৫ জুন, ২০১৫

রুখসানা কাজল

পুরুষ ( মুখোশ ) 






গড়াই নদীর এপারে এসে দাঁড়ায় ইয়াসমিন । নদী আর সেরকম জলভরা নেই। কুড়ি বছর আগেও নদীর বুকে চর দেখেছিল ওরা। সেই চর এখন ব্যাপক হয়েছে। নৌকা চলছে থেমে থেমে। জেগেউঠা চরের গায়ে গোত্তা দিয়ে লগি ঠেলে যেতে হচ্ছে। খেয়া মাঝিরা আগের মতই ব্যস্ত। ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছে নৌকায়। নিজের ভেতর প্রবল এক ডাক শুনতে পায় সে। কয়েক পা পেছনে হেঁটে সহকর্মীকে বলে, ওপারে যাই চল। ফিল্মফেয়ার পত্রিকা ফেলে সহকর্মীটি সোৎসাহে বলে উঠে, টেগোরস কুঠিবাড়ি । ওয়াও চলো---
থ্রি কোয়ার্টার ঢোলা জিন্স, ফুলহাতা শার্ট আর গলায় ঝুলানো শ্যালে নিয়ে লাফিয়ে নামে বন্ধু সহকর্মী অন্তরা। । গাড়ি কি যাবে? ইয়াসমিনের ইচ্ছা নৌকায় যায়। ঠিক কুড়ি বছর আগের মত। অন্তরা কুর্ণিশ করে । জো হুকুম স্যাডি কুইন। ড্রাইভারকে কুঠিবাড়ির সামনে যেতে বলে ঘণ্টা পিছু নৌকা ভাড়া করে ইয়াসমিন। নৌকার পাটাতনে আরাম করে বসে অন্তরা বাচ্চা মাঝিকে বলে, ডিয়ার ভাইয়া মাঝি একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিও কেমন। বহুদিন নদী দেখিনা।
অল্পবয়সী মাঝিটি বাতাসে লুঙ্গী সামলে লগি চালাতে থাকে চর বাঁচিয়ে । অন্তরা এই মাঝিকে বকাবে। যা খুশী করুক। স্মৃতি মগ্নতায় বিভোর ইয়াসমিন । বিশ বছর আগে এরকম এক কিশোর মাঝি তাদের নিয়ে এসেছিল এপারে । গড়াই তখনো এভাবে মরেনি। সেই নৌকায় সুমিত ছিল। ইয়াসমিন পরেছিল নতুন পাওয়া শাড়ি। বাতাসে হলুদ অর্গান্ডি ফুলে ফেঁপে উঠছিল । শাখা পলা হাতে শাড়ি সামলাতে সামলাতে ইয়াসমিন দেখেছিল ভারী চশমার আড়ালে সুমিতের চোখে যুদ্ধ জয়ের উল্লাস। ওর সিঁথি জুড়ে সিঁদুরের লাল বিছানায় ছোট্ট এক রুপার টিকলি। এই সিঁদুর পরা নিয়েই সেদিনের সকালে সুমিতের ভাই ভাবি রাগারাগি করেছে। “তোমরা তো চলে যাবে। পাড়ার লোক যখন আমাদের বলবে আপনার ভাই কি হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছে তখন কি বলব? বলব যে আমার ভাই নাস্তিক?” সুমিত তেরিয়া হয়ে ভাইভাবীকে বলেছিল, হ্যাঁ বলে দিবেন আমি নাস্তিক ।” তখনকার ইয়াসমিনের কাছে সুমিতের সকল ইচ্ছা ছিল স্বপ্নাদেশের মত। কৃষ্ণনাম জপার মত সে কেবল জপে যেত , সুমিত সুমিত।


অন্তয়া জমিয়ে নিয়েছে মাঝির সাথে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জানতে চায় , ডার্লিং তুমিও কি মাঝি হইয়া থাকবা ?” ছেলেটি লাজুক হেসে বলে “না আমি পুলিশ নালি আর্মিতে যামু।’ এক চোখ ছোট করে অবাক হয়ে অন্তরা বলে, “সেকি! ডাক্তার হইবা না , ইঞ্জিনিয়ার হইবা না, আর্মি যাইবা । মাস্টারও হইতে পারতা” চরের বুকে লগি চেপে ছেলেটি জানায়, “আমাদের বড় অভাব।” চুপ করে যায় অন্তরা। সিগারেটের ধোঁয়ায় গড়াইয়ের হলুদ বুক ঝাপসা হয়ে আসে। খণ্ড খণ্ড চরের বুকে দু একটি রুপালি বালু রোদ্দুরে ঝিকিয়ে উঠছে। ওদের কি অভাব ছিল? নিজের ফ্ল্যাট, গাড়ি, বাবার মোটা মাইনের ভাল চাকরি, স্বচ্ছল সুন্দর আত্মীয় স্বজন। তাহলে?
একটি উড়ন্ত প্লেট ওর মায়ের পায়ের কাছে পড়ে ভেঙ্গে যায়। পা চেপে বসে পড়ে মা। এক টুকরো শব্দ বেরোয় না মার মুখ থেকে। কিশোরী অন্তরা পর্দার আড়ালে ভয়ে চুপসে কাঁপছে । ভাইটা ছুটে আসে। “মা মা , তোমার লেগেনি ত ?” আর পরমুহুর্তে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবার গায়ে। বাবাও দুহাতে ছোট্ট শরীরটাকে তুলে ছুঁড়ে দেয় মার দিকে। ভাইয়ের দু চোখে আগুন। বাবার চোখেও আগুন। আহ্‌ নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়ে অন্তরা। বহু উঁচুতে দুটি চিল উড়ছে । এই মরা নদিতে কি মাছ আছে? হয়ত আছে। মাছেদের খুব কষ্ট হচ্ছে। ওদেরও বড় অভাব। জল,স্রোত আর শ্যাওলার অভাবে বালুচাপা হয়ে আছে মাছেদের সংসার। ভাইটা মরে গেছে বাতাসের অভাবে! বুক চেপে ধরে ও । বুকের ভেতর এত চর এক ফোঁটা জল নেই যে কান্না আসবে।


 ইয়াসমিন খুলে ফেলে হাইহিল। কেমন উষ্ণ বালু। পা আরো গভীরে ডুবিয়ে দিলে জমে থাকা নরম কোমল ঠাণ্ডায় ডুবে যাবে পা। সেই ঠাণ্ডা শরীরে কাঁপন আনে অনাস্বাদিত আদরেরা । সত্যি কি অনাস্বাদিত ? বিশ বছর আগে কুঠি বাড়ীর পেছনে কিছুদূর গিয়ে ওরা পদ্মা নদীকে পেয়েছিল। অস্পর্শ মায়া ফেলে ছড়িয়ে আছে পদ্মার চর। দূরে বা আশেপাশে কিছু দীর্ঘ শনঝোঁপ ছাড়া কিছু নেই। ধাঁ ধাঁ নির্জন সাদা দুপুর। সেই চরে সুমিত ওকে নিয়েছিল। কি লজ্জা! নদী দেখল, আকাশ দেখল, দূরের শণবন মাথা দুলিয়ে হাসল । দু হাতে চোখ ঢেকে খুব আড়ষ্টভাবে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিল ও। সুমিত স্পষ্ট বিরক্ত হয়ে বলেছিল, এই সব ন্যাকামি ভাল লাগে না। এখানে কে দেখছে ?” সুমিত কি জানে, নির্জনতারও নিবিড় ঘন দৃষ্টি আছে! কবিতা যখন লিখে তখন নিশ্চয় জানে নারীর শরীর কিছু আড়াল চায়। বৃক্ষের অথবা পাতার , ছায়ার কিম্বা অন্ধকারের। অনেক পরে ইয়াসমিন বুঝেছিল কবি মানেই কেবল কবিতার সাথে সম্পর্ক, বাদবাকি অতি সাধারণ কবিরা। তারাও বউ পেটায় । সন্তানকে বঞ্চিত করে। কবিতাকে মুখোশ করে ঢেকে রাখে নিজেদের সাধারণ চেহারা।
অন্তরা চলে যায় গাইডকে সাথে নিয়ে। ইয়াসমিন কুঠিবাড়ির আশেপাশে ঘুরে ঘুরে চেনা গাছগুলোকে খুঁজে বেড়ায়। আমগাছটা তেমন আছে। এখানে একটি ছবি তুলেছিল সুমিত। দুই ডালের মাঝখানে সোফার মত উঁচু জায়গাতে ইয়াসমিন পুতুলের মত বসেছিল। অনেক কিছুই তার চেনা জানা। জীবন্ত হয়ে উঠছে সব স্মৃতি। সুমিত কি ওর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে কখনো ঘুরে গেছে শিলাইদহ ? পদ্মার চরে সেই মেয়েটি কি নিঃসংকোচ ছিল শরীর দেওয়া নেওয়ায় ? জ্বালা করে উঠে চোখ। “বুঝলে বস্‌ হেভভি চুজি ছিল তোমার রবীন্দ্রনাথ। এই গণ্ডগ্রামে বাথটব, কমোড, টেনিসকোর্ট ভাবা যায়।” অন্তরার ফর্সা মুখ লাল। সুমিতের মুখেও রক্ত জমেছিল রোদ্দুরে। আঁচল দিয়ে ঢেকে দিতেই শক্ত চোয়ালে বলেছিল, আমি লিপস্টিক নই, রাখো এসব লাল্টুপানা।”
বারান্দার ছায়ায় মাথা গুঁজে শুয়ে পড়ে অন্তরা। মাথার ভেতর মার মুখ। ডিভোর্সের কাগজে সই দিয়ে মা জানায় কিছুই চাই না কেবল ছেলেমেয়ে ছাড়া। মেঝ চাচার গুলশানের বাসায় শেয়ালের মত হেসে বাবা বলেছিল ওরকম ছেলেমেয়ে বছরে কয়েক বার জন্ম দিতে পারে সে। দরকার নেই ছেলেমেয়ের। আর কি আশ্চর্য মুহূর্তে বাবা লোকটা হয়ে গেল একটি স্পার্ম ব্যাংক। ক্ষারিত জমি হয়ে অন্তরা বহুবার বহু পুরুষের ভল্ট খুলে উচ্ছন্নে দিয়েছে স্পার্মগুলো। দেখেছে মায়া নয় বরং পুরুষের ভল্ট ভরে উঠে ভোগের আনন্দে।


 হঠাত মুখ ফিরিয়ে অন্তরা বলে, “বস্‌, আজ নাকি পূর্ণিমা । রাতটা থেকে যাই না কেন এখানে?” অবাক হয় ইয়াসমিন। “কিন্তু থাকবি কোথায়?” সহজেই মিটিয়ে ফেলে সমস্যা। “রাতটা মাইক্রোতে থাকব। ড্রাইভার খুঁজে নেবে থাকার জায়গা। চলবে ?” রাজী হয় ইয়াসমিন। এত কাজ আর ভাল লাগে না। বিদেশি এনজিওতে ছুটি থাকেনা বললেই চলে।
পদ্মার চরে বসে আছে ওরা। খুব আস্তে করে চাঁদ উঠে এসেছে। আলুথালু জ্যোৎস্না দুধের মত গলে গলে পড়ছে। অন্তরা গাইছিল “মেঘ বলেছে যাব যাব, রাত বলেছে যাই ---- গান থামিয়ে শ্যালেটা উড়িয়ে দেয় জ্যোৎস্নায়। শার্ট প্যান্ট খুলে মিসেস বেকহাম অন্তর্বাস বালুতে লুটিয়ে দিয়ে এক অদ্ভুত অপার্থিব সুরেলা আওয়াজ করে শাদা চরে ছুটতে থাকে । চমকে উঠে ইয়াসমিন। কবে কোথায় কোন অরণ্যে সমুদ্রের ধারে পর্বতের কন্দরে বরফের হিমিকায় জলভরা নদীর কূলে সৃষ্টির প্রথম দিনে রাতে প্রহরে প্রহরে সেও ত গেয়েছিল এই গান ! জ্বলে উঠে শরীর মন। সভ্যতার দেওয়া পোশাকের মুখোশ খুলে ফেলে এক অনন্য ছন্দে ইয়াসমিনও গেয়ে উঠে আর্ত আহবানে। জ্যোৎস্না ধরা দুটি নগ্ন নারী চৌথালি রাত পর্যন্ত আদি পুরুষের স্মরণে অবিরাম ডেকে যায়। ধরিত্রীতে এখনও পুরুষ জন্মায়নি। কিছু শিশ্নধারী অমানুষ কেবল নারী মাংসের খোঁজে শিকারি হয়েছে মাত্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র